আগামী ১২ই ডিসেম্বর ব্রিটেনের আগাম নির্বাচনের ফলাফলের কোনো নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে না৷ ইউগভ সংগঠনের এক জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী ব্রিটেনের ভোটাররা এই মুহূর্তে মূলত ব্রেক্সিটের পক্ষে অথবা বিপক্ষে অবস্থান নিতে ব্যস্ত৷ কোনো দলের প্রতি আনুগত্য সে ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে না৷ প্রায় ৮৬ শতাংশ ব্রিটিশ ভোটার এমনটা মনে করেন৷
চলতি সপ্তাহে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মাথাব্যথা কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিলেন ব্রেক্সিট পার্টির প্রধান নাইজেল ফারাজ৷ গত নির্বাচনে যে সব আসন টোরি দলের ঝুলিতে গিয়েছিল, সে সব আসন থেকে প্রার্থী প্রত্যাহার করে ব্রেক্সিটপন্থি ভোটারদের মধ্যে বিভাজন দূর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু অন্যান্য আসনেও টোরি দলের জয়ের সম্ভাবনা এড়াতে ফারাজের উপর চাপ বাড়ছিল৷ এবার তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, যে নির্বাচনের রণক্ষেত্র ছেড়ে তিনি মোটেই চলে যাবেন না৷ যত বেশি সংখ্যক আসনে জিতে তিনি আগামী সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চান৷ দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে টোরি দলের পক্ষ থেকে নানা রকম টোপ দেওয়া হচ্ছে বলেও ফারাজ অভিযোগ করেন৷ টোরি দল অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷
প্রধানমন্ত্রী জনসন তাঁর দলকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিতে ভোটারদের কাছে আবেদন করছেন৷ ক্ষমতায় ফিরলে তিনি জানুয়ারি মাসের শেষে ব্রেক্সিট কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন৷ তবে এবারও টোরি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সরকার গড়ার জন্য ব্রেক্সিট পার্টি বা অন্য কোনো দলের উপর নির্ভর করতে হবে৷ অন্যদিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার দলের নেতা জেরেমি কর্বিন ক্ষমতায় এলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দরকষাকষি করে ব্রেক্সিট চুক্তিতে রদবদল করে দ্বিতীয় গণভোটের অঙ্গীকার করছেন৷
নির্বাচনি প্রচার চলাকালীনও ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংঘাত দূর হচ্ছে না৷ আগামী ১লা ডিসেম্বর জার্মানির উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনের নেতৃত্বে নতুন কমিশনের কার্যভার গ্রহণ করার কথা৷ নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক সদস্য দেশের এক জন কমিশনর মনোনয়ন করার কথা৷ কিন্তু ব্রিটেন কোনো কমিশনরের নাম প্রস্তাব না করায় সংকটের সৃষ্টি হয়েছে৷ ফলে লন্ডনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ শুরু করছে ব্রাসেলস৷ ব্রিটেনের বিদায়ী সরকার জানিয়েছে, প্রথা অনুযায়ী নির্বাচনের ঠিক আগে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন করা সম্ভব নয়৷
ব্রিটেনে নির্বাচনের পর ব্রেক্সিট কার্যকর হলেও ব্রিটেন ও ইইউ-র মধ্যে নতুন সমস্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ কারণ বিচ্ছেদ চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করার পর ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়েও বোঝাপড়ায় আসতে হবে৷ ২০২০ সালের মধ্যেই সেই ‘চূড়ান্ত' চুক্তি অনুমোদন করতে হবে৷ তা না হলে ব্রিটেনকে বাদ দিয়ে ইইউ-র বাজেট কার্যকর করা কঠিন হবে৷ দুই পক্ষের মধ্যে রফা না হলে ‘চুক্তিহীন' ব্রেক্সিটের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/জেডএইচ (রয়টার্স, ডিপিএ)