সিরিয়ায় বেআইনি ভাবে পেট্রোলিয়াম পাচার করতে গিয়ে জ্বলে ছাই হয়ে গিয়েছিল দুইটি জাহাজ। ফিনসেন ফাইল থেকে নতুন তথ্য উদ্ধার।
বিজ্ঞাপন
একের পর এক কেলেঙ্কারি ধরা পড়ছে ফিনসেন ফাইল থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বড় কেলেঙ্কারির তথ্য বহু দিনের মধ্যে প্রকাশিত হয়নি। ৮৮টি দেশের প্রায় ৪০০ সাংবাদিকের অনুসন্ধানে এ বার উঠে এসেছে নতুন তথ্য। সিরিয়ায় গোপনে ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা। জাতিসংঘের নিষেধ উপেক্ষা করে সেই ব্যবসা চালাতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে বহু সাধারণ মানুষকে।
সম্প্রতি ফিনসেন ফাইল থেকে জানা গিয়েছে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি ক্রিমিয়া সমুদ্রের কাছে তরল জ্বালানি গ্যাস ভর্তি দুইটি জাহাজ রাতারাতি পুড়ে যায়। তদন্তের পর জানা যায়, ওই দুইটি জাহাজেই পেট্রোলিয়াম জাত গ্যাস ছিল। সমুদ্রের মধ্যেই একটি জাহাজ অন্য জাহাজে গ্যাস স্থানান্তর করছিল। তখনই বিস্ফোরণ হয়। সম্পূর্ণ জ্বলে যায় দুইটি জাহাজই। ফিনসেন ফাইল থেকে জানা যাচ্ছে, ওই দুইটি জাহাজের একটির সিরিয়ায় বেআইনি ভাবে পেট্রোলিয়াম দ্রব্য পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। যদিও এ ধরনের দ্রব্য সিরিয়ায় সরবরাহো করা কিংবা সিরিয়া থেকে নিয়ে আসার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অ্যামেরিকা এবং জাতিসংঘ।
ব্যাংক খাতের নানা কেলেঙ্কারি
রাজনীতি, অর্থ, পেশি শক্তি, অপকৌশল, দুর্নীতি – এ সব নানা কারণে বারবারই বিপদের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত৷ ব্যাংক খাতে নানা সময়ে সংঘটিত কেলেঙ্কারির খবর দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance / Klaus Ohlenschläger
রিজার্ভের অর্থ উধাও
২০১৬ সালে ঘটে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা৷ অজ্ঞাতনামা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় পাচার করে দেয়৷ ফিলিপিন্সে পাচার করা ৮.১ কোটি ডলারের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি৷ এ ঘটনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
জালিয়াতের খপ্পরে এটিএম কার্ড
‘স্কিমিং ডিভাইস’ নামের বিশেষ এক যন্ত্র বসিয়ে গ্রাহকদের কার্ডের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে৷ চুরি করে তারা এর সঙ্গে এক জার্মান নাগরিক জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ প্রতারকদের আটক করা হলেও তারা বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে দুই দিনেই অন্তত ২০ লাখ টাকা তুলে নেয়৷
ছবি: bdnews24.com
হলমার্ক কেলেঙ্কারি
২০১২ সালে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ফাঁস হয়৷ সে সময় কেবল সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে ২০১০-২০১২ সময়ে মোট তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়৷ এর মধ্যে অখ্যাত হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাৎ করে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা৷ তখন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি৷
ছবি: DW
বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি
রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া আব্দুল হাই বাচ্চু পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়ার পর ব্যাংকটি অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়৷ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটিতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম পায় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ ব্যাংকের টাকা মেরে দিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়৷ এসব ঋণের বেশিরভাগই আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি৷
ছবি: bdnews24.com
ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে লুটপাট
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে ঘটে এই ঘটনা৷ ব্যাংকটির তৎকালীন উদ্যোক্তারা অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা৷ লুটপাটের কারণে ২০০৬ সালে ব্যাংকটি অতিরুগ্ন হয়ে পড়ে৷ মালিকপক্ষের হাতে থাকা ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ শেয়ারও বাজেয়াপ্ত করা হয়৷ তা কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ৷ তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক হয়, তবে এখনো পুরো টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকেরা৷
ছবি: imago/Milestone Media
ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন দেয়া একটি ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংক৷ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দীকী নাজমুলের মালিকানাধীন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের ছয়টি শাখায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম পাওয়া যায়৷ এতে জনগণের সংরক্ষিত আমানত ফেরত দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে ব্যাংকটি৷
ছবি: bdnews24.com
লুটপাটের অন্ত নেই
নতুন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৭৪১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম দেখা যায়৷ ২০১০-২০১৫ সালে আইন লঙ্ঘন করে অ্যাননটেক্স নামে একটি গ্রুপকে ৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার ফান্ডেড, নন-ফান্ডেড ঋণ প্রদান করে জনতা ব্যাংক৷ বিসমিল্লাহ গ্রুপ ২০১১ ও ২০১২ সালে দেশের পাঁচটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়৷
ছবি: DW
আরো আছে অনেক
এখানেই শেষ নয়৷ সময়ে সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানান অভিনব কৌশলে ভূয়া চুক্তিপত্র দেখিয়ে, কিংবা এক কাজে ঋণ নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করার অসংখ্য নজির আছে দেশে৷ তাই নানা সময়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংক খাত৷ শুধু তাই নয়, শেয়ার বাজারকে নানা সময়ে অতিমূল্যায়িত করে ব্যাংক খাতের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance / Photoshot
8 ছবি1 | 8
যে দুইটি জাহাজ ওই বেআইনি কাজে যুক্ত হয়েছিল, তার একটির নাম ক্যান্ডি এবং অন্যটির নাম মায়েস্ত্রো। দুইটি জাহাজই আন্তর্জাতিক সংস্থা মিলেনিয়াম এনার্জির। বেআইনি কাজের জন্য অ্যামেরিকা এই সংস্থাকে বহু দিন আগেই ব্ল্যাক লিস্টে রেখেছিল। কিন্তু তাতেও এই সংস্থার কাজ আটকায়নি। দিনের পর দিন একাধিক বেআইনি কাজ তারা করে গিয়েছে নাম পরিবর্তন করে। বস্তুত, ক্যান্ডি এবং মায়েস্ত্রো জাহাজের অধিকাংশ কর্মী জানতেনই না তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন। জানা গিয়েছে, তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন ভারত এবং তুরস্কের কর্মী। যাওয়ার আগে তাঁদের বলা হয়েছিল, লিবিয়ায় জাহাজ নিয়ে পৌঁছতে হবে। কিন্তু জাহাজে উঠে তাঁরা জানতে পারেন, সিরিয়া যেতে হবে।
এখানেই শেষ নয়, জাহাজ দুইটি বেআইনি ভাবে সমুদ্রের মাঝখানে তরল গ্যাস ট্রান্সফার করছে, এ কথা যাতে কেউ জানতে না পারে, এবং তারা কোথায় যাচ্ছে, তা যাতে সকলের দৃষ্টির আড়ালে থাকে, তাই দুইটি জাহাজেরই নেভিগেশন সিস্টেম বন্ধ করা ছিল। আগুন লাগার পরেও সে কারণে রেসকিউ টিম বুঝতেই পারেনি কোথায় এমন ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ কর্মীকেও সে কারণে বাঁচানো যায়নি। সব মিলিয়ে ১৪ জন আহত কর্মীকে পরে উদ্ধার করা হয়।
ফিনসেন ফাইল থেকে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য সামনে আসছে। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সংস্থা কী ভাবে জড়িয়ে ছিলেন বা আছেন নানা বেআইনি কাজের সঙ্গে। সব চেয়ে বড় কথা, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে তাঁরা অর্থ লেনদেন করেছেন। এটিও তেমনই একটি বেআইনি কাজের উদাহরণ।