কোনটা ফেক নিউজ তা কে ঠিক করবে? একা সরকার? নাকি প্রেস কাউন্সিল, এডিটরস গিল্ড-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রায় নিয়ে তা করা হবে? এই নিয়েই ভারতে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
বিজ্ঞাপন
বিতর্কের কারণ, সরকার তথ্যপ্রযুক্তি বিধিতে পরিবর্তন আনছে। তার খসড়ায় বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে বা ডিজিটাল মিডিয়ায় কোনটা ফেক বা ভুয়া খবর, তা ঠিক করবে একমাত্র প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো বা পিআইবি। পিআইবি হলো তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থা, যা কেন্দ্রীয় সরকারের খবরাখবর দেয়া ও প্রচারের দায়িত্বে আছে। তারা ফেক নিউজ ঠিক করা মানে সরকারেরই করা।
এখানেই আপত্তিটা তুলেছে এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়া। তারা বলেছে, সরকারকে প্রস্তাবিত সংশোধন বাতিল করতে হবে। আগে সাংবাদিক সংগঠন, মিডিয়া সংস্থা, ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তারপর ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ে নিয়মনীতি তৈরি করতে হবে। একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে।
একটি বিবৃতিতে এডিটরস গিল্ড বলেছে, ফেক নিউজকোনটা তা ঠিক করার ভার পুরোপুরি সরকারের হাতে থাকতে পারে না। যদি এটা সরকার ঠিক করে, তাহলে তা সেন্সরশিপ জারি করার মতো হবে। তাই সরকারের এই উদ্যোগে গিল্ড খুবই উদ্বিগ্ন।
ভাইরাল হওয়া কিছু ভুয়া খবর
আজকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক তাজা খবর শেয়ার করা হয়৷ কিন্তু সেই খবরগুলোতে অনেক ভুয়া খবরও থাকে৷ অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা বিভ্রান্তও হন৷ ছবিঘরে থাকছে ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি ছড়ানো কয়েকটি ভুয়া খবর৷
একটি ফেসবুক লাইভে দেখাচ্ছিল আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র থেকে নভোচারীদের স্পেসওয়াক করার দৃশ্য৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ভাইরাল হয়ে যায়৷ ইউএনআইএলএডি, ভাইরাল ইউএসএ এবং ইন্টারেসটিনেট- এটি পোস্ট করার পর ফেসবুকে বিপুল পরিমাণ লাইক ও শেয়ার হয়৷ কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ফুটেজের কোথাও নাসা বা ফেসবুকের লাইভ স্ট্রিম কথাটির উল্লেখ ছিল না৷ পরে নাসা’র এক মুখপাত্র জানান, ভিডিওটি ২০১৩ সালে রুশ নভোচারীদের ধারণ করা ভিডিও৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Nasa
করোনা বিয়ারের প্রতিষ্ঠাতার উইল
২০১৬ সালের অন্যতম ভাইরাল খবর এটি-করোনা বিয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা আন্তোনিও ফার্নান্দেজ মৃত্যুর আগে তাঁর জন্মভূমি স্পেনের একটি গ্রামের ৮০টি পরিবারের মধ্যে ২০ কোটি ইউরো দান করার উইল করে গেছেন৷ ডেইলি মেইল প্রথমে খবরটি প্রকাশ করে স্থানীয় পত্রিকার বরাত দিয়ে৷ পরে আরটি, দ্য ইন্ডেপেন্ডেন্ট, দ্য মিররসহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রও তা প্রকাশ করে৷ পরে ফার্নান্দেজের পরিবার প্রতিবাদ জানানোয় তারা খবরটি সরিয়ে ফেলে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/M. Rourke
ধর্ষণের ভুয়া খবর
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বার্লিনে লিজা নামের এক জার্মান কিশোরীকে এক দল অভিবাসীর ধর্ষণ করার খবর ভাইরাল হয়ে যায়৷ বিশেষ করে রুশ মিডিয়ায় খবরটি বিপুল কভারেজ পায়৷ পরে কিশোরীটি জানায়, সে সব কিছু বানিয়ে বলেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Wuestenhagen
মার্কিন নির্বাচন
মার্কিন নির্বাচনে যে ভুয়া খবরটি সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছিল তাতে ছিল ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধের মাত্রার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলের তুলনা৷ এছাড়া নির্বাচনের ফলাফলের এমন একটি মানচিত্র ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশ করেছিল, যেটির দিকে ভালোভাবে তাকালে বোঝা যায় একেবারে ওপরে ২০১২ সালের উল্লেখ রয়েছে৷
ট্রাম্প এবং সিম্পসন
সিম্পসন কার্টুনে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী থাকে৷ আর এ কারণে ট্রাম্প নির্বাচনে জেতার পর একটি ট্রল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে বলা হয় সিম্পসনে আগেই বলা হয়েছিল, ট্রাম্প নির্বাচনে জিতবেন৷ কিন্তু বাস্তবে এমন কিছু হয়নি৷ অথচ টুইটারে বাস্তব আর পুরোনো ভুয়া সিম্পসনের ছবি দেয়ায় নিউজটি ভাইরাল হয়ে যায়৷
ছবি: INTERTOPICS / Taschen-Verlag
শোকার্ত ক্যাঙ্গারু
ডেইলি মেইল এমন একটি ছবি প্রকাশ করে যেখানে দেখানো হয় এক পুরুষ ক্যাঙ্গারু নারী ক্যাঙ্গারুকে দুই হাতে ধরে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে৷ ইভান সুইৎজারের তোলা ছবিটি এভাবে উপস্থাপনের কারণে ভাইরাল হয়ে যায়৷ তবে ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞরা জানান, নারী ক্যাঙ্গারুর সঙ্গে যৌন মিলনের ইচ্ছে জাগলে পুরুষ ক্যাঙ্গারুর চোখ অশ্রুসজল হয়, তখনই তারা দুই হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে নারী ক্যাঙ্গারুকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে৷
ছবি: DW/C. Atkinson
বিখ্যাত গণমাধ্যমের নকল
ভুয়া খবর প্রচারকারীরা জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত ওয়েবসাইটগুলোকে নকল করে ৷ ফলে মানুষ খুব ভালোভাবে লক্ষ্য না করলে বুঝতে পারে না, সেগুলো প্রকৃত ওয়েবসাইট, নাকি ভুয়া৷ যেমন, এবিসি নিউজ ডট কম এর সঙ্গে ডট সিও যুক্ত করে (ABCnews.com.co), ব্লুমবার্গের সঙ্গে ডট এমএ যুক্ত করে, ওয়াশিংটন পোস্ট ডট কম- এর সঙ্গে ডট সিও যুক্ত করে কয়েকটি ভুয়া সংবাদ সাইট তৈরি করা হয়েছে৷ এসব ওয়েবসাইটের কাজই ভুয়া সংবাদ পরিবেশন করা৷
ছবি: Getty Images/S. Platt
7 ছবি1 | 7
গিল্ডের বক্তব্য, ইতিমধ্য়েই অনেকগুলি আইন আছে, যা দিয়ে ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু আইনে যে পরিবর্তন করা হচ্ছে, তাতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কারণ, খসড়া প্রস্তাবে ফ্য়াক্ট চেক করার পুরো দায়িত্ব পিআইবি এবং অন্য কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তখন তারা ব্যবস্থা নেবে।
ইলেকট্রনিক্স ও আইটি মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এই খসড়া প্রকাশ করেছে। এডিটরস গিল্ড জানিয়েছে, খসড়ায় যা বলা হয়েছে, তাতে এটাই দাঁড়ায়, কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়ে কোনো তথ্য ভুয়া কি না, তা সরকারই বিচার করে জানাবে। এরকম হলে সরকারের কাজের সমালোচনাই করা যাবে না। প্রকাশিত খবর বন্ধ করা, মুছে ফেলা ও পরিবর্তন করার ক্ষমতা সরকারের থাকবে। বিচারবিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তারা এই কাজ করতে পারবে। ফলে ডিজিটল মিডিয়ার উপর সরকারি হস্তক্ষেপ ভয়ংকরভাবে বেড়ে যাবে।
সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া
প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, মিডিয়া নিজের বিশ্বাসযোগ্যতার জন্যই ফেক নিউজ বেশি করে না। নোটের ভিতর চিপ আছের মতো কিছু খবর করা হয়েছে ঠিকই, তবে তা সংখ্য়ায় কম। আর সরকারের তরফ থেকে বললে, সঙ্গে সঙ্গে তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শুভাশিস জানিয়েছেন, ''আমার মনে হয়, সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত বন্ধ করার চেষ্টা হবে। সেক্ষেত্রে মৌলিক অধিকারের উপরে হস্তক্ষেপ করবে কেন্দ্র। তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। এখন ডিজিটল মিডিয়ায় এই সব মতামতের মাধ্যমেই সরকারের সমালোচনা সবচেয়ে বেশি করা হয়।''
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিকের মতে, এই আইন চালু হলে ডিজিটাল মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলাই যাবে না। বললেই তা ফেক নিউজ বলা হবে, তারপর ব্যবস্থা নেয়া হবে।