এককালে ছোট্ট যন্ত্রের রঙিন পর্দায় নানা রকম শব্দের ঝনঝনানি শুনলে বোঝা যেত, ভিডিও গেম খেলা হচ্ছে৷ আজ কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের দৌলতে অসংখ্য গেম সবার নখদর্পণে৷ কিন্তু পুরনো গেম-এর আকর্ষণ মোটেই কমেনি৷
বিজ্ঞাপন
বার্লিনে ‘গেমসউইক' প্রদর্শনীতে এটাই সেরা আকর্ষণ৷ রেট্রো গেমস – বেশিরভাগই ৩০ বছরের বেশি পুরানো৷ অত্যন্ত সহজ বিন্যাস, গ্রাফিক্স-ও সেই মান্ধাতার আমলের৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরো শক্তি দিয়ে এই গেমস খেলা চলছে৷ বার্লিনের দুই গেমস ডেভেলপার রিয়াদ জেমেলি ও ইয়োহানেস ক্রিস্টমান-ও বিষয়টি লক্ষ্য করছেন৷ তাঁরাও এই ক্ল্যাসিক গেম দেখে মুগ্ধ৷ ক্রিস্টমান বলেন, ‘‘ঠিক পুরানো আসবাবের মতো৷ মনে হয়, বিশাল বড় অথবা ভীষণ ভারি – তাই আজ আর এমন জিনিস বসার ঘরে রাখবো না৷ কিন্তু এমন নিপুণ হাতে তৈরি জিনিস দেখলে মুগ্ধও হতে হয় বৈকি৷''
এক বছর আগে এই দুই ডেভেলপার চাকরি ছেড়ে নিজেদের স্টুডিও খোলেন৷ তাঁদের প্রথম গেম-এর নাম ‘দ্য কিউরিয়াস এক্সপিডিশন'৷ মাত্র কয়েক মাস আগের হলেও দেখলে মনে হবে নব্বইয়ের দশকে তৈরি৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে তৈরি এই গেম-এ খেলোয়াড় নিজেই অভিযান পরিচালনা করছেন৷ দূরের দেশ আবিষ্কার করার সময় নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন৷ যেমন নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়৷
গেম শুধু খেলবেই না, বানাবেও
বাংলাদেশের অনেক কিশোর-কিশোরী কম্পিউটার গেম খেলতে পছন্দ করে৷ তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেম ডেভেলপার হিসেবে গড়ে তুলতে ‘উই মেক গেমস’ নামে একটি কর্মসূচি শুরু হয়েছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
‘উই মেক গেমস’
স্কুলের শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার গেম তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার কর্মসূচি ‘উই মেক গেমস’৷ এর আওতায় সারা দেশের ৪০০ স্কুলের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা করছে গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাসিভস্টার স্টুডিও লিমিটেড৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: MassiveStar Studio
সরকার সঙ্গে থাকবে
বিশাল এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন ম্যাসিভস্টার স্টুডিও-র প্রধান নির্বাহী মাহবুবুল আলম৷
ছবি: MassiveStar Studio
লক্ষ্য বাজার ধরা
মাহবুবুল আলমের মতে, সারা বিশ্বে কম্পিউটার গেমের ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি বাজার আছে৷ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে তৈরি হওয়া গেম ডেভেলপাররা এই বাজারের একটি অংশ বাংলাদেশে নিয়ে আসবে বলে আশা তাঁর৷
ছবি: Getty Images
নভেম্বরে শুরু হয়েছে
‘উই মেক গেমস’ কর্মসূচিটি শুরু হয়েছে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে৷ ইতিমধ্যে ঢাকার ১১টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের গেম তৈরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বা হয়েছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
প্রতিভাবান কিশোর-কিশোরী
মাহবুবুল আলম মনে করেন, বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থী কম্পিউটারে গেম খেলে তাদের একটা বড় অংশ গেম ডেভেলপ করারও ক্ষমতা রাখে৷ সেসব শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে গেম ডেভেলপার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব৷
ছবি: WCG
‘হাতিরঝিল ড্রিম বিগিনস’
উই মেক গেমস কর্মসূচির বাস্তবায়নকারী সংস্থা ম্যাসিভস্টার স্টুডিও লিমিটেড ‘হাতিরঝিল ড্রিম বিগিনস’ নামে একটি কম্পিউটার গেম বাজারে নিয়ে এসেছে৷ এই গেম তৈরির সঙ্গে মাশরুর মাহমুদ নামে সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরও রয়েছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
পেছনের কারিগর
প্রায় ২১ জন তরুণ ছয় মাস কাজ করে গেমটি ডেভেলপ করে৷ এঁদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট মাশরুর মাহমুদ৷ সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
নির্মাণ কৌশল
থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স, গুগল স্কেচআপ প্রো, ব্লেন্ডার ও মায়া সফটওয়্যার ব্যবহার করে গেমটি নির্মাণ করা হয়েছে৷ গেমটিতে মোট লেভেল আছে ৩১টি৷ একটি লেভেল শেষ করে পরেরটিতে যেতে হবে৷ প্রতিটি লেভেলের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ
খেলার পাশাপাশি চাইলে বিআরটিসির বাস বা গাড়িতে করে হাতিরঝিলে ঘুরে বেড়ানো যাবে৷ স্পিডবোট আর বিমান নিয়েও গেম খেলা যাবে৷
ছবি: MassiveStar Studio
স্মার্টফোনেও
কম্পিউটারের পাশাপাশি স্মার্টফোনেও যেন গেমটি খেলা যায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ আগামী ঈদের আগেই অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরা যেন গেমটি খেলতে পারেন সে চেষ্টা করা হচ্ছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
কোথায় পাবেন?
বর্তমানে ঢাকা শহরের প্রায় ১৬০টি সিডির দোকানে এই গেমটি পাওয়া যাচ্ছে৷ তবে মাস খানেকের মধ্যেই সেটা সারা দেশে পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
11 ছবি1 | 11
সেকেলে ধাঁচে গ্রাফিক্স তৈরি করেছেন ইয়োহানেস ক্রিস্টমান৷ ল্যান্ডস্কেপ সৃষ্টি করতে সামান্য কিছু পিক্সেলই যথেষ্ট৷ দেখতে এমন সহজ সরল হওয়ার কারণে এই গেম-এর কিছু সুবিধাও রয়েছে৷ ক্রিস্টমান বলেন, ‘‘আমাদের গেম সহজে সেকেলে হবে না, কারণ অ্যান্টিকের উপর ভিত্তি করেই তো এটি তৈরি হয়েছে৷ আমাদের আশা, ৫ থেকে ১০ বছর পরেও এই গেম খেলা যাবে৷ অন্যদিকে আজ যে সব আধুনিক গেম বাজারে আসছে, ৬ মাস পরেই সে সব পুরানো হয়ে যাচ্ছে৷ তার উপর আমাদের গেমে গ্রাফিক্স কম৷ আমাদের আশা এর ফলে গেমারের কল্পনাশক্তি আরও উর্বর হয়ে উঠবে৷''
গেম-এর কনসেপ্টের উপরেও ক্ল্যাসিক যুগের প্রভাব রয়েছে৷ পুরানো অ্যাডভেঞ্চার গেমস-এর মতো এ ক্ষেত্রেও অনেক টেক্সট ও জটিল টাস্ক রয়েছে৷ একজন চরিত্রের মৃত্যু হলে আবার প্রথম থেকে খেলা শুরু করতে হয়৷ আগের গেম-এর পয়েন্ট সেভ-ও হয় না৷ রিয়াদ জেমেলি বলেন, ‘‘গেমটা বেশ গোলমেলে৷ কয়েক ঘণ্টা ধরে হিমশিম খেতে হতে পারে৷ অনেকটা আগেকার কঠিন গেম-গুলির মতো৷ খেলার মধ্যে এভাবে ডুবে যাওয়া বেশ রোমাঞ্চের ব্যাপার – এমনকি হেরে গেলেও৷ আমাদের গেম-এ নানাভাবে হেরে যাওয়া সম্ভব, সেটাই বিশাল রোমাঞ্চের বিষয়৷''
যে সব গেম ২০ বছরের বেশি পুরানো, সেগুলিকে সাধারণত ‘রেট্রো' বলা হয়৷ বাণিজ্যিক কম্পিউটার গেম-গুলির মধ্যে ১৯৭২ সালের ‘পং'-কে সেরা হিসেবে ধরা হয়৷ এর কিছুকাল পরে বাজারে এসেছিল ‘স্পেস ইনভেডার্স'৷ সেটা ছিল কম্পিউটার গেমস জগতে বড় অগ্রগতি৷ ১৯৮৩ সালে ‘মারিও' নামের চরিত্র আত্মপ্রকাশ করে৷ গোটা বিশ্বে ‘জাম্প এন রান' গেমস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷
কম্পিউটার গেমে যৌনতা
কম্পিউটারে যারা গেম খেলেন তাদের অর্ধেকই নারী হলেও নারী ডিজাইনারের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে গেমগুলোতে নারীদের বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে৷
ছবি: DW
যৌনতার উপস্থিতি
ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কম্পিউটার মেলার৷ সেখানে অংশ নিয়েছিল কম্পিউটার গেম ডেভেলপার ‘ইউবিসফট’৷ তাদের নতুন গেম ‘জাস্ট ড্যান্স ২০১৪’-র প্রচারণা উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে এই চার নারী ও পুরুষ মডেল গেমের চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলছেন৷
ছবি: Robyn Beck/AFP/Getty Images
অর্ধেকই নারী
জরিপ বলছে, প্রতি তিন জার্মানের একজন নিয়মিত কম্পিউটার গেম খেলেন এবং গেমারদের অর্ধেকই নারী৷
ছবি: DW/G.Ferreto
পছন্দের ভিন্নতা
পুরুষ গেমাররা পছন্দ করেন অ্যাকশন৷ তবে মেয়েদের পছন্দ এমন গেম, যা তাঁদের জন্য আরামদায়ক এবং অনেকটা কমিউনিটি নির্ভর হয়৷ সংশয়, মারামারি আর প্রতিযোগিতায় ভরপুর গেম তাঁদের বিশেষ পছন্দ নয়৷ বরং সামাজিক গেম, যেগুলো ফেসবুকের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং বন্ধুদের সঙ্গে খেলা সম্ভব, সেগুলোই খেলে থাকেন মেয়ে গেমাররা৷
ছবি: dapd
নারী ডিজাইনারের সংখ্যা কম
জার্মানিতে নারী ডিজাইনারের সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ৷ সে কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও গেম ডেভেলপের ক্ষেত্রে নারীর পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না৷
ছবি: DW
তাই বিতর্কিত উপস্থাপন
ডিজাইনের ক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি কম হওয়ার কারণে গেমগুলোর নারী চরিত্রগুলোকে হয় বাড়াবাড়ি রকম সেক্সি, না হয় অসহায় মানুষ হিসেবে দেখানো হয়৷ নারী ডিজাইনারের সংখ্যা বাড়লে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা৷
ছবি: AP
কেন কম?
জার্মানির আরেক গেম ডিজাইনার ক্যারোলিন গেপার্ট৷ তাঁর নিজের একটি গেম তৈরির কোম্পানি রয়েছে, যার নাম ‘ইয়ো মেই’৷ শুরুতে কাজ করতেন একটি কোম্পানিতে৷ সেখানে কাজ শিখে পরে নিজেই নিজের সংস্থাটি খোলেন৷ কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারেন না, কেন গেম শিল্পে মেয়েদের উপস্থিতি এতটা কম৷
ছবি: DW
6 ছবি1 | 6
তারপর আসে প্রথম অ্যাডভেঞ্চার গেম-গুলি৷ ১৯৯০ সালের জনপ্রিয় গেম ‘মাংকি আইল্যান্ড'-এর চমকপ্রদ গ্রাফিক্স বিশেষ নজর কেড়েছিল৷ আজও অনেক গেম স্টুডিও সেই ধারা বজায় রেখেছে৷
২০০৯ সালের ‘মাইনক্রাফট'-ও এমন প্রভাব রেখেছে৷ প্রায় ৫ কোটি ৬০ লক্ষ কপি বিক্রি করে এটি দুনিয়ার সবচেয়ে সফল গেমগুলির অন্যতম হিসেবে পরিচিত৷ এই গেম অনেকের কাছে ছোটবেলার স্মৃতি জাগিয়ে তোলে৷ কম্পিউটার গেম বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেয়াস লাঙে বলেন, ‘‘প্রথম দিকের কম্পিউটার গেম-গুলি এমন একটা সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যখন সার্বিকভাবে কম্পিউটার প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ছিল৷ প্রাথমিক যুগের কম্পিউটারের কারণেই এই গ্রাফিক্স জনপ্রিয় হয়েছিল৷ আজ আমরা ফিরে তাকিয়ে বুঝতে পারি, সেটা কতটা জরুরি ছিল৷ এটা তো একটা ডিজিটাল বিপ্লব, যা তখন শুরু হয়েছিল৷ তাই এই রেট্রো-গ্রাফিক্স শুধু দারুণ সব গেম-এর নয়, সামগ্রিকভাবে কম্পিউটার প্রযুক্তিরও প্রতীক৷
শিল্পকলার জগতেও এই সব রেট্রো গেমস তাদের জায়গা করে নিয়েছে৷ বার্লিন গেম উইকে পর্দায় এইট বিট গ্রাফিক্স দেখানো হচ্ছে৷ প্রদর্শনীতে ‘গেমবয়' সত্যি নজর কাড়ছে৷ অথবা নিনটেন্ডো চরিত্রগুলি৷ এ সব ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দেয়৷