দিনদুপুরে জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা আবারও ঘটলো বাংলাদেশে৷ মঙ্গলবার ফেনীতে প্রথমে গুলি, পরে ছুরিকাঘাত এবং শেষে জীবন্ত অবস্থায় জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এক রাজনীতিবিদকে৷ ব্লগ ও ফেসবুকে এর নিন্দা জানিয়েছেন অনেকে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের ফেনী জেলায় মঙ্গলবার খুন হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক৷ ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে জানিয়েছে, ‘‘হামলাকারীরা কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটালে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ এরপর তারা একরামকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর পর গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়৷''
আগুনে পুড়ে রাজপথেই মৃত্যু হয় একরামের৷ ইতোমধ্যে তাঁর আগুনে পোড়া মরদেহের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এই বিষয়ে সাদাত হোসাইনের লেখার শিরোনাম ‘থুঃ মানুষ৷' এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘আগুনে ঝলসানো শরীর৷ আগুনে পোড়া শরীর৷ একটা মানব শরীর৷ হ্যাঁ, একটা মানব শরীর৷ কিছু মানুষ মিলে বারবিকিউ বানিয়েছে!''
ফেসবুকে সাংবাদিক সওগত আলী সাগর এই বিষয়ে ফেনীর রাজনীতিবিদ জয়নাল হাজারীর একটি মন্তব্য প্রকাশ করেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘যে এ (ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম) হত্যার সঙ্গে জড়িত, তার নাম কেউ বলার সাহস পাবে না৷ তবে নারায়ণগঞ্জের মতো সাংবাদিকরা সোচ্চার হলে সব রহস্যের জট খোলা যাবে৷ হত্যাকাণ্ডের সময় হত্যাকারীরা তিন স্তরে ছিল৷ তাদের অর্ধেকের মুখে মুখোশ ছিল, বাকি অর্ধেকের ছিল খোলা৷ এতে মনে হয় হত্যার সঙ্গে জড়িতদের একটি অংশ স্থানীয়৷''
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার ঘটনা এটাই প্রথম নয়৷ হরতাল, অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় যাত্রীবাহী গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা আগে অনেকবার ঘটেছে৷ সর্বশেষ নির্বাচনের সময় বিষয়টি জনমনে তীব্র আতঙ্কও তৈরি করেছিল৷ সেসময় আমারব্লগে মাহবুবুল আলম লিখেছিলেন, ‘‘২৭ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ১ ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত এই এক মাস ৬ দিনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের চার দফা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে কম পক্ষে ৫৭ জন অসহায় নিরীহ মানুষের জীবন হারাতে হয়েছে৷''
এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘রাজনৈতিক অধিকারের নামে এসব ধ্বংসাত্মক ও সন্ত্রাসী কর্মসূচিতে ২৭ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনেই ককটেল, পেট্টোলবোমা, চলন্ত গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে ১৩ জন৷ ৪ নভেম্বর ২০১৩ থেকে ৬ নভেম্বরের হরতালে নিহত হয়েছে ৪ জন৷ ১০ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চার দিনের হরতালে নিহত হয়েছে ৪ জন৷ আর ২৬ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্রায় লাগাতর হরতাল ও অবরোধে ২৭ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷''
উল্লেখ্য, একরামুলকে পুড়িয়ে হত্যার পেছনের কারা জড়িত কিংবা খুনের কারণ সম্পর্কে এখনো জানাতে পারেনি পুলিশ৷ তবে এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২৩ জনকে আটক করা হয়েছে৷