সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় রিভিউয়ের আবেদন বৃহস্পতিবার খারিজ করে দিয়েছেন৷ এর ফলে এখন আর ফাঁসির দণ্ড কার্যকরে কোনো বাধা নেই৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার মধ্যরাতে এই ফাঁসি কার্যকর করার কথা থাকলেও কাদের মোল্লার আইনজীবীর আবেদনে তা স্থগিত করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ৷
আপিল বিভাগে কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের গ্রহণযোগ্যতার বুধবারের মুলতুবি শুনানি শুরু হয় বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার পর৷ শুনানি শেষে দুপুর ১২টার পর দেয়া রায়ে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার আবেদন খারিজ করে দেন৷ এর ফলে একাত্তরে মু্ক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরে আর কোনো বাধা রইলো না৷ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন ফাঁসির দণ্ড কার্যকর বাধাগ্রস্ত করতে সব ধরণের অপচেষ্টার অবসান ঘটলো৷ এখন আর কোনো বাধা নেই৷
তবে ফাঁসি কার্যকর কখন হবে তা এখনো জানা যায়নি৷ আদেশের পর আইন মন্ত্রণালয় এবং কারা কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠকে বসেছেন৷ আর কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন আদেশের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পরই জেল কোড মেনে দণ্ড কার্যকর করা যাবে৷
এদিকে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন দেশের মানুষের চূড়ান্ত বিজয় হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা যুদ্ধে নেমেছি৷ এ যুদ্ধে আমাদের বিজয় হবেই৷’’
গত মঙ্গলবার রাত ১২টা ১ মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার সব প্রস্তুতি নিয়েছিল কারা কর্তৃপক্ষ৷ কাদের মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর ঐ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু তার আগেই মঙ্গলবার রাতে কাদের মোল্লার আইনজীবীরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে না জানিয়েই সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে ফাঁসি কার্যকর স্থগিতের আবেদন জানান৷ চেম্বার জজ তাদের আবেদন গ্রহণ করে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ড কার্যকর স্থগিত করেন৷ বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি স্থগিতের আদেশ দেন আদালত৷ আর বৃহস্পতিবার কাদের মোল্লার আবেদন খারিজ হলে ফাঁসির পথে সব বাধা সরে যায়৷ প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে বিচারপতি এস কে সিনহা, আবদুল ওয়াহাব মিয়া, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং এই এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই আদেশ দেন৷
ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে৷ এ বছর প্রথম রায়ে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন অভিযাগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য আবুল কালাম আযাদকে৷
ছবি: AP
কাদের মোল্লার ‘বিজয়প্রতীক’, দেশজুড়ে বিক্ষোভ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিতি পাওয়া কাদের মোল্লাকে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় এবং রায়ের পর কাদের মোল্লা আঙুল উঁচিয়ে বিজয়প্রতীক দেখানোয় শুরু হয় বিক্ষোভ৷
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে প্রবল অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দেখা দিলে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়৷ এর আগে শুধু আসামিপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল৷ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের পর জামায়াতে ইসলামীও বিক্ষোভে নামে৷ দলটি মনে করে, এ রায় যথার্থ হয়নি৷ সেই থেকেই শুরু রায়ের প্রতিবাদে হরতাল৷
ছবি: Reuters
সাঈদির ফাঁসির আদেশ
জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অপরাধে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইবুনাল৷ প্রতিবাদে হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামি৷ জামায়াত এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক তাণ্ডব চালায়৷ সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির লুট, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ স্টেশনে হামলা,অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ – সবই ঘটেছে, অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে তখন৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তি দাবি
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার কয়েকজন ব্লগারের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত-এ ইসলাম৷ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁদের ‘নাস্তিক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থন এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে৷ চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখে সরকার৷
ছবি: Reuters
অবশেষে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ
মঙ্গলবার সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসি দিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয় আপিল বিভাগ৷রায় ঘোষণার আগে সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
উৎসবের আনন্দ
এ রায়ে আবার জেগে ওঠে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর৷ ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ শুনে সেখানে আবার নামে মানুষের ঢল৷ অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হতে চলেছে – এটাই তাঁদের আনন্দ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
জামায়াতের হরতাল, বিক্ষোভ
কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী৷ রায়কে ‘ভুল’ দাবি করে, অভিযুক্ত সব নেতার মুক্তির দাবিতে এ হরতাল ডেকেছে তারা৷ আবার বিক্ষোভে নেমেছে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা৷কাদের মোল্লার আইনজীবী জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ডের রায় পর্যালোচনার জন্য আবেদন করা হবে৷ তবে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ রায় পর্যালোচনার কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
9 ছবি1 | 9
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগে কাদের মোল্লাকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল৷ আর আইন সংশোধন করে আপিল করা হলে ১৭ সেপ্টেম্বর ফাঁসির দণ্ড দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ৷ গত ৫ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিতহয়৷ ৭ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে৷
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের পর সারাদেশে জামায়াত-শিবির সহিংসতা শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে৷ ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে বুধবার গভীর রাতে৷ আর কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল শেষবারের মতো তার বাবার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ চেয়েছেন৷
অন্যদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা এখনো সেখানে অবস্থান করছেন৷ আপিল বিভাগের আদেশের খবর ছড়িয়ে পড়লে শত শত মানুষ জাতীয় পতাকা এবং মিছিল নিয়ে সেখানে জড়ো হচ্ছেন৷ গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেছেন কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান করবেন৷ আর নিরাপত্তার জন্য ঢাকাসহ সারাদেশে র্যাব-পুলিশ ছাড়াও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে৷