ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে শীর্ষ স্থান দখল করলেন এমানুয়েল মাক্রোঁ৷ দুই সপ্তাহ পর দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি চরম দক্ষিণপন্থি প্রার্থী ল্য পেনের মুখোমুখি হচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
টানটান উত্তেজনার মধ্যেফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেরপ্রথম পর্বের ফলাফল স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ প্রায় ২৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সমর্থনের বিচারে তালিকার শীর্ষে রয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ৷ কিন্তু অল্প ব্যবধানে তার ঠিক পরের স্থান দখল করেছেন চরম দক্ষিণপন্থি প্রার্থী মারিন ল্য পেন৷ তিনি পেয়েছেন প্রায় ২৪ শতাংশ ভোট৷ উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন কট্টর বামপন্থি প্রার্থী জঁ লুক মেলাশঁ৷ প্রায় ২১ শতাংশ ভোটার তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ বাকি ৯ জন প্রার্থীদের মধ্যে কেউই তেমনভাবে ভোটারদের মন জয় করতে পারেননি৷
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার প্রেক্ষাপটে ইউরোপের স্থিতিশীলতার বিষয়টি ফ্রান্সের ভোটারদের মনেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ বিশেষ করে এমানুয়েল মাক্রোঁ যেভাবে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্য ও রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন, তা ভোটারদের মনে ধরতে পারে৷ অন্যদিকে বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ক্ষেত্রে মাক্রোঁ বিরোধিতার মুখে পড়েছেন৷ শেষ পর্যন্ত চরম দক্ষিণপন্থি শক্তিকে ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরে রাখতে ভোটারদের একটা বড় অংশ মাক্রোঁকেই ভোট দেবেন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন৷ তিনি নিজে সেই সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে রোববারই এমন ভোটারদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন৷
আগামী ২৪শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বে মুখোমুখি হচ্ছেন মাক্রোঁ ও ল্য পেন৷ বাকি শিবিরের সমর্থনের উপর তাঁদের ভাগ্য নির্ভর করছে৷ প্রথম পর্বের ফলাফল স্পষ্ট হবার পর প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁ নিজের সমর্থকদের উচ্ছ্বাসের মুখে ‘উন্নয়ন ও খোলামেলা পরিবেশের' জন্য তাঁর প্রকল্প চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার করেন৷ তবে চূড়ান্ত জয়ের আশা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, এখনো কিছুই স্থির হয় নি৷ আগামী দুই সপ্তাহের উপর ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে মাক্রোঁ মনে করেন৷
অন্যজিকে জয়ের আশা ছাড়তে প্রস্তুত নন মাক্রোঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মারিন ল্য পেন৷ তিনি ফ্রান্সের স্বাধীনতা ও মূল্যবোধের উপর জোর দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতের গতিপথ স্থির করতে ভোটারদের সামনে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবধারা বেছে নেবার সুযোগ রয়েছে৷ তিনি নিজে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কেন্দ্র করে চিরায়ত ভাবধারার ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে দাবি করেন৷
মোজা দিয়ে যাবে জানা: কে হবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট
01:22
রোববার সন্ধ্যায় চালানো এক জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী চূড়ান্ত পর্যায়ের ভোটে মাক্রোঁ ৫৪ শতাংশ সমর্থনের আশা করতে পারেন৷ তবে দুই সপ্তাহের মধ্যে সেই মাত্রার যথেষ্ট হেরফের হতে পারে৷ প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে তৃতীয় স্থান দখল করা বামপন্থি প্রার্থী মেলাশঁ তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ল্য পেনকে একটিও ভোট না দেবার জন্য আহ্বান করেছেন৷বাকি প্রার্থীরাও নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট করার পর ভোটাররা দ্বিতীয় পর্বের জন্য মনস্থির করতে পারেন৷ বেশিরভাগ প্রার্থী মাক্রোঁর পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন৷ শুধু চরম দক্ষিণপন্থি প্রার্থী এরিক জেমুর ল্য পেন-কে ভোট দেবার পক্ষে সওয়াল করেন৷ তবে শেষ পর্যন্ত দুই চূড়ান্ত প্রার্থীর সমর্থনে কত সংখ্যক ভোটার নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, তার উপরও ফ্রান্সের আগামী প্রেসিডেন্টের নাম নির্ভর করবে৷ রোববারের নির্বাচনে প্রায় ৭৪ শতাংশ ভোটার অংশ নিয়েছেন৷
এসবি/এসিবি (ডিপিএ, রয়টার্স)
দেড় বছরে ২২টি মসজিদ বন্ধ করেছে ফ্রান্স
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, গত ১৮ মাসে ২২টি মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে৷ তবে যে ক্ষমতাবলে এসব বন্ধ করা হয়েছে তার সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীরা৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
১৮ মাসে ২২ মসজিদ
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, গত ১৮ মাসে ২২টি মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে৷ এই সংখ্যা তার আগের তিন বছরে মোট মসজিদ বন্ধের তুলনায় অনেক বেশি বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা৷ উপরের ছবিতে এক ব্যক্তিকে তার কম্পিউটারে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি মসজিদ দেখাতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
৯০ মসজিদে তদন্ত
ফ্রান্সে প্রায় আড়াই হাজার মসজিদ রয়েছে৷ এর মধ্যে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ মতাদর্শ প্রচার সন্দেহে ৯০টি মসজিদে তদন্ত চালানো হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে৷
ছবি: Vanessa Meyer/dpa/picture alliance
মুসলিমদের জন্য বৈরী হয়ে উঠছে ফ্রান্স
ইউরোপে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করেন এমন দেশগুলোর মধ্যে একটি ফ্রান্স৷ কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা বলছেন, দেশটি ক্রমে মুসলমানদের জন্য বৈরী হয়ে উঠছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, ২০২১ সালে মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক আচরণ বেড়েছে৷ আর অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা কমেছে৷
ছবি: Alain Pitton/NurPhoto/picture alliance
বন্ধ হয়ে যাওয়া আলন মসজিদ
ফ্রান্সের উত্তরপশ্চিমের আলন শহরের এই মসজিদটি গত অক্টোবরে বন্ধ করে দেয়া হয়৷ ছবিতে মসজিদের দরজায় বন্ধের নোটিশ দেখা যাচ্ছে৷ ‘ইসলামের মৌলবাদী রূপ’ প্রচার ও ‘ফ্রান্সের প্রতি ঘৃণার অনুভব চাষ’ করার অভিযোগ এনে মসজিদটি বন্ধ করা হয়৷ কিন্তু মসজিদের কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরকার তার অভিযোগের সমর্থনে খুব কম প্রমাণ উপস্থাপন করেছে৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
রয়টার্সের বিশ্লেষণ
মসজিদ বন্ধ করার প্রমাণ হিসেবে সরকারের পক্ষে থেকে ২০ পাতার একটি নথি (যেটি ‘হোয়াইট মেমো’ নামে পরিচিত) আদালতে উপস্থাপন করা হয়৷ সেটি রয়টার্স বিশ্লেষণ করে বলছে, নথিটি কবে তৈরি হয়েছে, কে করেছে এবং তথ্য কোথা থেকে পাওয়া গেছে তার কোনো উল্লেখ নেই৷
ছবি: Vanessa Meyer/dpa/picture alliance
চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
হোয়াইট মেমোতে আলন মসজিদের চারজনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০২১ সালের এপ্রিলে সংঘটিত দুটি সন্ত্রাসী হামলায় সমর্থন প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়৷ এদের একজন করিম দাউদ (ছবি) স্থানীয় সরকারি অফিসে কাজ করেন৷ ২০২১ সালের অক্টোবরে তাকে সরকারি কর্মচারী হিসেব তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পদক দেয়া হয়েছিল৷ ২০২০ সালে সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি গির্জায় গিয়ে সংহতিও প্রকাশ করেছিলেন৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
পাঁচটি বই উদ্ধার
হোয়াইট মেমোতে মসজিদ থেকে পাঁচটি বই উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে৷ এগুলোকে ‘মৌলবাদী’ বই বলে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ অথচ এর মধ্যে চারটি বই বিশেষায়িত বইয়ের দোকান এবং অনলাইনে অনেক পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন লিল ইন্সটিটিউট অফ পলিটিক্যাল স্টাডিজের ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক দাউদ রিফি৷ অন্য বইয়ের নাম ‘রিয়াদ আস-সালিহিন’৷ ১৩ শতকের এই বইটি ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগারে রাখা আছে৷
ছবি: Fadel Senna/AFP/Getty Images
জিহাদের ডাক দেয়ার অভিযোগ
হোয়াইট মেমোতে আরও অভিযোগ করা হয়, আলন মসজিদের ধর্মপ্রচারকরা সশস্ত্র জিহাদের প্রশংসা করেছেন ও মুসল্লিরা সহিংসতার ডাক দিচ্ছেন বলে শোনা গেছে (যদিও কারা শুনেছেন তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি)৷ এ ব্যাপারে করিম দাউদ বলছেন, সরকার ‘জিহাদ’ শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা করেছে৷ জিহাদের অর্থ সশস্ত্র সংঘাত হতে পারে৷ আবার ‘জিহাদ আল-আকবর’ বোঝাতে প্রায়ই এটি ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ, নফস বা নিজ আত্মা পরিশুদ্ধ করার সংগ্রাম৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
সমালোচনা
অধিকার কর্মী, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের অভিযোগ, ফ্রান্সে ধর্মীয় স্থান বন্ধের জন্য কর্তৃপক্ষকে এত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, যথাযথ পরীক্ষা না করেই মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷ এছাড়া অস্পষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করায় ও পর্যাপ্ত প্রমাণ না দেয়ায় মামলা পরিচালনা করা অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Gaizka
সরকারের জবাব
এলিসি প্রাসাদ রয়টার্সের এই বিশেষ প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করতে চায়নি৷ তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে সরকার কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং ‘আইনের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে’ তা করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Gaizka
অস্থায়ীভাবে বন্ধ
যে আইনে মসজিদ বন্ধ করা হয় তাতে কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্য মসজিদ বন্ধ করতে পারে৷ তবে অধিকার কর্মী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেখা গেছে, অনেক মসজিদই আর কখনও খোলা হয় না৷ বন্ধ হওয়া ২২টি মসজিদের মধ্যে কতটি আবার খুলেছে সে হিসাব মন্ত্রণালয় জানায়নি৷