বাংলাদেশ আগামী ১২ মাস বড় ধরনের জঙ্গি হামলার ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে জানিয়েছে জেন'স৩৬০ ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরটি জার্নাল৷ তবে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের কথায়, ‘‘জঙ্গিদের এখন আর সেই শক্তি নেই৷''
ছবি: picture-alliance/AP
বিজ্ঞাপন
জেনস৩৬০তাদের এক অনলাইন প্রতিবেদনে বলছে যে, ২০১৬ সালের পর বাংলাদেশে দুর্বল হয়ে পড়লেও জঙ্গিরা আবারো ব্যাপক হামলা এবং আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে বাংলাদেশে৷ ভবিষ্যতে তারা ছোট ছোট হামলার ঝুঁকিতে না গিয়ে পরিবর্তে বড় আকারের হামলা চালাতে পারে৷ আর তাদের এই হামলায় সিকিউরিটি ফোর্স এবং বিদেশিরা টার্গেট হতে পারে৷ শুধু তাই নয়, তারা আত্মঘাতী হামলার পাশাপাশি ইমপ্রোভাইস্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ব্যবহার করতে পারে৷ আগামী একবছর বাংলাদেশ তাই জঙ্গি হামলার ঝুঁকির মধ্যে আছে৷
হোলি আর্টিজান হামলার পর বাংলাদেশে জঙ্গি বিরোধী অভিযান নতুন মাত্রা পায়৷ নব্য জেএমবি-র তামিম চৌধুরী, সরোয়ার জাহান মানিক, মারজানসহ ৬৮ শীর্ষ জঙ্গি নিহতও হয়৷ কম-বেশি ২২টি বড় আকারের জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে দেশে৷ এ সব অভিযানে জঙ্গি নেতা মাওলানা আবুল কাসেম, জাহাঙ্গির আলম গান্ধি এবং সোহেল মাহফুজ ধরা পড়ে৷
’বড় ধরনের কোনো থ্রেট এখনো নেই’
This browser does not support the audio element.
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নব্য জেএমবি-র মজলিসে শুরার অধিকাংশ সদস্য হয় ধরা পড়েছে, নয় নিহত হয়েছে৷ তাদের চেইন অফ কমান্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে৷ আমরা মনে করি না যে, তারা সংগঠিত হয়ে নতুন করে বড় ধরনের কোনো হামলা চালাতে পারবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট করে দেখছি এবং তাতে আমাদের সামনে বড় ধরনের কোনো থ্রেট এখনো নেই৷ সে কারণে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা এবং কোনো বড় রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় আলাদা করে বাড়তি নিরাপত্তার প্রশ্ন দেখা যায়নি৷''
সাইফুল্লাহ ওজাকির মাধ্যমে দেশের বাইরে বাংলাদেশি জঙ্গিরা সংগঠিত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘‘২০১৫ সালের পর তার আর কোনো খোঁজ আমাদের কাছে নাই৷ এর আগে তার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক ইরাক ও সিরিয়া গেছে৷''
সাইফুল্লাহ ওজাকির ব্যাপারে জঙ্গি বিষয়ক সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাইফুল্লাহ ওজাকি একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম৷ তার আসল নাম সুজিত দেবনাথ৷ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার বাড়ি৷ ২০১৪-১৫ সালে সেজাপানে বসে বাংলাদেশ থেকে যারা আইএস-এ যোগ দিতে ইরাক এবং সিরিয়া গেছেন, তাদের ওই দুই দেশে যেতে সহায়তা করেছিল৷''
‘নির্বাচনের আগে জঙ্গিরা একটা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে’
This browser does not support the audio element.
ওজাকি এখন কোথায় আছে তা এই দু'জনের কেউ জানাতে না পারলেও নুরুজ্জামান লাবু বলেন, ‘‘এই সময়ে আটক হওয়া জঙ্গিদের সঙ্গে আইএস-এর ভার্চুয়াল যোগাযোগ এখনো স্পষ্ট৷ তারা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে সিক্রেট আইডি-র মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে৷ তারা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় আছে৷''
হোলি আর্টিজান হামলার পর ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জঙ্গিদের কোনা তৎপরতা চোখে পড়েনি৷ তারা গ্রেপ্তারও হয়নি৷ নুরুজ্জামান লাবু বলেন, ‘‘এরপর যারা ধরা পড়েছে, তারা স্বীকার করেছে যে ওই সময়ে তারা নতুন করে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল৷ নতুন করে তাদের রসদ সংগ্রহ করছিল৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘গোয়েন্দারা সরাসরি স্বীকার না করলেও নানা সূত্রের সঙ্গে কথা বলে আমি জানতে পেরেছি যে আগামি নির্বাচনের আগে জঙ্গিরা আবারো একটা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে৷ তারা হামলা চালাতে পারে৷ আর সে কারণে আগামী এক বছর জঙ্গি হামলার ঝুঁকি থাকছে বাংলাদেশে৷''
হোলি আর্টিজান হামলার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় জঙ্গিদের আত্মঘাতী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে৷ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আত্মঘাতী হামলার চেষ্টাও হয়েছে৷ তাই নতুন হামলা হলে তার মধ্যে যে এই প্রবণতা থাকবে না, তা বলা যায় না৷
জঙ্গি নেতা মেজর জিয়াসহ আরো কিছু শীর্ষ জঙ্গি এখনো ধরা পড়েনি৷ তাছাড়া জঙ্গিরা নিজস্ব উৎস থেকে বোমা বিস্ফোরক সংগ্রহেরও চেষ্টা করছে বলে জানা যায়৷ যদিও বলা হচ্ছে তাদের অর্থ এবং অস্ত্রের সাপ্লাই লাইন বন্ধ হয়ে গেছে৷ মনিরুল ইসলাম অবশ্য বলেন, ‘‘মেজর জিয়া জেএমবি-র কেউ নয়৷ সে আনসার আল-ইসলামের সদস্য৷ নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করার মতো কেউ আছে বলে আমরা মনে করি না৷''
স্তম্ভিত করে দেয়া গুলশান হামলা
ঘটনাটি কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়, আলোড়ন উঠেছিল দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে৷
ছবি: bdnews24.com
গুলশানে হামলা
বিশ্ব মানচিত্রে পরস্পরের সঙ্গে লাগোয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ অর্ধ শতাব্দী পূর্বে স্বাধীন হয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনায়৷ দেড় দশক ধরে নানা জায়গায় মুসলিম জঙ্গিবাদ ছড়ালেও খানিকটা যেন নিরাপদেই ছিল দেশটি৷ রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল৷ তার অনেকগুলোতে জঙ্গিদের ব্যবহারের কথাও তদন্তে উঠে আসে৷ তবে ঘোষণা দিয়ে বড় ধরণের হামলা আর হয়নি৷ এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছে গোটা দেশ৷
ছবি: bdnews24.com
যেভাবে শুরু
তখন ছিল রমজান৷ ঘটনার দিন ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে একদল অস্ত্রধারী গুলশানের একটি রেস্টুরেন্ট ঢুকে পড়ে৷ স্প্যানিশ ওই রেস্টুরেন্টটির নাম হোলি আর্টিজান৷ ঢোকার সময়ই তারা বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে৷
ছবি: bdnews24.com
জিম্মি দশা
অস্ত্রধারীরা রেস্টুরেন্টে ঢোকার পর সেখানে জিম্মি সংকট শুরু হয়৷ বাইরে চলে নানা গুজব৷ হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন রেস্টুরেন্টকর্মী বের হয়ে আসতে সক্ষম হন৷ বাংলাদেশে এর আগে ১৯৭৭ সালে ঢাকায় আরেকটি জিম্মি সংকট ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়েছিল৷ তখন মুম্বাই থেকে টোকিওগামী একটি জাপানি বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে বিমানটি ঢাকায় নামিয়েছিল দেশটির বামপন্থি বিদ্রোহী দল ‘ইউনাইটেড রেড আর্মি’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
কোথায়
অবস্থানগত কারণেও এই ঘটনা আলোচনায় ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে৷ কারণ, রেস্তোরাঁটি ঢাকার গুলশান এলাকায়৷ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস রয়েছে এই এলাকায়৷ কয়েকটি দূতাবাস তো রেস্টুরেন্টের একেবারেই কাছে৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press Agency/M. Hasan
টার্গেট বিদেশি, টার্গেট হোলি আর্টিজান
ঢাকার অভিজাত এই এলাকার রেস্টুরেন্টটিতে পোষা প্রাণী নিয়ে প্রবেশ করা যেতো৷ এর ভেতরে উন্মুক্ত লন ছিল, সেখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করতে পারতো৷ ওই এলাকায় থাকা বিদেশিদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল রেস্টুরেন্টটি৷ বিদেশিদের টার্গেট করতেই এই রেস্টুরেন্টকে বেছে নেয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন৷
ছবি: bdnews24.com
প্রাণহানি পুলিশেরও
জিম্মি সংকট শুরুর পর ঘটনা সামলাতে এগিয়ে যায় পুলিশ বাহিনী৷ কিন্তু প্রথম দিকেই জঙ্গিদের হামলায় বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম প্রাণ হারান৷ এতে আতঙ্ক আরো বাড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর
পুলিশ হতাহত হওয়ার পর অভিযান নিয়ে নতুন করে চিন্তা শুরু হয়৷ এক পর্যায়ে জঙ্গিদের কবল থেকে ওই রেস্টুরেন্টটি মুক্ত করার অভিযান রাতে কার্যত স্থগিত হয়ে যায়৷ শেষ পর্যন্ত ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর৷ সাঁজোয়া যান নিয়ে সেনা সদস্যরা অভিযান পরিচালনা করেন৷
ছবি: bdnews24.com
আইএস সংশ্লিষ্টতা
রাতে জিম্মি দশা চলাকালে তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আইএস হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর আসতে থাকে৷ তবে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তা অস্বীকার করে৷
ছবি: Reuters/A.Konstantinidis
কিভাবে ঘটনার শেষ
ঘটনার অবসান হয় প্রায় ১২ ঘণ্টা পর সেনা অভিযানে৷ অবশ্য তার আগেই জঙ্গিরা সেখানে থাকা ২০ জনকে খুন করে৷ মরদেহ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারির জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে৷ জীবিত উদ্ধার করা হয় এক জাপানি ও দুই শ্রীলঙ্কানসহ মোট ১৩ জনকে৷
ছবি: bdnews24.com
আলোচিত সেই বাড়ি
ঘটনার পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় গুলশানের সেই বাড়ি৷ যে রেস্টুরেন্টে হামলা হয়েছিল, তার মালিক ঘটনার পর বাড়িটি ফিরিয়ে নেন৷
ছবি: bdnews24.com
নতুন ঠিকানায় হোলি আর্টিজান
গত বছরের ১ জুলাই রাতে যখন হামলা হয়, তখন হোলি আর্টিজান ছিল গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর বাড়িতে৷ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর জানুয়ারিতে এসে গুলশান এভিনিউর র্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় নতুন করে চালু হয় রেস্টুরেন্টি৷
ছবি: bdnews24.com
জঙ্গিবাদ ও বিচার
এই ঘটনার পর আইএস দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার এর জন্য স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পুনর্গঠিত একটি শাখাকে দায়ী মনে করে৷ ঘুরে ফিরে এর সঙ্গে জড়িত হিসাবে একই ব্যক্তিদের নাম আসতে থাকে৷ সরকার তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করে৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর আগাম পদক্ষেপে তাদের বহু ঘাঁটি ও অবস্থানস্থল ধ্বং হয়ে গেছে৷ সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এই ঘটনার তদন্ত শেষ করতে ৫ ব্যক্তিকে খোঁজা হচ্ছে৷