বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসান আলী নামে এক রাজাকার কমান্ডারকে গুলি করে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দিয়েছে৷ কিন্তু ফৌজদারি কার্যবিধিতে এভাবে দণ্ড কার্যকরের কোনো নজির নেই৷
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১ মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হাসান আলীকে মঙ্গলবার পলাতক অবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়৷
রায়ে বলা হয়, ‘‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে মৃত্যুদণ্ড কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই৷ তবে ফৌজদারি কার্যবিধিতে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কথা আছে৷ আর ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে বলা হয় যে, ঐ আইনের অধীনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে৷ এ জন্য ট্রাইব্যুনাল মনে করে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা গুলি করে – সরকার যেভাবে চাইবে, সেভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবে৷''
বিভিন্ন দেশে যেভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য একেক দেশ একেক রকম পদ্ধতি ব্যবহার করে৷ ছবিঘরে থাকছে তেমন কয়েকটি উপায়ের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইনজেকশন
অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য সোডিয়াম পেন্টোনাল, সম্পূর্ণ অক্ষম করার জন্য প্যানকিউরোনিয়াম ব্রোমাইড আর হৃদযন্ত্র থামিয়ে দেয়ার জন্য পটাশিয়াম ক্লোরাইড নামের তিনটি রাসায়নিক উপাদান ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়ে অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনামে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: BilderBox
গুলি
ইন্দোনেশিয়া, চীন, সৌদি আরব, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া সহ কয়েকটি দেশে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে তাকে বসিয়ে বা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়৷ এরপর সামরিক বা নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য একের পর এক গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন৷
ছবি: Fotolia/Scanrail
বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে
অভিযুক্তকে কাঠের চেয়ারে বসিয়ে তার মাথা ও পায়ের মাধ্যমে শরীরে ৫০০ থেকে ২,০০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ প্রতিবার ৩০ সেকেন্ড করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কয়েকবার এভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ এই পদ্ধতিটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফাঁসি
বাংলাদেশ সহ আফগানিস্তান, ভারত, ইরান, ইরাক, জাপান, মালয়েশিয়া ও কুয়েতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রচলন রয়েছে৷
ছবি: vkara - Fotolia.com
শিরশ্ছেদ
কয়েক হাজার বছর ধরেই শিরশ্ছেদ বিষয়টি রয়েছে৷ তবে বর্তমানে শুধু সৌদি আরবে এই পদ্ধতিটি চালু রয়েছে৷ সাধারণত শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মসজিদ প্রাঙ্গনে শিরশ্ছেদ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Abir Abdullah
অন্যান্য উপায়
পাথর ছুড়ে মারা, গ্যাস চেম্বারে ফেলে দেয়া, অনেক উঁচু থেকে অভিযুক্তকে নীচে ফেলে দেয়ার মাধ্যমেও কোথাও কোথাও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
এ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৯টি মামলার রায় ঘোষণা করা হলো৷ এর মধ্যে ন'টি মামলার রায় ঘোষণা করলো ট্রাইব্যুনাল ১৷ বাকি ১০টি মামলার রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল ২ আর ১৭টি মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া এই দু'টি ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত পাঁচটি মামলায় ছ'জন আসামির পলাতক অবস্থায় বিচার হয়েছে৷
এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে৷
মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান জানান, ‘‘ট্রাইব্যুনাল এই প্রথম গুলি করে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছে৷ এর আগে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় বিচার আদালত আসামিদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দিয়েছিল৷ তবে সেটাও কার্যকর হয়নি৷ সে সময় উচ্চ আদালত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেয়৷''
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী, অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বা বিচারক যে রকম মনে করবেন সেই শাস্তি দিতে পারবেন৷ আর কার্যকর কিভাবে হবে, তাও তাঁরা বলে দিতে পারেন৷ তাছাড়া ট্রাইব্যুনাল আইন একটি বিশেষ আইন৷ প্রচলিত ফৌজদারি আইনের থেকে এ আইন আলাদা৷ হাসান আলীর মামলায় ট্রাইব্যুনাল ফায়ারিং স্কোয়াড বা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিলেও, আদালত তা চূড়ান্তভাবে সরকারের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়েছে৷ রায়ে বলা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে গুলি করে অথবা সরকার যেভাবে চাইবে৷''
একবিংশ শতাব্দীতে যেসব দেশ মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করেছে
বাংলাদেশে কোনো অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷ গত বছর সেদেশে কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি, ২০১৩ সালে দুইজন এবং ২০১২ সালে একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে৷
ছবি: Fotolia/Matthias Krüttgen
ভুটান
২০০৪ সালে ভুটানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে নেয়া হয়৷ দেশটিতে সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল ১৯৭৪ সালে৷
ছবি: DW/A. André
আলবেনিয়া
এই দেশে ২০০০ সালে মৃত্যুদণ্ড তুলে নেয়া হয়েছে৷ সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ১৯৯৫ সালে৷
ছবি: Fotolia/Matthias Krüttgen
বুরুন্ডি
২০০৯ সালে দেশটি থেকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি তুলে নেয়া হয়েছে৷ সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২০০০ সালে৷
ছবি: picture-alliance/Philipp Ziser
চিলি
চিলিতে সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল ১৯৮৫ সালে৷ দেশটি থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে নেয়া হয় ২০০১ সালে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফিলিপাইন্স
২০০০ সালে এই দেশে সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল৷ ২০০৬ সালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে নেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/P. Hille
কাজাখস্তান
২০০৭ সালে দেশটি থেকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি তুলে নেয়া হয়৷ ২০০৩ সালে সেখানে সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মাদাগাস্কার
এই দেশে সবশেষ ১৯৫৮ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল৷ অথচ দেশটি থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে নেয়া হয়েছে গত বছর৷
ছবি: picture alliance / blickwinkel
মন্টেনেগ্রো
২০০২ সালে দেশটি থেকে মৃত্যুদণ্ড তুলে নেয়া হয়৷ ১৯৯২ সালে সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল সেখানে৷
ছবি: imago/P. Widmann
সেনেগাল
২০০৪ সালে দেশটি থেকে মৃত্যুদণ্ড তুলে নেয়া হয়৷ শেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল ১৯৬৭ সালে৷
ছবি: Alexander Joe/AFP/Getty Images
সার্বিয়া
২০০২ সালে মৃত্যুদণ্ড তুলে নেয়া হয়৷ সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল ১৯৯২ সালে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তুরস্ক
১৯৮৪ সালে তুরস্কে সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল৷ ২০০২ সালে দেশটি থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান তুলে নেয়া হয়েছে৷
ছবি: Bulent Kilic/AFP/Getty Images
উজবেকিস্তান
২০০৮ সালে দেশটি থেকে মৃত্যুদণ্ড তুলে নেয়া হয়৷ ২০০৫ সালে সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল সেখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
12 ছবি1 | 12
এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, ‘‘মৃত্যুদণ্ডের রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর তা কার্যকরের দায়িত্ব সরকারের৷ কখন তা কিভাবে কার্যকর হবে, তা কার্যবিধি অনুযায়ী সরকারই নির্ধারণ করে৷''
রানা দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘ট্রাইব্যুনাল হয়ত জঘণ্য অপরাধের গুরুত্ব বোঝাতে ফায়রিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কথা বলেছে৷''
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট স. ম রেজাউল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অতীত কোনো নজির নেই৷ ফৌজদারি কার্যবিধিতেও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান নেই৷ বিধান হলো দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের৷''
ওদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার কথায়, ‘‘কারাগারে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকরের ব্যবস্থা আছে৷ কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াড বা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কোনো ব্যবস্থা বা অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের কারাগারগুলোর নেই৷''