১৯৯৩ সালের দিল্লি বিস্ফোরণ কাণ্ডের মূল আসামি বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানি সন্ত্রাসী দেবিন্দর সিং ভুল্লারের ফাঁসির আদেশ রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত৷ ফাঁসি কার্যকর করতে বিলম্বের কারণেই এ নতুন আদেশ৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার ১৯৯৩ সালে দিল্লি বিস্ফোরণ কাণ্ডের মূল আসামি খালিস্তানি সন্ত্রাসী দেবিন্দর পাল সিং-এর ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷ ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে সরকারের অনাবশ্যক বিলম্ব এবং আসামির মানসিক অসুস্থতার কারণেই সাজার এই পরিবর্তন৷
২০০১ সালে সন্ত্রাসী ভুল্লারকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল দিল্লির এক নিম্ন আদালত৷ সেই আদেশ রদ করার আবেদন জানানো হলে ২০০২ সালে তা খারিজ হয়ে যায় সুপ্রিম কোর্টে৷ তারপর ২০০৩ সালে ভুল্লারের স্ত্রী তাঁর স্বামীর মানসিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কিউরেটিভ পিটিশন দাখিল করে জানান যে, ভুল্লার মানসিকভাবে সুস্থ নয়৷ পরে রাষ্ট্রপতির কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান তিনি৷ দীর্ঘ ৮ বছর পর সেই আবেদন খারিজ করে দেন রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালে৷ উল্লেখ্য, দিল্লি বিস্ফোরণ কাণ্ডে নিহত হয়েছিল ৯ জন এবং আহত হয় ২৫ জন৷ আহতদের মধ্যে একজন ছিলেন কংগ্রেস যুব সংগঠনের সভাপতি এম.এস বিট্টা৷
সর্বোচ্চ স্তরে ফাঁসির রায় বহাল থাকার পরও বছরের পর বছর সরকারের দিক থেকে তা কার্যকর করতে অহেতুক বিলম্ব ফাঁসি রদ করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ বলে মন্তব্য করেছিল শীর্ষ আদালত ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে৷ তারই জেরে ১৮ জন ফাঁসির আসামিকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন৷ তার মধ্যে ছিল ১৯৯১ সালে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হত্যা মামলায় অভিযুক্ত তিনজন তামিল ফাঁসির আসামি৷ রাজীব গান্ধী হত্যা মামলার তিনজন তামিল অপরাধীকে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলেও জয়ললিতার তামিলনাড়ু সরকার তামিল জাতীয়তাবাদের আঁচে হাওয়া দিতে বিধানসভায় এক বিশেষ প্রস্তাব পাশ করিয়ে তাঁদের মু্ক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়৷ কেন্দ্রীয় সরকার ঐ একতরফা সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধীতা করে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি পেশ করে৷ এর প্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালত তামিলনাড়ু সরকারের সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দেয়৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
ভুল্লারের ক্ষেত্রে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান বিপরীত৷ কেন্দ্রীয় সরকারে অ্যাটর্নি জেনারেল শীর্ষ আদালতে রায়কে স্বাগত জানান৷ বলেন, এই রায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো আপত্তি নেই৷ পর্যবেক্ষকরা এর মধ্যে ভোট রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন৷ আর মাসখানেক পরেই সাধারণ নির্বাচন৷ গোটা দেশে এখন নির্বাচনি উত্তাপ তুঙ্গে৷ এই আবহে ভুল্লারের ফাঁসি রদের আদেশকে স্বাগত না জানালে পাঞ্জাবে রাজনৈতিক ভুল বার্তা যাবে৷ শিরোমণি আকালি দল শাসিত পাঞ্জাবে ভোটের ফায়দা তুলবে বিরোধী দলগুলি৷ নতুন করে অশান্তি দেখা দিতে পারে৷ দলীয় স্বার্থের দিকে তাকিয়েই কি তাহলে কংগ্রেস সরকার আদালতের রায়কে স্বাগত জানালো?
১৯৭০ থেকে ৮০-এর দশকে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যকে পৃথক করে শিখ রাষ্ট্র খালিস্তান গঠন করার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে সহিংস আন্দোলনের রূপ নেয়৷ সেই আন্দোলন দমন করতে সরকার ব্লু-স্টার নামে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে সামরিক অভিযান চালায়৷ স্বর্ণমন্দির তখন ছিল খালিস্তানিদের এক ঘাঁটি৷ তারই জেরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শিখ দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হলে ১৯৮৪ সালে গোটা দিল্লিতে শুরু হয় শিখ নিধন যজ্ঞ৷ হিন্দু-শিখ দাঙ্গার ইস্যু এখনো এক নির্বাচনি ইস্যু শিখ আকালি দলের৷ খালিস্তানি সন্ত্রাসী ভুল্লার ৯৩ সালে দিল্লিতে এক বড় রকম সন্ত্রাসী হামলা চালাবার পরেই পালিয়ে যায় জার্মানিতে৷ কিন্তু ১৯৯৫ সালে জার্মানি ভুল্লারকে ফেরৎ পাঠায় ভারতে৷