জাপান সরকার এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু নারী ও শিশুদের জন্য সংকট এখনও শেষ হয়নি, বলছে গ্রিনপিস৷ মায়েরা হাজারে হাজারে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
ছ'বছর আগের কথা: ভূমিকম্প, সুনামি ও ফুকুশিমার দাইচি আণবিক চুল্লিতে পারমাণবিক বিপর্যয়ের ফলে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান এবং ১ লাখ ৬০ হাজার বেশি মানুষ গৃহহারা হন৷ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ এখনও অস্থায়ী আবাসনে দিন কাটাচ্ছেন৷
সংশ্লিষ্ট বসতিগুলির সব মানুষ ফুকুশিমা বিপর্যয়ের ফলে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন, কিন্তু আজ পর্যন্ত নারী ও শিশুরাই ফুকুশিমা থেকে সৃষ্ট ‘‘মানবাধিকার ভঙ্গের ঘটনার শিকার হয়েছে'', বলে গ্রিনপিস সংগঠনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে৷ এক্ষেত্রে বিশেষ করে ‘‘ফুকুশিমার সর্বাধিক (পারমাণবিক দূষণে) দূষিত এলাকাগুলিতে বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের'' সরকারি পরিকল্পনার কথা বলে গ্রিনপিস৷
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টায় জাপান সরকার মার্চ মাসের শেষে স্থানান্তরণের নির্দেশ তুলে নেওয়ার ও বাসিন্দাদের ফুকুশিমা আণবিক চুল্লির কাছাকাছি বসতিগুলিতে ফেরৎ যাবার অনুমতি দেওয়ার কথা ভাবছেন৷ তবে ঐ সব এলাকায় তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের পরিমাণ এখনও বিপজ্জনকভাবে উচ্চ, বলে গ্রিনপিস সাবধান করে দিয়েছে এবং সরকারের প্রতি বাসিন্দাদের উপর চাপ সৃষ্টি না করার আহ্বান জানিয়েছে৷ এলাকাগুলি নিরাপদ ঘোষণা করার এক বছর পরে সরকার আর্থিক সাহায্য এবং স্থানান্তরিত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া বন্ধ করবেন৷
ফুকুশিমা এখনো ধুঁকছে
ভূমিকম্প, সুনামি আর পারমাণবিক কেন্দ্র বিস্ফোরণের ক্ষতি সামলে ওঠার জন্য এখনো লড়ছে জাপান৷ পাঁচ বছর আগে ত্রিমুখী আক্রমণে বিপর্যয় নেমে এসেছিল৷ ফিরে দেখা যাক সেই দিনটি, দেখা যাক এখন কী অবস্থায় আছে ফুকুশিমা৷
ছবি: Reuters/T. Hanai
১৮ হাজারেরও বেশি মানুষের ঘাতক
২০১১ সালের ১১ই মার্চ ২টা ৪৬ মিনিটে যেন প্রলয় শুরু হয়েছিল জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে৷ প্রথমে প্রচণ্ড ভূমিকম্প৷ রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার সেই ভূমিকম্পের কারণে শুরু হলো সুনামি৷ তাতে মারাত্মক ক্ষতি হলো ফুকুশিমার পারমাণবিক কেন্দ্রটির৷ পারমাণবিক চুল্লি ছিদ্র হয়ে চারপাশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ল৷ সুনামিতে ধ্বংস হয় অনেক বাড়ি-ঘর৷ এক হিসেবে মোট ১৮ হাজার ৫শ’ মানুষ মারা যায় সেদিন৷ নিখোঁজ হয় ২ হাজার মানুষ৷
ছবি: Bertram Schiller
এখনো ভুগছে মানুষ
ফুকুশিমার বিপর্যয়ে যে শুধু ১৮ হাজার মানুষ মারা গেছে তা নয়, অসংখ্য মানুষকে এখনো ভোগ করতে হচ্ছে বিপর্যয়ের পরিণাম৷ দায়িচি পারমানবিক চুল্লির আশপাশের এলাকায় এখনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে আছে৷ অনেকেই এখনো নিজের ঘরে ফিরতে পারেননি৷
ছবি: Bertram Schiller
শূন্য স্কুল
দাইচির কাছের এই স্কুলটি এখনো খালি পড়ে আছে৷
ছবি: Getty Images/C.Furlong
এখনো চলতে হয় সাবধানে
এখনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে আছে৷ তাই সংবাদ সম্মেলনেও সাংবাদিককে বসতে হয় এই পোশাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T.Hanai
প্রার্থনা
এখানেই একসময় ছিল নিজের বাড়ি৷ ছবির এই নারী ২০১১ সালের ১১ই মার্চ বাড়ি হারিয়েছেন, সঙ্গে হারিয়েছেন স্বজনদেরও৷ তাই ফুল দিয়ে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের জন্য প্রার্থনা করছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K.Kamoshida
স্বজনদের স্মরণ
প্রতিবছর এই দিনে ২০১১ সালের ১১ই মার্চের দুর্যোগে হারানো মানুষদের স্মরণ করে জাপান৷ চিরতরে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এক বৌদ্ধ ভিক্ষু৷
ছবি: TORU YAMANAKA/AFP/Getty Images
জাতীয় শোক
প্রতি বছর শোকের পরিবেশেই পাঁচ বছর আগের দিনটিকে স্মরণ করে জাপান৷ ১০ মার্চ জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যখন সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন তখন কালো ফিতা দেখা গেল জাতীয় পতাকায়৷ ফুকুশিমায় নিহতদের স্মরণ করতেই পতাকায় লাগানো হয় কালো ফিতা৷
ছবি: Reuters/T. Hanai
7 ছবি1 | 7
এছাড়া যারা সরকারের নির্দেশ না থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় তাদের বসবাসের এলাকা ত্যাগ করেছেন, তাদের বাড়িভাড়ার জন্য আর্থিক ভরতুকি এই মার্চ মাসেই বন্ধ করে দেওয়া হবে – এর ফলে নাকি দশ হাজারের বেশি মানুষকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দূষিত এলাকায় ফিরতে হতে পারে, বলেছেন গ্রিনপিস জাপানের এক মুখপাত্র৷ এ ধরনের ‘‘অর্থনৈতিক দমননীতি''-কে ‘‘আইন তথা নিপীড়িতদের মানবাধিকারের পরিকল্পিত লঙ্ঘন'' বলে অভিহিত করেছেন তিনি৷
যারা তাদের সাবেক আবাসে ফিরে অস্বীকার করবেন, অথচ যারা সরকারি সাহায্যের উপর নির্ভরশীল – বিশেষ করে একা সন্তান প্রতিপালনকারী মায়েরা – তাদের উভয়সংকট, কেননা তাদের মধ্যে অনেকেই ফুকুশিমার কারণেই বিয়ে ভেঙেছেন – স্বামী দূষিত এলাকায় থেকে যেতে চেয়েছেন বলে৷ জাপানি ভাষায় এর নাম ‘গেনপাৎসু রিকন' বা আণবিক বিবাহবিচ্ছেদ৷
সরকার যে সব এলাকা দূষণ মুক্ত করেছেন, তা প্রায়শই রাস্তা বা বাড়ি ও কৃষিক্ষেত্রের চারপাশে ২০ মিটার চওড়া এক ফালি জমি ছাড়া আর কিছু নয়৷ গ্রিনপিস এ ধরনের আবাসিক এলাকার নাম দিয়েছে ‘মুক্ত কারাগার', যার ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেরও হানি ঘটতে পারে৷
তবে মায়েরা কিছু দম যাননি, তারা সকলে মিলে জাপানি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, যাতে সরকার আবাসিক ভরতুকি ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণ চালু রাখতে বাধ্য হন৷
ফুকুশিমার ছায়া
দুইবছর আগে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে ভেবেছে৷ কারও উপর আবার কোনো প্রভাবই পড়েনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
একইসঙ্গে সুনামি, ভূমিকম্প ও পরমাণু দুর্ঘটনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হয় দুই বছর আগে৷ সাগরের নীচে ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর উত্তরপূর্ব উপকূলে সুনামি তৈরি হয়৷ এতে কমপক্ষে ১৫,৮৮০ জন মারা যায়৷ আর আহত হয় ৬,১৩৫ জন৷ তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ২,৬৯৪ জন৷
ছবি: dapd
পরমাণু দুর্ঘটনা
সুনামির কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে তিনটি চুল্লি অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ আর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে৷ ফলে সরকার ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসরতদের সরে যেতে বলে৷ এখনো তারা ঘরে ফিরতে পারেনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
চেরনোবিল
ফুকুশিমার আগে ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পরমাণু দুর্ঘটনা৷ ১৯৮৬ সালে ঐ কেন্দ্রের একটি চুল্লিতে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ফলে ইউরোপ ও রাশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে৷ ঐ দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তারপরও পরমাণু বিদ্যুৎ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেরনোবিলের কথা সবাই ভুলে যায়৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পরমাণু বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ এমনকি ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চুল্লি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এমনকি জার্মানিও
জার্মানি এমনিতেই পরমাণু শক্তির চরম বিরোধী৷ তাই সাবেক চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ২০২২ সালের মধ্যে পরমাণু শক্তি উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ বর্তমান সরকার সেটা বাড়িয়ে ২০৩৪ পর্যন্ত করতে চেয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফুকুশিমা বদলে দিল সব
ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর জার্মানিতে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়৷ ফলে এখন আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে৷ জার্মানি ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৮০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷
ছবি: picture alliance/Hinrich Bäsemann
ইটালিতেও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
জার্মানির মতো ইটালিও পরমাণু শক্তির ঘোর বিরোধী৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ১৯৮৭ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইটালীয়রা পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের পক্ষে ভোট দেয়৷ পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি সেটা আবারও শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষে ব্রিটেন
ব্রিটিশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকে জ্বালানির একটা উৎস হিসেবে দেখছে৷ তাদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে পরমাণু বিদ্যুৎ৷
ছবি: AP
চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত
২০২০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হওয়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বিক্ষোভের কারণে মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চীনের লক্ষ্যও একই
চীনও পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে৷ বর্তমানে দেশটির মোট চাহিদার মাত্র এক শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে৷ ২০২০ সালের মধ্যে এই হারটা চীন ছয় শতাংশে নিয়ে যেতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশে প্রথম
পাবনার রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হতে যাওয়া এই কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷