ভারতের সহায়তায় রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পথে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ সরকার৷ সুন্দরবনের খুব কাছে প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে অ্যাক্টিভিস্টদের আন্দোলনও অব্যাহত রয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
গত কয়েকবছর ধরেই পরিবেশবিদদের অনেকে এবং অ্যাক্টিভিস্টরা দাবি করে আসছেন, সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলে তা ধীরে ধীরে সুন্দরবনকে ধ্বংস করে দেবে৷ তাদের এই দাবির পক্ষে, বিপক্ষে নানা রকম তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে৷ আর এই আলোচনার এক বড়ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ফেসবুক৷
বর্ষায় আরো সুন্দরী সুন্দরবন
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ বা শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন৷ এই বনের প্রধান গাছটির নাম সুন্দরী৷ আর তার থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ৷ ঋতুতে ঋতুতে এ বনের চরিত্র বদলায়৷ তবে সুন্দরবন সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বর্ষাকালে৷
ছবি: DW/M. Mamun
‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দিলাম মেপে’
বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে সুন্দরবনে বর্ষা আসে মে মাসে আর সেই বর্ষাকাল চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত৷ অবশ্য জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত এখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়৷ সুন্দরবন অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৬৪০-২০০০ মিমি৷ তবে বনের পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
দিনে দু’বার জোয়ার-ভাটা
প্রতিদিন দু’বার করে জোয়ার-ভাটা হয় সুন্দরবনে, যা কিনা বাংলাদেশ ও ভারত – প্রতিবেশী এই দুই দেশের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত৷ এখানে সবচেয়ে বড় জোয়ার হয় পূর্ণিমা ও অমাবস্যায়৷ তবে বর্ষাকালে জোয়ারের উচ্চতা থাকে সবচেয়ে বেশি৷ এ সময় বনের বেশিরভাগ অংশই প্লাবিত হয়, ডুবে যায় সবকিছু৷
ছবি: DW/M. Mamun
খাবারের সন্ধানে হরিণসাবক
জোয়ারের পানিতে সুন্দরবন প্লাবিত হলে হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাগুলোয় আশ্রয় নেয়৷ এরপর জোয়ারের পানি নেমে গেলে খাবারের সন্ধানে নেমে পড়ে তারা৷ আর ঠিক সেই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন বহু পর্যটক – বন্যপ্রাণী দেখবেন বলে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্ষার জন্য বিশেষ ‘প্যাকেজ’
বর্ষায় সুন্দরবনে পর্যটকের আনাগোনা বেশ কম৷ এ বনে পর্যটনের মৌসুম মূলত নভেম্বর থেকে মার্চ৷ তবে বর্ষার সুন্দরবনকে দেখতে কিছু কিছু ভ্রমণপিয়াসী মানুষ এখানে আসেন বটে৷ আর সেই সব পর্যটকদের চাহিদার কারণেই সম্প্রতি দু-একটি বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা বর্ষাকালে সুন্দরবন ভ্রমণের ব্যবস্থা করছে, দিচ্ছে বিশেষ ‘প্যাকেজ’৷
ছবি: DW/M. Mamun
তারপরেও পরিত্যক্ত বহু এলাকা
বর্ষা মৌসুমে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের একটি পর্যটক ট্রেল৷ এ সময়ে পর্যটকের যাতায়াত না থাকায় এই হাঁটা পথের ওপরে জমা হয়েছে বিভিন্ন গাছের ফল৷ আসলে ম্যানগ্রোভ অরণ্য হলেও, বেশ কিছু ফল গাছও আছে সুন্দরবনে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সুন্দরী বন সুন্দরবন
জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ভেসে আসে এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী গাছের ফল৷ ভেসে যায় আশেপাশের কোনো এলাকায়৷ তবে সুন্দরী গাছের বন সুন্দরবনে এমন একটা দৃশ্যের দেখা পাওয়া যায় কেবলমাত্র বর্ষাকালে৷
ছবি: DW/M. Mamun
জঙ্গলের বিস্তার, সুন্দরেরও
জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা সুন্দরী ফলের অংশ বিশেষ ভাটার সময় জঙ্গলে থেকে যায়৷ তারপর সেখান থেকেই অঙ্কুর গজায়, গাছ হয়, ফুল ফোটে, ফল দরে৷ এভাবেই বিস্তার ঘটে সুন্দরী গাছ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের৷ প্রকৃতির এ নিয়মেই বেড়ে উঠেছে সুন্দরবনের বেশিরভাগ বনাঞ্চল৷
ছবি: DW/M. Mamun
সুন্দরবনের বানর
সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা বানর৷ ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় এই বনে বেড়াতে গেলে তাই এদের চোখে পড়বেই৷ কখনও একা একা, আবার কখনও দঙ্গল বেধে ঘুরে বেড়ায় এরা৷ তবে বৃষ্টির সময় এদের গাছের ডালেই আশ্রয় নিতে দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
চলে লুকোচুরির খেলা...
বর্ষাকালে সুন্দরবনে চলে রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি৷ ঝকঝকে রোদের মধ্যে হঠাৎ করেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা যায় এখানে৷ গাড় হয়ে ওঠে নদীর জল, বনের সবুজে পড়ে ছায়া৷ কখনো কখনো মেঘের ভেতর থেকেই সূর্য উঁকি মারে, অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয় বনজুড়ে৷
ছবি: DW/M. Mamun
‘লাল-নীল-সবুজের মেলা বসেছে’
কখনও আবার তুমুল বৃষ্টিপাতের মধ্যে হঠাৎ করেই ঝকঝকে নীলাকাশ দেখা যায় সুন্দরবনে৷ বৃষ্টিধৌত বনে সূর্যের আলো তখন ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করে৷ ঝলমল করে ওঠে নদী, বনের গাছ৷ বৃষ্টি একটু ধরলে আস্তে আস্তে নদীর ধারে চড়তে আসে বানর, হরিণ, এমনকি বাঘ মামাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্ষার এক ভিন্ন চিত্র
সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া বন্যপ্রাণী অভয়রাণ্যে বৃষ্টিস্নাত এক ‘গ্রেটার ইয়োলোনেইপ’ বা বড় হলদেসিঁথি কাঠঠোকরা৷ নানা রকম পাখির নিরাপদ আবাসস্থল এই সুন্দরবন৷ প্রায় ৪০০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি রয়েছে সুন্দরী গাছের এ বনে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সুন্দরবনের সুন্দরী হাঁস
সুন্দরবনের কটকা বনাঞ্চলের বড় কটকার খালে চোখে পড়ে ‘মাস্কড ফিনফুট’ বা সুন্দরী হাঁস৷ এর আরেক নাম কালোমুখ প্যারা পাখি৷ বাংলাদেশের সুন্দরবন ও মিয়ানমারে এ হাঁসের বিচরণ সবচেয়ে বেশি৷ সারা পৃথিবীতে বর্তমানে এ পাখির সংখ্যা এক হাজারেরও কম৷ লাজুক স্বভাবের সুন্দরী হাঁসের বৃহত্তম আবাসস্থলও সুন্দরবন৷
ছবি: DW/M. Mamun
জেলেদের জীবন
সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী জয়মনি জেলে পল্লীর পাশে পশুর নদীতে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করছেন জেলেরা৷ সুন্দরবনের পাশে গড়ে ওঠা ভ্রাম্যমাণ এ জেলে পল্লীর জেলেরা সুন্দরবন ও তার আশেপাশে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের পর...
সুন্দরবনের শেলা নদীতে চলছে তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী জাহাজ৷ গত ডিসেম্বরে প্রায় ৫৮ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে জাহাজ ডুবির পরও এ রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়নি৷ এছাড়া সাম্প্রতিক বাঘশুমারিতে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার কারণ হিসেবেও এই নৌ-রুটটিকে দায়ী করা হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
14 ছবি1 | 14
পরিবেশ রক্ষায় রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধীতা নিয়ে ফেসবুকে প্রচারণায় যেসব পাতা নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম ‘‘সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না'' ফেসবুক পাতাটি৷ ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় মনোনয়ন পাওয়া সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাতাটি থেকে নিয়মিত বিভিন্ন আপডেট প্রকাশ করা হচ্ছে৷ গত ১৬ আগস্ট এই পাতা থেকে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয় যা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়৷ ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একদল তরুণ বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহরের সামনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে৷ ভিডিওটি ফেসবুকে প্রায় দশ লাখ বার দেখা হয়েছে৷ গত ২০ আগস্টে শহীদ মিনারের সামনে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি টেলিভিশিন চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার না করায় এই পাতা থেকে তা ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়৷
তবে শুধু পাতা নয়, অ্যাক্টিভিস্ট বাকিবিল্লাহ, অরুপ রাহীসহ বেশ কয়েকজন নিয়মিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছেন৷ তাদের পোস্ট করা বিভিন্ন লেখা, ছবি গুরুত্ব পাচ্ছে সাধারণ মানুষের আলোচনায়৷ একইভাবে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন দরকার সেটা নিয়েও মতামত জানাচ্ছেন কেউ কেউ৷ তাদের মধ্যে সরকারি দলের সমর্থকরাও রয়েছেন৷
টুইটারেও একাধিক হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে৷ সুন্দরবন নিয়ে ভারতীয় আলোকচিত্রী আরোতি কুমার রাওয়ের বিভিন্ন পোস্ট টুইটারে মাঝেমাঝে সাড়া জাগায়৷ ইন্সটাগ্রামেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷ এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে সুন্দরবন রক্ষায় আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে৷ আভাজে সম্প্রতি চালু করা একটি পিটিশনে সুন্দরবন রক্ষায় ইউনেস্কোর সহায়তা পাওয়া হয়েছে৷
সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলন অনলাইনে বেশ গতি পাচ্ছে৷ সেই তুলনায় রাজপথে সাড়া কম৷ বিশেষ করে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে৷ ফলে ফেসবুকে জনগণের যে প্রতিক্রিয়া তা রাজপথে কমই দেখা যাচ্ছে৷