লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার রক্তক্ষরণ বন্ধ করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ৷ তার অবস্থা স্থিতিশীল, তবে ফের রক্তক্ষরণ হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ডা. ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী৷
বিজ্ঞাপন
গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসভবনে রোববার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই আশঙ্কার কথা জানান৷ সংবাদ সম্মেলনে আরো কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরাও উপস্থিত ছিলেন৷
ডা. ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার পরিপাকতন্ত্রে এ পর্যন্ত দুইবার রক্তক্ষরণ হয়েছে৷ তারা তাদের সর্বাত্মক চেষ্টায় তা বন্ধ করেছেন৷ কিন্তু তারা এই রক্তক্ষরণের পয়েন্ট নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছেন৷ এখানে তা নির্ণয় সম্ভব নয়৷ আর সেটা নির্ণয় এবং স্থায়ীভাবে রক্তক্ষরণ বন্ধের যে পদ্ধতি, তা বাংলাদেশে কেন এই উপমহাদেশেই নেই৷ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির কিছু হাসপাতালে এই সুবিধা রয়েছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার নতুন করে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা আছে৷ সেই আশঙ্কা পর্যায়ক্রমে আরো বাড়বে৷ ফের রক্তক্ষরণ হলে তার মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাবে৷’’
ডা. ফখরুদ্দিন বলেন, ‘‘আমরা আগে থেকেই খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নেয়ার কথা বলছি৷ এখন তার অবস্থা স্থিতিশীল আছে৷ তবে যদি এখনই বিদেশে নেয়া না হয় তাহলে হয়তো তার অবস্থা বিদেশে নেয়ার মতো নাও থাকতে পারে৷ তাকে মুভমেন্ট করানো অসম্ভব হয়ে যেতে পারে৷’’
ডা. ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘চার মাস আগে যদি তিনি বিদেশে যেতে পারতেন তাহলে এই লাইফ থ্রেটেনিং ব্লিডিংটা ওনাকে ফেস করতে হতো না৷ আমরা এই ব্যাপারটাকে ভয় পেয়েই বারবার বলছিলাম যে একটা সময় আসবে...সে কারণেই আমরা বলেছি যে ওনার পয়েন্টটা টেকনোলজি ব্যবহার করতে হবে যেটা বাংলাদেশে কেন আশেপাশেও সম্ভব না৷’’
বাংলাদেশে ওইসব দেশ থেকে চিকিৎসক বা চিকিৎসা সুবিধা আনা সম্ভব কীনা, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা সম্ভব নয়৷ যুক্তরাষ্ট্রে কারো এই সমস্যা হলে তাকে হেলিকপ্টারে করে সেই সেন্টারে নেয়া হয়৷ তাহলে বুঝতেই পারছেন সেটা এখানে নিয়ে আসা কীভাবে সম্ভব৷’’
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার আরেকজন চিকিৎসক অধ্যাপক শামসুল আরেফিন উন্নত বিশ্বে এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন৷ আরো ছিলেন অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম মোহসীন, অধ্যাপক ডা. নুরুদ্দিন৷
ডা. ফখরুদ্দিন বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৫.৫-এ নেমে গিয়েছিলো৷ এখন সেটা ৭-৮ এর মধ্যে আছে৷ একই সঙ্গে তার হার্ট ও কিডনির সমস্যা আছে৷ তার পুরনো আরো কিছু শারীরিক জটিলতা আছে৷’’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমরা খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়েই বেশি মনোযোগী ছিলাম৷ তাই এতদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হইনি৷ তবে আমরা খালেদা জিয়ার পরিবারকে আপডেট ও করণীয় সম্পর্কে যথাসময়ে জানিয়েছি৷ আর অনেক কিছু প্রকাশ্যে বলা ঠিকও না৷’’
আজকের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে গতকালই খালেদা জিয়ার অনুমতি নিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷
ডা. ফখরুদ্দিন জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন৷ সেখানে তাদের সহকর্মীরাও আছেন৷
খালেদা জিয়ার চার বছর
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাজাপ্রাপ্ত হন খালেদা জিয়া৷ এরপর থেকে তিনি কারাগার, হাসপাতাল ও বাসায় আছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
মামলার রায়
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত৷ একই মামলায় তারেক রহমানসহ অন্য আসামিদের ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ পরে আপিলে খালেদার কারাদণ্ডের মেয়াদও বেড়ে ১০ বছর হয়৷ সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ৩ জুলাই ঢাকার রমনা থানায় মামলাটি করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন৷ ছবিতে খালেদা জিয়াকে আদালতে যেতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
অভিযোগপত্রে যা বলা হয়েছিল
১৯৯১ সালে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে এতিমদের সহায়তায় গঠিত ‘প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে’ চার কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা জমা হয়েছিল৷ কিন্তু ১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঐ অর্থ দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো এতিমখানায় দেয়া হয়নি৷ পরে ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ গঠন করে সেখানে দুই কোটির বেশি টাকা ট্রান্সফার করে সেটা আসামিরা আত্মসাত করেন বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
রায় ঘোষণার দিনটি যেমন ছিল
পুরো রাজধানীতে পুলিশের সতর্ক পাহারা ছিল৷ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, হাইকোর্ট ও বকশিবাজারে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল৷ দুপুর ১২টায় গুলশানের বাসা থেকে বকশিবাজারের আদালতের উদ্দেশ্যে রওনা হন খালেদা জিয়া৷ পথে কাকরাইল ও চাঁনখারপুলে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়৷ এই সময় বিএনপির বেশ কয়েকজন কর্মীকে আটক করা হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আদালত থেকে কারাগারে
রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়াকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ২০১৬ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ঐ কারাগারটিকে ‘সাবজেল’ ঘোষণা করেছিল সরকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
কারাগার থেকে হাসপাতালে
চিকিৎসকদের পরামর্শে ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল৷ সেখানে টানা এক মাস দুই দিন চিকিৎসা নেয়ার পর ৮ নভেম্বর তাকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
বিএসএমএমইউতে যেতে আপত্তি
২০১৯ সালের ১০ মার্চ খালেদার চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউ প্রস্তুত করা হয়েছিল৷ কিন্তু তিনি সেখানে যেতে রাজি হননি৷ খালেদা জিয়াকে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার দাবি জানিয়েছিল বিএনপি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ANN/The Daily Star
অবশেষে আবারও বিএসএমএমইউ
কারাগারে অসুস্থ হওয়ায় ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন৷
ছবি: Bdnews24.com
আবারও কারাদণ্ডের রায়
২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াসহ চার জনকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলাটি করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন৷ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ আনা হয় মামলায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Jahan
অবশেষে মুক্তি
শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পেয়ে ২৫ মাস কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তি পান খালেদা জিয়া৷ একদিন আগে খালেদাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক৷ শর্ত হলো এই সময়ে খালেদাকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে৷ তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না৷
ছবি: bdnews24
নির্বাহী আদেশে মুক্তি
খালেদা জিয়ার বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিয়েছেন বলে সেই সময় জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের৷
ছবি: Asif Mahmud Ove
চার দফা সময় বৃদ্ধি
২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়া হয়েছিল৷ এরপর চার দফায় তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়৷ ছবিতে খালেদা জিয়ার বাড়ি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/S. Hossain
এটা এখন আইনের ব্যাপার: প্রধানমন্ত্রী
১৭ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘খালেদা জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি এটাই কি বেশি নয়?’’ তিনি বলেন, ‘‘আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার, সেটুকু আমি দেখিয়েছি৷ ... এখানে আমার কিছু করার নাই৷ আমার যেটা করার, আমি করেছি৷ এটা এখন আইনের ব্যাপার৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
স্মারকলিপি
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে স্মারকলিপি দেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা৷
ছবি: bdnews24
তিনবার হাসপাতালে
২০২০ সালের মার্চে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এ নিয়ে তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন খালেদা জিয়া৷ এর মধ্যে গত এপ্রিলে তিনি করোনা ভাইরাসেও আক্রান্ত হয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
খালেদা কী অসুখে ভুগছেন
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘খালেদা জিয়া এখন ক্রনিক কিডনি ডিজিজে যেমন ভুগছেন তেমনি ক্রনিক লিভার ডিজিজেও ভুগছেন৷ এখন তার লিভারের সমস্যা বেশি হচ্ছে৷ যার কারণে জিআই (পরিপাকতন্ত্র) ব্লিডিং বেশি হচ্ছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার আগে থেকেই আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস আছে৷ আর রাইট হার্ট ফেইলিউরসহ আরো কিছু শারীরিক অসুস্থতা বা জটিলতা আছে৷’’
ছবি: Bdnews24.com
স্লো পয়জনিং?
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘...একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে দুই বছরের বেশি সময় আটক রাখা হয়েছিল৷ পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি৷ এখন অনেকের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সেই সময়ে খালেদা জিয়াকে কোনো স্লো পয়জনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না, আমরা পরিষ্কার করে জানতে চাই৷’’
ছবি: Asif Mahmud Ove
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সংবাদ সম্মেলন
খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী৷ এরপর বুধবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘‘আমি এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে খালেদা জিয়াকে দেখে এসেছি৷ যা দেখেছি, সাম্প্রতিককালে এত মর্মান্তিক ঘটনা আমি দেখিনি৷ খালেদা জিয়া কতক্ষণ, কয় দিন, কয় মিনিট বাজবেন, তা আমি বলতে পারব না৷ এটা বলতে পারি, তিনি ক্রান্তিকালে আছেন, তাকে হত্যা করা হচ্ছে৷’’
ছবি: DW/S. Hossain
17 ছবি1 | 17
প্রসঙ্গত, গত ১৩ নভেম্বর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর সেদিন রাত থেকে খালেদা জিয়াকে সিসিইউ বা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে৷
দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়৷ ২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরেন৷