ফাঁসি কি শিশুধর্ষণ কমাতে পারবে?
২৪ এপ্রিল ২০১৮শিশু ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে, তাই নিয়ে দিশাহারা গোটা দেশ৷ জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়া এবং উত্তর প্রদেশের উন্নাওয়ে নাবালিকা ধর্ষণকাণ্ডের প্রেক্ষিতে গোটা দেশের জনরোষ সামাল দিতে মোদী সরকার তড়িঘড়ি জারি করেছেন এক অর্ডিন্যান্স৷ এতে ১২ বছরের কম বয়সি নাবালিকা ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের অপরাধে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাবাস৷ন্যূনতম শাস্তি ২০ বছরের কারাদণ্ড৷ ১৬ বছরের কম বয়সি বালিকাকে গণধর্ষণের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ বিচারপর্ব শেষ করতে হবে দুই মাসের মধ্যে৷ ফাঁসির সাজাসহ আইন কঠোর করা হয়েছে এই অর্ডিন্যান্সে তাতে সন্দেহ নেই৷ সেটা দরকারও বটে৷ কিন্তু তারপরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়৷ ফাঁসির বিধান দিয়ে এই ঘৃণ্য অপরাধ কতটা আটকানো যাবে?
কারণ, দেখা গেছে, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের পর ভার্মা কমিশনের সুপারিশে শিশু যৌন নিপীড়ন ও নাবালিকা ধর্ষণ প্রতিরোধ আইন (পকসো) আরও কঠোর করা হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও ধর্ষণ কমেনি, বরং ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে৷ জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যানে সেটাই উঠে এসেছে৷ ২০১৬ সালে গোটা দেশে প্রায় ৩৯ হাজার ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়৷ তারমধ্যে ৩৬ হাজার শিশু ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহের ঘটনা৷ এই তো গত সোমবার দিল্লির লাগোয়া হরিয়ানার একটি গ্রাম থেকে ১৪ বছরের এক নাবালিকাকে রাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় পাঁচ জন৷ তারপর গণধর্ষণ করে৷ পুলিশ তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে, অন্য দুজন এখনও পলাতক৷ তিন দিন আগে ওড়িষার স্কুলের এক বাচ্চা মেয়েকে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে ধর্ষণ করে এক যুবক৷ ধরা পড়ার ভয়ে বাচ্চাটাকে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করে সে৷ কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি মরেনি৷ তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ একই ধরনের নাবালিকার উপরে যৌন নিগ্রহের খবর এসেছে সুরাট থেকে৷ এসেছে উত্তর প্রদেশের বেরিলি থেকে৷ আট বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণ করে ১৪ বছরের এক নাবালক৷ এটা শুধু গত এক সপ্তাহের পরিসংখ্যান৷ সব দিতে গেলে তালিকা আরো দীর্ঘ হবে৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই এইসব অপরাধ আটকাতে মৃত্যুদণ্ডের যথার্থতা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে বিভিন্ন মহলে৷
পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কমিশনের পূর্বতন চেয়ারম্যান সুনন্দা মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ফাঁসির মতো শর্টকার্ট সমাধানে কাজ হবার নয়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এটা একটা দীর্ঘ মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, যাকে বলে সিজোফ্রেনিয়া৷ এর মূলে আছে সৃষ্টিতন্ত্রের কিছু অবিকশিত দিক৷ সেক্স সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকা৷ এর থেকে বের হতে হলে দরকার সেক্স এডুকেশন৷ নিজের দেহকে জানো, মনকে জানো৷ দ্বিতীয়ত, শিশু ধর্ষণ প্রমাণ করা সহজ নয়৷ এজন্য দরকার ফরেনসিক ল্যাব৷ একটি শিশু ধর্ষণ সম্পর্কে নিজে কিছু বলতে পারবে না৷ ঠিকমতো বোঝাতে পারবে না৷ তবুও আদালতে তাকে বারংবার জেরা করা হবে৷ তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও এটা ঠিক নয়৷ বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার৷ যাঁরা শিশু ও মহিলাদের নিয়ে কাজ করেন তাঁরাই এটা করতে পারবেন৷''
‘‘ফাঁসির বিধান দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা একটা আলটপকা ব্যবস্থা৷ রাজনৈতিক চটজলদি সিদ্ধান্ত৷ সমাজে এক্ষেত্রে বদল আনতে গেলে প্রয়োজন গভীর বিচার-বিশ্লেষণ৷ ফাঁসির বিধান দিয়ে কিছু হবার নয়৷ বরং হিংস্রতা আরও বাড়বে৷ তাতে হবে কি, আগে শিশু বা নাবালিকাকে ধর্ষণ করতো, এখন খুন করে ছেড়ে দেবে'', ডয়চে ভেলেকে বললেন পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের প্রাক্তন প্রধান সুনন্দা মুখোপাধ্যায়৷
মহিলা অধিকার আন্দোলনের কর্মী তথা আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার মনে করেন,বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাবালিকা ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহ হয় আত্মীয়-পরিজন ও প্রতিবেশীদের দ্বারা৷ এখন এই ধরনের ঘটনা চেপে যাবার একটা প্রবণতা দেখা দেবে লোকলজ্জার ভয়ে৷ কাজেই ফাঁসির সাজা এর প্রতিষেধক হতে পারে না৷ ‘প্রয়াস' নামের এক এনজিওর প্রধান আমোদ কান্ত মনে করেন, বিচার ব্যবস্থার বর্তমান কাঠামোর মধ্যে ব্যতিক্রমী এবং বিরল থেকে বিরলতম ঘটনায় ফাঁসির সংস্থান আছে৷ নতুন করে ফাঁসির অধ্যাদেশ জারি করে লাভ বিশেষ হবে না৷ আসল কথা হচ্ছে, আইন কড়া করলেই লড়াই শেষ হয়ে যায় না৷ আইনের উপযুক্ত প্রয়োগ যখন ঘটে, সুফল তখনই পাওয়া যায়৷ প্রয়োগটা হবে পুলিশ প্রশাসনের স্তরে৷ তদন্ত প্রক্রিয়া দুর্বল হলে অপরাধীদের সাজা হয় না৷
সারা দেশে যখন কন্যা সন্তানের যৌন নিগ্রহ নিয়ে তোলপাড়, তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ারে একটি বেফাঁস মন্তব্য যেন আগুণে ঘি ঢেলেছে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ভারতের মতো বিরাট দেশে দু-একটা ধর্ষণের ঘটনা তো ঘটতেই পারে, তা নিয়ে এত হৈ চৈ করার কী আছে ?'' এরপর প্রধানমন্ত্রী মোদীও তাঁকে এই ধরনের কথা বলতে বারণ করেন৷