পরমাণু চুক্তি নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানালো অ্যামেরিকা। ইউরেনিয়াম মজুত আরো বাড়ানোর হুমকি ইরানের।
বিজ্ঞাপন
রোববার ইরান জানিয়েছিল, দেশের পরমাণু-কেন্দ্রে জাতিসংঘের নজরদারি বন্ধ করা হবে। সোমবার দেশের সুপ্রিম নেতা টেলিভিশনে জানিয়েছেন, প্রয়োজনে ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম মজুত করবে। এবিষয়ে বিশ্বের কোনো দেশের বাধাই তারা মানবে না। অন্যদিকে, অ্যামেরিকা জানিয়েছে, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি নিয়ে অ্যামেরিকা আশাবাদী। পরমাণু চুক্তি আরো শক্তিশালী করতে চায় অ্যামেরিকা। তবে ইরানের খায়মখেয়ালি পদক্ষেপ মার্কিন প্রশাসন মেনে নেবে না। ইরান যাতে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকবে অ্যামেরিকা।
সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘের একটি বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। সেখানে তিনি জানান, অ্যামেরিকা চায় পরমাণু চুক্তি আরো জোরদার এবং শক্তিশালী হোক। পরমাণু চুক্তিতে নতুন করে যোগ দেওয়ার বিষয়ে অ্যামেরিকা আশাবাদী। কিন্তু একই সঙ্গে ইরানের হঠকারী পদক্ষেপকে অ্যামেরিকা সমর্থন করে না। ইরান যেভাবে পরমাণু অস্ত্র এবং ব্যালেস্টিক মিসাইল তৈরির হুমকি দিচ্ছে, অ্যামেরিকা তা বরদাস্ত করে না। ইরান যাতে কোনো ভাবেই ওই ধরনের অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, অ্যামেরিকা তা নিশ্চিত করবে।
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
7 ছবি1 | 7
ইরানও অবশ্য অ্যামেরিকার চোখরাঙানিকে পাত্তা দিচ্ছে না। সোমবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা টেলিভিশনে বলেছেন, প্রয়োজনে ইরান ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম মজুত করবে। এই মুহূর্তে তারা ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম মজুত করছে। পরমাণু অস্ত্র তৈরির যা যা যথেষ্ট। ২০১৫ সালের চুক্তিতে বলা হয়েছিল ইরান চার শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম মজুত করতে পারবে না। ইরানের পার্লামেন্ট গত বছরের শেষে সেই নিয়মের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনে। নতুন আইন তৈরি হয়। যাতে বলা হয়, ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম মজুত করা হবে।
ওই একই আইনে বলা হয়েছিল, তিনমাসের মধ্যে পরমাণু চুক্তি এবং ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অ্যামেরিকা যদি স্পষ্ট সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে দেশের পরমাণু কেন্দ্রগুলিতে জাতিসংঘের নজরদারি বন্ধ করে দেওয়া হবে। ২১ তারিখ সময়সীমা শেষ হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিনিধির সঙ্গে রোববার ইরানের দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। সেখানে একটি সাময়িক সমাধানসূত্র তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু অ্যামেরিকাকে এবার পরমাণু চুক্তি নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। নিজেদের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সোমবার মার্কিন বিদেশমন্ত্রী সে কাজেরই সূচনা করলেন।
বস্তুত, ইউরোপেরএকাধিক দেশ চাইছে, অ্যামেরিকা পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসুক। ইরানের সঙ্গে যে দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে তার অবসান হোক। ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পরেই এই সমস্যার শুরু হয়েছিল। বাইডেন প্রথম থেকেই সমস্যাটির সমাধানে আগ্রহী। কিন্তু ইরান যেভাবে একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে, তাতে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।