রাজনীতিতে এখন জায়গা করে নিচ্ছে পচনশীল দ্রব্য সংরক্ষণের রাসায়নিক তরল ফরমালিন৷ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই এই ফরমালিন ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত৷ নেতারা পরস্পরের রাজনীতিতে পচন ধরেছে বলে দাবি করে ফরমালিন ব্যবহারের কথা বলছেন৷
বিজ্ঞাপন
তবে তাতে পচনশীল দ্রব্য তাজা থাকলেও রাজনীতি কতটা তাজা থাকবে তা বলতে পারছেন না রাজনীতির বিশ্লেষকরা৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর শেষে দেশে ফিরে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘বিএনপির রাজনীতি পচে গেছে৷ এখন আমরা একে ফরমালিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি৷'' এর আগে খালেদা জিয়ার এক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন৷ শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘বিএনপি নির্বাচনে না এসে ধরা খেয়ে এখন খেই হারিয়ে ফেলছে৷''
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে রবিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ একটি ভয়ংকর দল৷ শেখ হাসিনার শাসনে এই দলটিই বরং পচে গেছে৷ এই দলকে বাঁচাতে এখন ফরমালিন প্রয়োজন৷'' তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি কারুর দয়ায় রাজনীতি করে না৷ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলেই বোঝা যাবে কোন দলটি পচে গেছে৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা ইতিবাচক যে রাজনীতিবিদরা অশ্রাব্য ভাষার পরিবর্তে রাজনীতিতে ফরমালিনের মতো উপমা ব্যবহার করছেন৷ নতুন এই উপমায় হয়তো তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষ উৎসাহিত হবে৷ তবে তাঁরা আসল সত্য প্রকাশ করেছেন৷'' তিনি বলেন, ‘‘সবার কথার মধ্য দিয়েই একটি সত্য উঠে এসেছে যে রাজনীতিতে পচন ধরেছে৷ তবে এই পচনের কথা কে বা কারা বলছেন এবং তাদের মুখে এটা মানায় কিনা বা তাঁরা এই পচন রোধের উপযুক্ত লোক কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন৷''
ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘‘বাংলাদেশের রাজনীতি এবং দলীয় রাজনীতিতে এখন গণতন্ত্রহীনতা লক্ষ্যণীয়৷ এটা দূর করা না গেলে রাজনীতির পচন রোধ করা সম্ভব নয়৷''
অন্যদিকে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ. ম রেজাউল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদশের রাজনীতির সংস্কার প্রয়োজন৷ দেশে যেমন গণতন্ত্র প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দলে৷ আর রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণও হতে হবে গণতান্ত্রিক৷'' তিনি বলেন, ‘‘কোনো দলের অগণতান্ত্রিক কাজ সেই দলকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে৷ বাংলাদেশে তা ঘটছে৷'' তবে ফরমালিনে তা রক্ষা পাবে কিনা তা তাঁর জানা নেই৷
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এই ফরমালিন নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা৷ কেউ বলছেন, ‘‘আমরা ফরমালিন মুক্ত রাজনীতি চাই৷'' আরেকজন বলেছেন, ‘‘ফরমালিন হলো বিষ৷ এই বিষ রাজনীতিতে প্রয়োগ করবেন না প্লিজ৷ এমনিতেই ফরমালিন যুক্ত মাছ-মাংস আর ফলমূল খেয়ে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়েছি৷ আমাদের নতুন করে অসুস্থ করবেন না৷''