ফ্যাক্টচেক: এআই যেভাবে নির্বাচনি প্রচারণায় প্রভাব ফেলছে
১৫ অক্টোবর ২০২৪একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে; একজন নীল চোখের স্বর্ণকেশী পুরুষ ব্যালট পেপার যাচাই করছেন৷ একই ভিডিওর আরেক দৃশ্যে পর্দা করা একদল নারীকে রাস্তায় হাঁটতে দেখা যাচ্ছে৷ জার্মানির পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ব্রান্ডেনবুর্গে নির্বাচনের আগে এই ভিডিওটি এক্স-এ প্রকাশ করে উগ্র ডানপন্থি এএফডি দল৷ এরকম একটি ভিডিও নয় লাখের বেশিবার প্রদর্শিত হয়েছে৷
এ ধরনের ভিডিওতে এক ধরনের উদ্বেগজনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে আমাদেরক ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলার চেষ্টা করা হয়৷ আর সেই ভয় দূর করতে এক ধরনের সহজ সমাধানও দিয়ে দেয়া হয়৷ এসব কনটেন্ট সত্য নয়৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এগুলো তৈরি করা হয়েছে৷
এ ধরনের কনটেন্ট খুব সস্তায় এবং সহজে দ্রুত তৈরি করা যায়৷ আর অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভিডিওর তুলনায় এসবকে সহজেই শনাক্ত করা যায়৷ কিন্তু এত সহজে শনাক্ত করা যায়- এমন ভিডিও তৈরি করা হলো কেন? ডয়চে ভেলের ফ্যাক্টচেক টিম এ ধরনের ‘সফটফেক' ভিডিও তৈরির চর্চার কারণ খুঁজে দেখেছে৷
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে তৈরি ভিডিওগুলো যেমন আসল বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, সফটফেকের ক্ষেত্রে সেই চেষ্টা করা হয় না৷
নির্বাচনি প্রচারণায় ‘সফটফেক'
এরকম ‘সফটফেক' নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যবহারের হার বাড়ছে৷ ইউরোপীয় নির্বাচনে এএফডির মূল প্রার্থী ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ তার টিকটক অ্যাকাউন্টে অনেক এআই দিয়ে তৈরি ছবি শেয়ার করেছিলেন৷
ফ্রান্সের রাজনৈতিক দলগুলোও ইইউ এবং প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের সময় অনেক এআই ছবি ব্যবহার করেছিলেন মানুষের মধ্যে আবেগ জাগিয়ে তুলতে৷
ফরাসি রাজনৈতিক দলগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একাউন্ট পরখ করে দেখা গেছে নির্বাচনি প্রচারণায় উগ্র ডানপন্থি দলগুলো ‘সফটফেক' ব্যবহারে বেশি আগ্রহী ছিল৷ আর সেসব ছবির একটিতেও সেগুলো যে এআই দিয়ে তৈরি তা উল্লেখ করা হয়নি৷ যদিও ইউরোপীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সব দল সেটা উল্লেখ করতে সম্মত হয়েছিল৷
নির্বাচনি নীতিমালা অনুযায়ী দলগুলোর ‘‘বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট তৈরি, ব্যবহার এবং বিস্তার করা থেকে বিরত থাকার'' কথা ছিল৷ তা সত্ত্বেও কয়েকটি দল এ ধরনের কনটেন্ট ব্যবহার করেছে৷
ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যবহৃত একটি স্ক্রিনশট
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালেও এরকম ছবির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে৷ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এক নারীর একটি ছবি প্রকাশ করেছেন, যেটিতে আসলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস কমিউনিস্ট পার্টির ধরনের উর্দি পরা একদল মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন৷ এই ছবির মাধ্যমে হ্যারিস ‘হৃদয়ে কমিউনিস্ট' বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে৷
এ ধরনের কনটেন্ট আসলে ভুয়া তথ্য বা ভুয়া সংবাদ ছড়ানোর চেয়েও বেশি কিছু৷ এটা এক ধরনের বিকল্প বাস্তবতা তৈরি করে৷ বাস্তবতার এরকম কৃত্রিম সংস্করণ বাস্তব পরিস্থিতির চেয়েও বেশি বাস্তব মনে হতে পারে৷
আমাদের উপলব্ধির উপর কী প্রভাব তৈরি করে?
কিন্তু আমরা কি এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও এবং ছবিতে যে ভিন্ন বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয় তা বিপুলভাবে প্রচারিত হয় বলে গ্রহণ করে ফেলি?
গত শতকের সত্তরের দশকের দিকে বিজ্ঞানীরা মানুষের মতো ব্যবহার করে এরকম রোবটের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া যাচাই করেছেন৷ জাপানি রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ার মাসাহিরো মোরি যাচাইয়ের সেই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছিলেন ‘অদ্ভুত উপত্যকা'৷
রোবট যত মানুষের রূপ ধারন করবে ততই বিষয়টি ভয়ঙ্কর মনে হতে থাকবে৷
জার্নাল অব মেডিকেল সাইকোলজির প্রধান সম্পাদক নিকোলাস ডেভিড বোম্যান এই বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আসলে আরো অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যাই, কারণ, আমরা যা ভাবি এবং আমাদের সামনে যা উপস্থাপন করা হয় তার মধ্যে কোনো সংযোগ থাকে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটা আমাদেরকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে৷ আমরা অস্বাভাবিক অনুভব করি কারণ আমরা জানি এটা ঠিক নয়৷''
কিন্তু যদি এআই দিয়ে তৈরি ছবি ‘অদ্ভুত উপত্যকা' স্তর পাড়ি দিতে পারে এবং সেগুলো ভীতিকর মনে না হয়, তাহলে কী হবে?
বোম্যান বলেন, ‘‘আমরা ‘অদ্ভূত উপত্যকা' স্তর পর হওয়ার পর আর সেটার কথা জানবো না৷ আমরা সম্ভবত তখন আর এটার পার্থক্য ধরতে পারবো না৷''
কিন্তু আমরা এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছাইনি৷ ‘‘মানুষ এ ধরনের ভিডিও দেখার পর অবচেতন মনেই বিষয়টি ধরে ফেলে৷ আর এটাই কোনো কিছু এআই-এর তৈরি নাকি বাস্তব তা শনাক্তে আমাদের সেরা উপায়,'' যোগ করেন তিনি৷
কিন্তু আপনার মনের মধ্যে সন্দেহ হওয়ার পরও আপনি যদি সেটাকে অস্বীকার করেন, তাহলে হয়ত নকল কিছুকে আসল হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করবেন বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ৷
‘‘মানুষ এই অনুভূতি বন্ধ রাখতে পারে বিষয়টি শনাক্ত করতে না চাইলে৷ কারণ, যা দেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে তিনি একমত এবং তিনি যা দেখতে চান, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ৷ আপনি যদি কোনো পক্ষভুক্ত হন, যেমন উগ্র বাম বা উগ্র ডানপন্থি এবং আসল নয় এমন কনটেন্ট দেখেন, তাহলে আপনি আসলে বিষয়টি তোয়াক্কা করছেন না এবং সেই কনটেন্টের সঙ্গে আপনি একমত,'' বলেন নিকোলাস ডেভিড বোম্যান৷
আমাদের তথ্য পরিবেশের জন্য হুমকি এআই
নির্বাচনি প্রচারণায় ‘ডিপফেক' বা ‘সফটফেক' এর ব্যবহার বাড়ছে৷ ফিলিপ হাওয়ার্ড এই বিষয়টি খেয়াল করেছেন৷ তিনি ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন দ্য ইনফরমেশন এনভায়রনমেন্ট (আইপিআইই)-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট৷ আমাদের তথ্যের ভাণ্ডারের উপর হুমকি প্রতিরোধে কাজ করে স্বতন্ত্র এই বৈশ্বিক সংগঠনটি৷
সম্প্রতি এক গবেষণায় তারা বিশ্বের ৬০টি দেশের ৪০০ গবেষককে যুক্ত করেছেন৷ তাদের দুই তৃতীয়াংশ বিশ্বাস করেন যে, এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও, অডিও, ছবি এবং লেখার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বৈশ্বিক তথ্য পরিবেশের উপর৷ গবেষকদের অর্ধেকের বেশি বিশ্বাস করেন যে এসব প্রযুক্তি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে৷
‘‘আমি মনে করি, আমাদের এই শিল্পের স্বনিয়ন্ত্রণের বাইরেও ভাবতে হবে৷ বর্তমানে এআই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নিরীক্ষা নিজেরাই করে৷ তারা নিজেদের হোমওয়ার্ক নিজেরাই মূল্যায়ন করে,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন ফিলিপ হাওয়ার্ড৷
কিন্তু স্বাধীনভাবে যাচাইবাছাই ছাড়া সেটা করা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন তিনি৷
‘‘আমরা যদি স্বাধীনভাবে যাচাইয়ের জন্য নিয়ন্ত্রকদের পাই তাহলে স্বাধীন তদন্তকারী, সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদরা বিষয়টির আরো গভীরে যেতে পারবে এবং তখন আমরা পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনতে পারবো,'' বলেন হাওয়ার্ড৷
প্রতিবেদন: রায়না ব্রাউয়ার / এআই