জার্মানির সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরে অনেকের মনেই এখন এবোলা জ্বরে ভুগে মারা যাওয়ার আতঙ্ক৷ তবে স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষের দাবি, পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারির রূপ নেয়া এবোলার প্রবেশ রুখতে তারা পুরোপুরি প্রস্তুত৷
বিজ্ঞাপন
গত কয়েক মাসে এবোলা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ফলে জ্বরে ভুগে অন্তত ১৫'শ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ রোগটির প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই সতর্কাবস্থায় রয়েছে বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দর৷ ব্রিটেনের বিমান কর্তৃপক্ষ ‘ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ' এবং ফ্রান্সের ‘এয়ার ফ্রান্স' তো লাইবেরিয়া, গিনি, সিয়েরা লিওন এবং নাইজেরিয়ায় সব ফ্লাইট বাতিলই করে দিয়েছে৷
লাইবেরিয়া, গিনি, সিয়েরা লিওন এবং নাইজেরিয়ার মতো পশ্চিম আফ্রিকার হাতে গোনা কয়েকটি দেশে ভয়াবহ আকারে দেখা দিলেও বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে এবোলা-আতঙ্ক৷ ইউরোপও রয়েছে আতঙ্কে৷ জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দর ব্যবহার করে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বিমানে যাতায়াত করেন৷ এখন সেখানেও লেগেছে আতঙ্কের ঢেউ৷ বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমান অনেক ট্যাক্সিচালক যাত্রীর কাছ থেকে তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন তা না জেনে গাড়িতেই উঠতে দিচ্ছেন না৷ এমন ট্যাক্সি চালকের সংখ্যা এখনো অবশ্য খুবই কম৷
জার্মানির বন শহরের সাংবাদিক আবু-বাকার জালোহ মনে করেন, ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরে এবোলার বিরুদ্ধে যতটা জোরালো ব্যবস্থা নেয়া দরকার আদতে তা নেয়া হয়নি৷ তিনি জানান, সম্প্রতি সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করতে সিয়েরা লিওনের ফ্রি টাউনে গিয়েছিলেন তিনি৷ ফিরে এসে অসুস্থ বোধ করায় মনে হয়েছিল তিনি নিজেও এবোলা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন৷ এই আশঙ্কা দূরে ঠেলার জন্য গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে৷ কিন্তু কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা পেতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়৷ আবু-বাকারের দাবি, অন্য সবার স্বার্থেও তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা সেবা দেয়া জরুরি – দায়িত্বরত ডাক্তারদের এ কথা বোঝাতে তিনি ব্যর্থ হন৷ তাঁর অনুরোধের জবাবে চিকিৎসকরা জানান, সত্যিকার অর্থেই যেসব রোগীর অবস্থা খারাপ তাঁরাই অগ্রাধিকার পাবেন৷ এ অভিজ্ঞতা একটি উপলব্ধির জন্মও দিয়েছে বনভিত্তিক এ সাংবাদিকের মনে আর তা হলো, ‘‘দেখে যদি মনে হয় আপনি এই মুহূর্তে মারা যেতে পারেন, তাহলেই কেবল ডাক্তারদের কাছে অগ্রাধিকার পাবেন৷''
ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রেনে গটশাল্ক অবশ্য মনে করেন, সংক্রমিত রোগীর মাধ্যমে জার্মানিতে এবোলা ভাইরাসের প্রবেশ রুখতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, বিমান বন্দরের স্বাস্থ্য কর্মীরা তাঁদের মোট কর্মঘণ্টার শতকরা ৩০ ভাগই ব্যয় করছেন এবোলা-বিরোধী তৎপরতার পেছনে৷ এ লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে ‘এবোলা সংকট ব্যবস্থাপনা বিভাগ'৷ গটশাল্ক সেই বিভাগের প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা৷ বিভাগটি তাঁর নেতৃত্বে বিমানবন্দরে আগতদের প্রতি নজর রাখছে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷
মহামারি ইবোলা ভাইরাস
ইবোলা বা এবোলা ভাইরাসকে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস হিসেবে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ এতে আক্রান্ত হলে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর অবধারিত৷ তাই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা জারি করেছে সংস্থাটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান মার্গারেট চান এবোলাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি অন্যতম ঘাতক জ্বর হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন যে, আফ্রিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তপ্রদাহজনিত এই জ্বর৷ তাই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন তিনি৷
ছবি: picture alliance/dpa
পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারি
মারাত্মক এবোলা ভাইরাসের আক্রমণে পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১,০০০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭১১৷ গিনিতে গত মার্চে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে এবোলা ভাইরাসের প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
লাইবেরিয়ায় জরুরি অবস্থা
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হিসেবে বিশ্বে এই ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে অন্যতম দেশ লাইবেরিয়ায় বৃহস্পতিবার জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে৷ এতে সরকার বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে৷ প্রাণঘাতী এবোলা ভাইরাস এখন আফ্রিকা থেকে বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
আক্রান্ত অন্যান্য দেশের নাগরিক
স্পেনের একজন প্রবীণ ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক মারাত্মক অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে গেছেন৷ তিনি এবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ সৌদি আরবে একজন রোগীর মৃত্যুর কারণও এবোলা বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা৷ নাইজেরিয়াতেও একজন নার্স এবোলার সংক্রমণে মারা গেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এবোলা সংক্রমণের লক্ষণ
এবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মারাত্মক জ্বর এবং কারও কারও অবিরত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে৷ সঙ্গে থাকে মাথা, পেশী এবং তলপেটে তীব্র ব্যথা৷ রোগীর একদিকে ক্ষুধা কমে যায়, অন্যদিকে শুরু হয় পাতলা পায়খানা৷ সাধারণত শরীর থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন তরল পদার্থের মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আক্রান্ত চিকিৎসক
বলা বাহুল্য, আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচর্যাকারীর মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ লাইবেরিয়াতে যেমন এবোলা রোগীদের পরিচর্যাকারী দুই মার্কিন স্বাস্থ্যকর্মী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর, তাঁদের চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংক্রমণের আশঙ্কা
মূলত কোনো প্রাণী বা মানুষের রক্ত, বীর্য, যোনিরস বা দেহ নির্গত অন্য কোনো তরলের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ায়৷ বলা বাহুল্য, অনিয়ন্ত্রিত এবং অনিরাপদ যৌন মিলনেও এ রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে৷ অর্থাৎ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এইডস রোগের সঙ্গে এবোলার মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
উড়ন্ত খ্যাঁকশিয়াল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পশ্চিম আফ্রিকায় এবোলা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ উড়ন্ত খ্যাঁকশিয়াল৷ এই প্রাণীটি ভাইরাসটি বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ এমনকি সংক্রমিত প্রাণীটি যখন ফলমূল ও অন্যান্য প্রাণী খাচ্ছে, তখন সেসব খাদ্যের অবশিষ্ট অংশ থেকেও ছড়িয়ে পড়ছে এবোলা৷
ছবি: imago
সংক্রমণের ঝুঁকি
তার মানে শুধু মানুষ থেকে মানুষে নয়, মানুষ যখন এবোলায় আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত বা মাংসের সংস্পর্শে আসে, তখনও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ বরং সেক্ষেত্রে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে জানান চিকিৎসকরা৷ তাই খ্যাঁকশিয়াল থেকে অন্য প্রাণী বা ফলমূল হয়ে সহজেই মানুষের মধ্যে এবোলা ভাইরাস তার বংশবৃদ্ধি করে৷
ছবি: DW
৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু
এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর অবধারিত৷ সেজন্যই তো একে মহামারি বলে আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Reuters
বড় সমস্যা
বলা বাহুল্য, আফ্রিকায় বন্য প্রাণী খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে৷ সব বাজারেই এ সব মাংস পাওয়া যায়৷ গবেষকদের ধারণা, এ ধরনের বন্য প্রাণীর মাংস থেকে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবোলা৷ তার সঙ্গে অনিরাপদ যৌন মিলন তো রয়েছেই!
ছবি: picture-alliance/dpa
পরীক্ষামূলক ওষুধ এখনই নয়
এবোলা সংক্রমণ নিরাময়ের উপায় এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি৷ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করার সময় এখনো আসেনি বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ কারণ মার্কিন দুই স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর ওষুধটি প্রয়োগে তাঁদের উন্নতির ধরণে তারতম্য দেখা গেছে৷
ছবি: LEON NEAL/AFP/Getty Images
12 ছবি1 | 12
গটশাল্ক আরো জানান, ‘এবোলা সংকট ব্যবস্থাপনা বিভাগ'-এর সংক্রামক ব্যধির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সংকট ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা প্রতিনিয়ত পুলিশ এবং দমকল বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখছেন৷ কোনো বিমান যাত্রীকে এবোলায় সংক্রমিত মনে হলে সেই বিমান বিমানবন্দরের বাইরে অবতরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ সেখানেই সব যাত্রীকে একে একে পরীক্ষা করে দেখা হবে৷ কোনো যাত্রীকে সংক্রমিত মনে হলে তাঁকে চিহ্নিত করা হবে লাল রংয়ের চিহ্ন দিয়ে৷ পুরোপুরি সংক্রমণের আশঙ্কার বাইরে নয় এমন যাত্রীদের চিহ্নিত করা হবে হলুদ রংয়ের প্রতীক দিয়ে৷ যাঁরা একেবারে সন্দেহের বাইরে তাঁদের দেয়া হবে সবুজ চিহ্ন৷ গটশাল্ক জানিয়েছেন, সবুজ চিহ্নিত যাত্রীরাই কেবল সরাসরি বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে পারবেন৷ হলুদ চিহ্নিতদের বিমানবন্দরে ঢোকানো হবে বিশেষ প্রহরায়, বিশেষ রাস্তা দিয়ে৷ লাল চিহ্নিতদের জন্য রয়েছে বিশেষ গাড়ি৷ সেই গাড়িতেই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে ফ্রাংকফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে৷
এবোলায় সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসার জন্য ফ্রাংকফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড সদা প্রস্তুত৷ গত ১৫ই আগস্ট আদ্দিস আবাবা থেকে আগত এক যাত্রীকে এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হয়৷ যাবতীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর জানা যায়, তাঁর দেহ সম্পূর্ণ সংক্রমণমুক্ত৷