কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল কয়েকশ' মরোক্কান রাস্তায় জড়ো হয়েছে৷ অনেকের হাতে পতাকা৷ নেচে-গেয়ে উদযাপন করছে তারা৷ ট্রাফিক নিয়মের বালাই না করে রাস্তা দখল করে তারা উৎসবে মেতে ওঠে৷ অল্প সময়ের মাঝে মনে হলো আফ্রিকান দেশটি থেকে আসা সকল নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে এসেছে৷ হাড় কাঁপানো শীতে মাঝরাত পর্যন্ত ঐতিহাসিক জয় উদযাপন করে তারা৷
ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হচ্ছে তা এর আগে এই শহরে টেরই পাওয়া যায়নি৷ বিশ্বকাপে ইউরোপ মহাদেশ থেকে বেশি দেশ খেলে৷ জার্মানিসহ এবার খেলেছে ১৩টি দেশ৷ ২০১০ থেকে পরপর তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছে যথাক্রমে স্পেন, জার্মানি এবং ফ্রান্স৷ এছাড়াও রয়েছে পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের মতো ভালো দল৷
কাতার বিশ্বকাপের যা কিছু মনে থাকবে
রোববার ফাইনালের মধ্য দিয়ে কাতার বিশ্বকাপ শেষ হচ্ছে৷ উত্তেজনাপূর্ণ খেলা ছাড়াও এই বিশ্বকাপকে ঘিরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা সমর্থকদের মনে থাকবে৷
কাতারি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক গুত্রা৷ এটি একধরনের হেডস্কার্ফ৷ বিভিন্ন দেশের সমর্থকদের মাথায় এটি পরতে দেখা গেছে৷ দোহার সুক ওয়াকিফে বিভিন্ন দেশের রংয়ে তৈরি গুত্রা বিক্রি হতে দেখা গেছে৷
ছবি: Hassan Ammar/AP/picture alliance
পরনে থাউব
থাউব হলো লম্বা হাতাসহ পুরো শরীর ঢাকা সাদা একধরনের পোশাক, যা কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পুরুষরা পরে থাকেন৷ বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে কাতারে যাওয়া অনেক সমর্থককে থাউব পরতে দেখা গেছে৷ যেমন ছবিতে ক্যানাডার সমর্থকদের দেখা যাচ্ছে৷ সঙ্গে আছে গুত্রাও৷
ক্রোয়েশিয়ার সাবেক বিউটি কুইন ও মডেল ইভানা ক্নোল খোলামেলা পোশাকে স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, কাতারের স্থানীয়রা তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি যে-কোনো পোশাক পরতে পারবেন৷ অবশ্য ব্রাজিলের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালের দিন নিরাপত্তা কর্মীরা তার সঙ্গে কাউকে ছবি তুলে দেয়নি বলে জানান তিনি৷ বিশ্বকাপের সমর্থকদের শালীন পোশাক পরার অনুরোধ করেছিল কাতার৷
ছবি: Ulmer/Teamfoto/IMAGO
বাংলাদেশ নিয়ে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের টুইট
কাতার বিশ্বকাপ দেখার জন্য ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দা বসানো হয়েছে৷ সেখানে কয়েক হাজার দর্শক একসঙ্গে খেলা দেখেন৷ আর্জেন্টিনার জয়ের পর সেখানে আনন্দ-উল্লাসের ছবি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে৷ আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন ১ ডিসেম্বর এমন তিনটি ছবি প্রকাশ করে টুইট করে বাংলাদেশি সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়েছে৷ সঙ্গে লিখেছে, ‘‘আমাদের দলকে সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ৷ তারা আমাদের মতোই পাগলাটে৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বাংলাদেশি সমর্থকদের আর্জেন্টিনার কোচের ধন্যবাদ
আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের টুইটের বিষয়টি এক সংবাদ সম্মেলনে কোচ স্কালোনিকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘‘এসব জেনে তো খুবই ভালো লাগে৷ আমার মনে হয়, প্রথমে ডিয়েগো (ম্যারাডোনা), পরে মেসির কারণে আর্জেন্টিনার ফুটবলের সমর্থক বেড়েছে৷ বাংলাদেশে আমাদের এমন সমর্থন আছে জেনে আমি গর্বিত৷ শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্য অনেক দেশের মানুষও আমাদের সমর্থন করে৷’’
ছবি: picture alliance/dpa
বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার দূতাবাস চালু হতে পারে
আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো কাফিয়েরো ১০ ডিসেম্বর টুইট করে জানান বাংলাদেশের সাথে বুয়েনস আইরেস নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে৷ টুইটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সাথে একটি ছবি পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশে ১৯৭৮ সাল থেকে বন্ধ আর্জেন্টিনার দূতাবাস পুনরায় চালু করার কথা ভাবছে আর্জেন্টিনা৷’’
ছবি: JUAN MABROMATA/AFP
আর্জেন্টিনার রেডিওতে বাংলাদেশের ক্রিকেট
ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জয়ের খবর দিয়ে টুইট করেছিল আর্জেন্টিনার রেডিও ‘এল দেসত্যাপে’৷ এছাড়া এক আর্জেন্টাইন নাগরিক বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমর্থনে ফেসবুকে গ্রুপ খুলেছেন৷
ছবি: Surjeet Yadav/AP/picture alliance
ফিফার টুইটে বাংলাদেশ
আর্জেন্টিনা-মেক্সিকো ম্যাচে বাংলাদেশি দর্শকদের মেসির গোল উদযাপনের একটি ভিডিও টুইট করেছিল ফিফা৷ পরে ব্রাজিল সমর্থকদের বাঁধভাঙা উল্লাসের ছবিও টুইট করেছিল ফুটবলের ঐ বিশ্ব সংস্থা৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
অভিবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থায় কাতারের সমালোচনা
কাতারে বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণকাজে নিয়োজিত অনেক অভিবাসী শ্রমিককে সময়মতো বেতন না দেয়া, কম বেতন দেয়া, তাদের বাসস্থানের দুরবস্থা এবং কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যু, এসব নিয়ে কাতারের সমালোচনা করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা৷ তবে কাতার বলেছে, তারা শ্রম আইনে অনেক সংস্কার এনেছে৷
ছবি: Igor Kralj/PIXSELL/picture alliance
হাত দিয়ে মুখ ঢেকে প্রতিবাদ
কাতারে সমকামিতা অবৈধ৷ সমকামীদের প্রতি সমর্থন জানাতে বিশ্বকাপ ম্যাচে রংধনু রংয়ের আর্মব্যান্ড পরতে চেয়েছিলেন ইউরোপের আট দেশের অধিনায়ক৷ কিন্তু সেটি করলে শাস্তির হুমকি দিয়েছিল ফিফা৷ ফিফার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রথম ম্যাচ শুরুর আগে জার্মান দল হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ছবি তুলেছিলেন৷
ছবি: Alexander Hassenstein/Getty Images
জাতীয় সংগীতে চুপ ইরানিরা
ইরানে চলমান বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানাতে দেশটির খেলোয়াড়েরা প্রথম ম্যাচে জাতীয় সংগীতের সময় ঠোঁট মেলাননি৷
ছবি: Sebastian Frej/MB/IMAGO
বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আপসেট
প্রথম রাউন্ডে সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হেরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা৷ ডাটা কোম্পানি নিলসেন গ্রেসনোট বলছে, এই হার বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আপসেট৷ এর আগের আপসেটটি ছিল ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জয়৷ ব়্যাংকিং সিস্টেম এবং জটিল ফর্মুলা ব্যবহার করে গ্রেসনোট বলছে, মেসিদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের জেতার সুযোগ ছিল মাত্র ৮.৭ শতাংশ৷ আর ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জয়ের সম্ভাবনা ছিল ৯.৫ শতাংশ৷
ছবি: Matthias Hangst/Getty Images
বাংলাদেশে মারামারি
বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশে সমর্থকদের মধ্যে কথা কাটাকাটি থেকে শুরু করে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে৷ প্রথম আলো বুধবার জানিয়েছে, ফুটবল নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জের ধরে সংঘর্ষে, পতাকা টানাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে কিংবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, খেলা দেখার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১২ জন মারা গেছেন৷ এদের বেশিরভাগই কিশোর ও তরুণ৷ এছাড়া আহত হয়েছেন অন্তত ২৭ জন৷ হতাহতদের সবাই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থক৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
13 ছবি1 | 13
অথচ এই শহরে যেন কেউ খেলা দেখছে না৷ দু-একটি বাদে রেস্তোরাঁ বা পাব কোথাও টেলিভিশনে খেলা নেই৷ রাস্তায় নেই বড় ডিজিটাল মনিটর৷ নেই কোনো উম্মাদনা বা মাতামাতি৷ ভেবেছিলাম জার্মানির ম্যাচের দিনে হয়ত বোঝা যাবে৷ কিন্তু না, সেসব দিনেও বন শহর ছিল নীরব৷ যদিও জার্মানি প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেয়৷
এই চিত্র যে শুধু বন শহরের তা নয়, বরং ইউরোপের অন্যসব শহরের দৃশ্যপটও এরকমই৷ তাহলে কি ফুটবল-পাগল ইওরোপিয়ানরা এবার বিশ্বকাপ দেখছে না?
ফুটবল মানেই উৎসব৷ বিশ্বকাপের সময় বড় বড় শহর যেন থেমে যায়৷ সবাই ব্যস্ত থাকে টিভি অথবা বড় ডিজিটাল মনিটরে খেলা দেখতে৷ বার্লিন বা বার্সেলোনার মতো শহরে চেহারাই পাল্টে যায় বিশ্বকাপের সময়৷ ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের সময়েও এই চিত্র দেখা যায়৷ কিন্তু এবার কোনো উৎসব হচ্ছে না৷
খেলার সময় পাব ও বারে থাকতো মানুষের ভিড়৷ বিয়ারের গ্লাস হাতে চিৎকার করে অনেকে উল্লাস করে খেলা উপভোগ করতো৷ এছাড়াও খেলা দেখার জন্য খোলা জায়গায় বসানো হতো বড় বড় ডিজিটাল স্ক্রিন৷ এবার সেই চিত্রটিও অনুপস্থিত৷
বেশ কিছু কারণে এবার খেলা নিয়ে উদাসীনতা তৈরি হয়েছে ইউরোপিয়ানদের মাঝে৷ আগের আসরগুলো গরমকালে আয়োজন করা হলেও এবারের বিশ্বকাপ হচ্ছে শীতকালে৷ শীতের মধ্যে পাব বা খোলা স্থানে খেলা দেখা কঠিন৷ তাই হয়ত অনেকে ঘরে বসে খেলা দেখতে পারেন৷
তবে খেলা না দেখা বা এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে অনাগ্রহের পেছনে বড় দুটি কারণ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে বসেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম আসর৷ বিশ্বকাপ শুরুর আগেই মানবাধিকার প্রশ্নে কাতারের সমালোচনা শুরু হয় ইউরোপের অনেক দেশে৷ আয়োজনের প্রস্তুতিতে কয়েক হাজার শ্রমিকের মৃত্যু, মৃত্যুর তদন্ত না হওয়া, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপার সামনে চলে আসে৷
এরপর শুরু হয় ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড বিতর্ক, যার মাধ্যমে ইউরোপে সকল প্রকার জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স, বিশ্বাস, সংস্কৃতি আর যৌনতার ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরোধিতা করা হয়৷ ইউরোপের সাতটি দেশ ইংল্যান্ড, ওয়েলস, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ডেনমার্কের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেনরা এবারের কাতার বিশ্বকাপে বাহুতে ওয়ান লাভ ব্যান্ড পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ কিন্তু ফিফার হুঁশিয়ারির পর ওই ব্যান্ড পড়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে দেশগুলো৷
জার্মানি-জাপান ম্যাচে খেলার শুরুর আগে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে প্রতিবাদ জানায় জার্মানির খেলোয়াড়রা৷ মাঠের বাইরে প্রাক্তন এক ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী, জার্মান ফেডারেল মিনিস্টার, বিবিসির স্পোর্টস প্রেজেন্টার এবং ইংল্যান্ডের সাবেক নারী খেলোয়াড় অ্যালেক্স স্কটকে রেইনবো আর্মব্যান্ড পরতে দেখা যায়৷ ড্যানিশ এক টিভি রিপোর্টার ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড পরেছিলেন, পরে কাতারি এক কর্মকর্তা তাকে সেটি খুলে ফেলতে বলেন৷
এসবের বিরূপ প্রভাব পড়ে ইউরোপিয়ানদের মাঝে৷ এছাড়াও খেলার দুই দিন আগে মাঠে অ্যালকোহল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তও তিক্ত পরিস্থিতির জন্ম দেয়৷ এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে জার্মান ফুটবলার ফিলিপ লাম কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে যাননি৷ অধিকাংশ পাব ও বার জানিয়ে দেয় এবার তারা খেলা দেখার আয়োজন করছে না৷
তরুণদের মধ্যেও এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ অনেক কম৷ তারাও হয়ত নীরবে প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছে৷ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও ছাত্রদের আলোচনাতেও চলে আসে কাতারের বিষয়গুলো৷ ফলে অনেকে খেলা দেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে৷ সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল আসর শেষ হচ্ছে, কিন্তু তার আঁচ ইউরোপে পাওয়া গেল না৷
তবে মরক্কো কোয়ার্টার ফাইনালে জিতে সেমি ফাইনালে উঠলে বন শহরের বাসিন্দারা আরেকটি উদযাপন দেখে৷ শুধু বন নয়, ইউরোপের অনেক শহরেই তারা রাস্তায় বেরিয়ে জয়ের আনন্দে উৎসব করেছে৷