1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ফেসবুকে উসকানিতে নতুন মাত্রা

আজিজ হাসান
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামের দুই পরিবার বা পক্ষের মধ্যে ঝামেলা হলে কোনো কোনো ব্যক্তি গোপনে তার একটি পক্ষ আবার কখনো কখনো দুই পক্ষকেই তাদের মনমতো কথা বলে সংঘর্ষ লাগিয়ে দিতেন৷

Symbolbild Fake-News-Untersuchung in Facebook
ছবি: picture-alliance/empics/D. Lipinski

এরপর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম তখন একটি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের অধিকারের নানা বিষয় নিয়ে আন্দোলনে ছিলাম৷ এমন হয়েছে পাঁচ-সাত দিন ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যখন আন্দোলন একটি রূপ পেয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে তখন কয়েকজন আমাদের সঙ্গে কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে সহিংস কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়েছে৷

এমনই একটি আন্দোলন ছিল অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভ৷ বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে বাংলা একাডেমির কাছেই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছিল এই লেখক-অধ্যাপককে৷

তার ওপর হামলার পরপরই মিছিলের আওয়াজ শুনে হল থেকে বেরিয়েছিলাম দৌড়ে৷ সেই মিছিলে ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ কর্মী মলয়ের গগণবিদারী স্লোগান এখনো আমার মনে পড়ে৷ ওই রাতের মিছিল শেষে পরদিন ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়৷ হলে ফিরে যখন রুমে রুমে গিয়ে প্রথম বর্ষের বন্ধুদের ঘটনা বলে পরদিনের কর্মসূচিতে আসতে বলছিলাম তখন একটি রুমে গিয়ে বিপদে পড়ে যাই৷ ক্ষমতাসীন বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতারা তখন হলের নিয়ন্ত্রক৷ ছাত্রদলের এক নেতা রাগের সুরে বললেন, ‘স্যারকে কুপিয়েছে৷ রক্ত ম্যানেজ করো, তার চিকিৎসা নিয়ে কী করা যায় ভাবো৷ এখানে মিছিল করতে হবে কেন?'

এরপর সেই রাতে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড লেখা শেষে হলে ফিরে পরদিন প্রতিবাদে গিয়েছিলাম৷ কর্মসূচিতে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ এবং তাদের বিক্ষুব্ধ চেহারা আমাকে সাহস জুগিয়েছিল, অনুপ্রাণিত করেছিল আন্দোলন জোরদারে সম্ভাব্য সবকিছু করতে৷ এরপর বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর আয়োজনে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে চলতে থাকে ধারাবাহিক কর্মসূচি৷ এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি নিয়ে মিছিল সহকারে সচিবালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়ার৷

নির্ধারিত সময় অনুযায়ী প্রায় হাজার দুয়েক শিক্ষার্থীর মিছিল নিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম সচিবালয়ের দিকে৷ দোয়েল চত্বর দিয়ে হাইকোর্টের ফটকের কাছে গেলে ব্যারিকেড দিয়ে আমাদের আটকে দেয় পুলিশ৷ সে সময় ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্র ফেডারেশনের শীর্ষ নেতারা মিছিলের সামনে থেকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন৷ তাঁরা বার বার আমাদের বারণ করছিলেন সহিংস কোনো আচরণ না করতে৷ এরমধ্যে রাস্তার পাশে থাকা ফুলের দোকানগুলো থেকে টব নিয়ে তা পুলিশের দিকে ছুড়তে শুরু করেন কয়েকজন যুবক, তাদের কয়েকজনকে আমি চিনেছিলাম, তাঁরা সে সময় ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন৷

ফুলের টবের জবাবে টিয়ার শেল ও লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসে কয়েকশ পুলিশ৷ তাদের এলোপাতাড়ি পিটুনির মুখে আমরা যে যার মতো করে পালাতে থাকি৷ ছাত্র ইউনিয়নের জ্যেষ্ঠ কর্মীদের সহায়তায় সেদিন মার খাওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম আমি৷ তবে আমার সেই বন্ধু মলয়, বাগেরহাটের একটি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা শীর্ণকায় চেহারার ফরসা তরুণটি গুরুতর আহত হয়েছিলেন৷ পিটুনিতে পড়ে গেলে পা দিয়ে মাড়ানো হয়েছিল তাকে৷ পুলিশের বুটের আঘাতে নাড়ি ছিঁড়ে যায় তার৷ ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়ে মলয় আবার ফিরে আসে আমাদের মাঝে৷ পুলিশের ওই আক্রমণের মধ্য দিয়ে সে সময় শেষ হয়ে যায় আমাদের আন্দোলন৷

প্রতিপক্ষকে উসকে দিয়ে আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে নেওয়ার এই ঘটনায় তখন বেশ বিস্ময় জাগিয়েছিল আমার মধ্যে৷

তবে উসকানির এসব কিছুই ছাপিয়ে যায় গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায়৷ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার কথা ছড়িয়ে উত্তরের জনপদে থানা, হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলার ঘটনায় শিহরিত হয়েছিলাম৷

এরপর ফেসবুকে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে অশিক্ষিত মৌলবাদী গোষ্ঠীকে উসকে রাতের অন্ধকারে ধ্বংস করা হয়েছে কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ পল্লি৷ এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বিদ্বেষপূর্ণ পোস্ট দিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু বসতি৷

এভাবে গ্রামের অশিক্ষিত, ধর্মকাতর মানুষকে উসকানি দিয়ে মৌলবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থান্বেষী কার্যক্রম দেখা গেলেও শহরে মিডিয়ার আলোয় থাকা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিভ্রান্ত হওয়ার ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছি এবার৷

ঢাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুলছাত্রদের আন্দোলনের শুরুর একদিন আগে কাজের সূত্রে এসেছি জার্মানির বন শহরে৷ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন দেখে খুবই খুশি হয়েছিলাম, অন্তত কিছুটা হলেও ঢাকায় চলাচলের অবস্থার উন্নতি হবে ভেবে৷

এরমধ্যে একদিন আমার খুব কাছের একজন মানুষ আমাকে ফোন করে খুব বকলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে কেন আন্দোলনের ‘প্রকৃত অবস্থা' লেখা হচ্ছে না, সে অভিযোগ তুলে৷ বাংলাদেশের এই অনলাইন সংবাদপত্রে দীর্ঘ দিন কাজ করছি আমি৷

সেদিন তার কথায় আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম৷ ভাবছিলাম আমার এতদিনের চেনা এই মানুষটার হঠাৎ কী হল, এমনভাবে বদলে গেলেন কেন তিনি? তখনও কারণটা ধরতে পারিনি৷ পারলাম পরদিন ৫ আগস্ট, বনের অফিস থেকেই ধানমণ্ডিতে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সংঘর্ষের খবর পেলাম৷ তখন তাকে ফোন করি খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য৷

তিনি বাসায় ফিরে আমার ওপর আরো ক্ষোভ ঝাড়লেন৷ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দুজন ছাত্রকে ‘মেরে ফেলেছে' এবং ‘কয়েকজন ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে' বলে ফেসবুকে ছড়ানো গুজব তিনি বিশ্বাস করেছিলেন৷

তার কথা শোনার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ বাংলাদেশি কয়েকটি সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে চোখ বুলিয়ে এ রকম কোনো খবর দেখলাম না৷ তখন বনে আমার বাসার আরেক ভাইয়ের সঙ্গেও এক চোট ঝগড়ার মতো হয়ে যায় খবরটি এখনো বিশ্বাসযোগ্য নয় তা বোঝাতে৷

আজিজ হাসান, ডয়চে ভেলেছবি: DW/A.Hashan

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে বোরকা পরা এক তরুণীর আর্তনাদভরা কণ্ঠে ওই কল্পিত ‘মৃত্যু-ধর্ষণের' খবর শুনে তারা বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন৷ এবং আমাকেও বিশ্বাস করতে জোর করছিলেন৷ কিন্তু একজন পেশাদার সংবাদকর্মী হওয়ার কারণে নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া এই খবর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷

যা-ই হোক পরে প্রকৃত ঘটনায় দেখা গেল সংঘর্ষে কয়েকজন ছাত্র আহত হয়েছিলেন৷ ছাত্রীদের ধরে নেওয়ার কোনো অভিযোগও কারো পরিবার থেকে আসেনি৷ অথচ ঘটনার মধ্যে দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষকে মিথ্যা একটি খবর বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিলেন বোরকাধারী নারী৷ শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে সবাইকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি৷

তাঁর কথায় যারা বিশ্বাস করেছিলেন তারা সবাই রাস্তায় নামলে কী হত সেদিন ঢাকার অবস্থা, তা এখন ধারণাও করা যাবে না৷ ফেসবুকে ছড়ানো গুজব কী পরিমাণ প্রভাব ফেলেছিল, তা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম ছোট ভাই বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা খালিদ মারুফের একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে৷ ‘‘সব প্রেতে পরিণত হয়েছে৷ অধ্যাত্ম-বস্তু এমনকি প্রথম আলোতেও তারা আর বিশ্বাস রাখছে না, কেবল বলছে, ‘ফেসবুকে দেখলাম, ফেসবুকে শুনলাম৷','' লিখেছিলেন তিনি৷

মানুষকে উসকে দিতে এভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচার আরও বাড়তে থাকলে তা যে কোনো সময় যে কারো জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷

সাম্প্রতিক এক আলোচনা সভায় সে বিষেয় আরো বিস্তারিত বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী৷ ‘‘দুর্যোগ আসার উপক্রম হলে বা দুর্যোগ আঘাত হানলে ভুল তথ্য ভয়ংকর ফল ডেকে আনতে পারে,'' সতর্ক করেছেন তিনি৷

তাঁর এই কথার সূত্র ধরেই বলতে চাই, কোনো পক্ষের উসকানিতে কারো বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে একটু ভাবুন, তথ্যটি নির্ভরযোগ্য ও দায়িত্বশীল কোনো সূত্র থেকে যাচাই করুন৷ তাহলে অপরের বিপদ ঘটানো থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি নিজেকেও বিপদে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন৷  

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ