সুখের আশায় দেশ ছাড়েন তারা৷ কিন্তু পথিমধ্যে দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকে ধুলিসাৎ হয় তাদের সুখ-স্বপ্ন৷ ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়ে দেশে ফিরেও কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াতে হয় বাংলাদেশের অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশীকে৷
বিজ্ঞাপন
এমন ভাগ্যবিড়ম্বিত দরিদ্র বাংলাদেশির একজন কমল সওদাগর৷ সুখের আশায় লিবিয়া হয়ে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেও অনেক দুর্ভোগের পর দেশে চলে আসতে হয় তাকে৷
দালাল ধরে প্রথমে লিবিয়া পৌঁছান ৩৩ বছর বয়সি কমল৷ কিন্তু চাঁদার দাবিতে তাঁকে সেখানে বন্দি করে রাখে পাচারকারীরা৷ এরপর প্রায় ১২ লাখ টাকা (১৪ হাজার ইউএস ডলার) দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনে পরিবার৷
ঋণ করে এই টাকা জোগাড় করে তার পরিবার৷ অনেক হতাশা নিয়ে যখন দেশে ফেরেন, তখন তিনি চাকরিহীন এবং ১২ লাখ টাকার ঋণের বোঝা তাঁর কাঁধে৷
এমন পরিস্থিতি কমলকে আত্মহত্যার পর্যায়েও নিয়ে গিয়েছিল৷ ‘‘বিষন্নতা গ্রাস করেছিল আমাকে৷ কারণ, আমাকে বাঁচানোর জন্য সুদে টাকা নিয়েছিল পরিবার৷ টাকার জন্য প্রতিদিনই বাড়িতে আসতো মহাজন৷ এমন এক সময় এসেছিল, আমি ভাবতাম গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করব,'' রয়টার্সকে বলেছেন তিনি৷
প্রতিবছর এরকম কতজন মানুষ দেশে ফিরে আসেন তার সঠিক কোনো তথ্য সরকারিভাবে পাওয়া যায় না৷ অধিকারকর্মীরা বলছেন, কমলের মতো এমন হাজার হাজার ভাগ্যাহত অভিবাসন-প্রত্যাশী দেশে ফিরেও সংগ্রাম করছেন৷ বিপরীতে তেমন কোনো সহায়তার ব্যবস্থা নেই সরকারি তরফে৷
ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা ৬৪ জন বাংলাদেশিকে গতমাসে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়৷ মে মাসে ওই অঞ্চলেই নৌকা ডুবে মারা যান ৩৭ জন বাংলাদেশি অভিবাসন প্রত্যাশী৷
ব্র্যাকে মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘ফেরত আসা ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই৷ আমাদের সব নীতি লোক পাঠানোর উপর ভিত্তি করে৷ এমনকি ফিরে আসা অভিবাসীদের সঠিক সংখ্যা জানার উপায় পর্যন্ত নেই৷''
২০১৭ সালে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ (রামরু)-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, ফেরত আসা অভিবাসীদের ৫১ শতাংশই বিদেশের মাটিতে প্রতারণা কিংবা খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন৷ আবার বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালদের টাকা দিলেও প্রতি পাঁচজনে একজন তাতে সফল হননি৷
ধার-দেনা করে ইটালির পথ ধরেছিলেন গার্মেন্টসকর্মী মোহাম্মদ জাকির হোসেন৷ কিন্তু ইটালি পাঠানোর পরিবর্তে তাকে লিবিয়ায় কাজ দেয় মানবপাচারকারীরা৷ সেখানে জাকিরের আয় থেকে টাকা কেটে রাখতো তারা৷
ধারের সাড়ে চার লাখ টাকা শোধের আশায় ঢাকায় ফিরে ফুটপাতে একটি ফলের দোকান দিয়েছেন তিনি৷ কিন্তু তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় একই পথে পুনরায় বিদেশে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা এখনো আছে তার মনে৷
‘‘হয়তো আপনি আমাকে পাগল বলতে পারেন, কিন্তু সুযোগ পেলে আবারো ধার করে আমি বিদেশের পথ ধরব৷ বৃদ্ধ মা-সহ পরিবারের পাঁচ সদস্য এখনো আমার উপর নির্ভরশীল৷ দোকান থেকে যা আয় করছি, তা দিয়ে চলছে না,'' রয়টার্সকে বলেছেন জাকির৷
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেন্টস (আইওএম)-এর মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান প্রবীণা গুরুং বলেন, ‘‘টাকা শোধ করতে মহাজনদের চাপে দেশে ফিরেও অনেক অভিবাসী বাড়িতে থাকেত পারেন না৷ অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থতা, সামাজিক অন্তর্ভূক্তি ও মানসিকভাবে ভোগান্তির কারণে পুনরায় অনিরাপদ অভিবাসনের দিকে ধাবিত হন অনেকে৷ কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেন৷''
ইউরোপে বাংলাদেশিদের আশ্রয় পাওয়ার হার বাড়ছে
ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান বিষয়ক সংস্থা ‘ইউরোস্ট্যাট’-এর গত ১০ বছরের হিসেব বলছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদন সফল হওয়ার হার বাড়তির দিকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. de Sakutin
তিন ধরনের সুরক্ষা
শরণার্থী, হিউম্যানিটারিয়ান ও সাবসিডিয়ারি – এই তিন ক্যাটাগরিতে আশ্রয় দেয়া হয়ে থাকে৷ যাঁরা শরণার্থী স্ট্যাটাসের যোগ্য নন, কিন্তু দেশে ফিরে গেলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ার ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের সাবসিডিয়ারি সুরক্ষা দেয়া হয়৷ আর অসুস্থতা ও অভিভাবকহীন শিশুদের মানবিক (হিউম্যানিটারিয়ান) বিবেচনায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/R. Schlesinger
২০১৭
বাংলাদেশি নাগরিকদের পক্ষ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গতবছর ১৬,০৯৫টি আশ্রয়ের আবেদন পড়েছে৷ আর একই সময়ে বাংলাদেশিদের করা ২,৮৩৫টি আবেদন সফল হয়েছে৷ শতকরা হিসেবে সেটি ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ৷ জার্মানিতে আবেদন পড়েছে ২,৭২৫টি৷ সফল হয়েছে ৩১৫টি৷ এমনিভাবে অন্য কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান এরকম – যুক্তরাজ্য (আবেদন ১,৬৩০; সফল ৬৫), ইটালি (আবেদন ৫,৭৭৫; সফল ১,৮৮৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৪,১১৫; সফল ৪৪০)৷
ছবি: imago/Cronos
২০১৬
বাংলাদেশিরা ১৪,০৮৫টি আবেদন করেছেন৷ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে ২,৩৬৫টি৷ অর্থাৎ সফলতার হার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ৬৬৫; সফল ১১০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ১,৪০৫; সফল ৮০), ইটালি (আবেদন ৬,২২৫; সফল ১,৬১০) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৪,১১০; সফল ৪৪০)৷
ছবি: picture alliance/dpa/D. Kalker
২০১৫
সেবছর সফলতার হার ছিল ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ৷ আবেদন পড়েছিল ১১,২৫০টি৷ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ১,৭৮৫টি৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ২৬৫; সফল ৩৫), যুক্তরাজ্য (আবেদন ১,০১৫; সফল ১২০), ইটালি (আবেদন ৫,০১০; সফল ১,২২৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৫৬০; সফল ৩১৫)৷
ছবি: Imago/Frank Sorge
২০১৪
আবেদন ৭,৫৮০টি৷ সফল ৭৮৫৷ শতকরা হার ১০ দশমিক ৩৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ৪৬৫; সফল ৫০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৭০০; সফল ৭৫), ইটালি (আবেদন ৭৩৫; সফল ৩১৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৮৭০; সফল ২৬৫)৷
ছবি: Megan Williams
২০১৩
সফলতার হার ৭ দশমিক ১ শতাংশ৷ আবেদন ৮,৩৩৫৷ সফল ৫৯৫৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ২৫০; সফল ২০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৮৩০; সফল ৫৫), ইটালি (আবেদন ৫৯০; সফল ৩০০) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৬১৫; সফল ১৪৫)৷
ছবি: picture alliance/robertharding/A. Robinson
২০১২
সফলতার হার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ১৯০; সফল ১০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৮০০; সফল ৫০), ইটালি (আবেদন ১,৪১০; সফল ১,০৪৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৭৫৫; সফল ৮৫)৷
ছবি: Imago/Rainer Weisflog
২০১১
সফলতার হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ১১০; সফল ০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৪৮০; সফল ৪০), ইটালি (আবেদন ৮৬৫; সফল ৬৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ৩,৭৭০; সফল ৪৫)৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS.com/M. Cohen
২০১০
সফলতার হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ১০৫; সফল ০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৪৬০; সফল ৫৫), ইটালি (আবেদন ২১৫; সফল ৪০) এবং ফ্রান্স (আবেদন ২,৪১০; সফল ২৫)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Uhlemann
২০০৯
সফলতার হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ৪০; সফল ০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৩৭৫; সফল ৪৫), ইটালি (আবেদন ৮৮৫; সফল ৮৫) এবং ফ্রান্স (আবেদন ১,৭৮০; সফল ৩৫)৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. de Sakutin
২০০৮
সফলতার হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ৷ কয়েকটি দেশের পরিসংখ্যান – জার্মানি (আবেদন ৪০; সফল ০), যুক্তরাজ্য (আবেদন ৩৯৫; সফল ৯৫), ইটালি (আবেদন ৯৫০; সফল ৫০) এবং ফ্রান্স (আবেদন ১,৬৬০; সফল ৩৫)৷
ছবি: picture alliance/dpa/D. Kalker
৩২ দেশের হিসাব
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ সদস্যরাষ্ট্র এবং ‘ইউরোপিয়ান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ বা ইএফটিএ-এর অন্তর্ভুক্ত আইসল্যান্ড, লিখটেনস্টাইন, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডের পরিসংখ্যান অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউরোস্ট্যাট৷ আরও পরিসংখ্যান জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷