এককালে গ্রাফিটি ছিল বিদ্রোহী তরুণদের প্রতিবাদের হাতিয়ার৷ আজ শিল্পশাখা হিসেবে এর কদর হচ্ছে৷ ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে এক উৎসব উপলক্ষ্যে উৎসব প্রাঙ্গন ও শহরের সর্বত্র গ্রাফিটি ছড়িয়ে পড়ছে৷
ছবি: Julie Ratsibarska
বিজ্ঞাপন
ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে শিল্প উৎসবের নাম ‘সদ্য চুনকাম করা'৷ দুইশরও বেশি শিল্পকর্ম সেখানে তুলে ধরা হচ্ছে৷ দেড় লাখেরও বেশি দর্শক আসবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ বিশেষ করে তরুণ শিল্পীদের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ৷ পিয়েরিক সেজেরি উৎসবের কর্ণধার৷ তিনি বলেন, ‘‘এ বছর আমদের মাথায় ৫০ শতাংশ স্থানীয় ও ৫০ শতাংশ আন্তর্জাতিক শিল্পীদের আমন্ত্রণের আইডিয়া এসেছিল৷ স্ট্রিট আর্টের ক্ষেত্রে দুটি ধারা রয়েছে৷ কেউ কেউ রাজপথে, অন্যরা বদ্ধ জায়গায় শিল্প সৃষ্টি করেন৷''
‘স্পিরাল' নামের শিল্পী লিঁয় শহরেরই বাসিন্দা৷ ৩৪ বছরের এই পেশাদার শিল্পী স্নিকার জুতো, তেলের আধার ও স্কেটবোর্ডের উপর নিজের সৃষ্টি ফুটিয়ে তুলেছেন৷ এবার তিনি একটি আস্ত ট্রাক বেছে নিয়েছেন৷
এমনকি উৎসব প্রাঙ্গন হিসেবে সাবেক কারখানার বাইরের অংশও গ্রাফিটি শিল্পীরা ছবি এঁকে ভরিয়ে দিয়েছেন৷ বেশিরভাগ শিল্পকর্মই আলাদা করে উৎসবের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে৷ পিয়েরিক সেজেরি নিজে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্ট্রিট আর্টিস্ট হিসেবে সক্রিয়৷ তিনি লিয়ঁ শহরের এই উৎসবের সহ-উদ্যোক্তা৷ তিনি মনে করেন, ‘‘আমার কাছে স্ট্রিট আর্ট অনন্য এক শিল্পশাখা৷ ‘স্ট্রিট আর্ট' শব্দচয়নও আমার খুব পছন্দ৷ সাধারণত ৯৯ শতাংশ শিল্পীই এই সংজ্ঞা পছন্দ করেন না৷ অথচ শব্দদুটির মধ্যে গোটা দর্শন লুকিয়ে থাকায় আমার সেটি ভালো লাগে৷ প্রথম শব্দটি সরিয়ে নিলেও শিল্প অবশিষ্ট থাকে৷''
ফ্রান্সে ‘সদ্য চুনকাম করা’ উৎসব
03:39
This browser does not support the video element.
স্পিরাল নিজে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেন না৷ সময়ের চাপে তার পক্ষে সৃজনশীল কাজ করা সম্ভব হয় না৷ তিনি বলেন, ‘‘না, কোনো সমস্যা নেই৷ কাজ শেষ করার জন্য আমার হাতে গোটা সপ্তাহ রয়েছে৷ তার মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য আমি সময় ভাগ করে নিয়েছি৷ এখনো পর্যন্ত সব ঠিকমতো এগোচ্ছে৷''
উৎসব প্রাঙ্গনে দর্শকরা সৃষ্টির কাজের সময় শিল্পীদের পর্যবেক্ষণ করতে পারেন৷ অথবা কর্মশালায় অংশ নিয়ে নিজেরাই হাতে স্প্রের টিন তুলে নিতে পারেন৷ গোটা শহরেই স্প্রে করা হচ্ছে৷ সেজেরি বলেন, ‘‘এই প্রকল্প উৎসবেরই অংশ৷ শহরের সর্বত্র ব্যক্তিগত ও পাবলিক জায়গায় ‘স্ট্রিট আর্ট' বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রকল্প চলছে৷ একজন শিল্পী এক স্থানীয় গোষ্ঠীর সদস্য৷ তিনিই হয়ত শহরের বেশিরভাগ প্রাচীরে স্প্রে করেছেন৷ তাঁর নাম পেক৷''
লিয়ঁ শহরে স্ট্রিট আর্টের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে৷ গোটা শহরে মিউরাল বা দেওয়াল চিত্র ছড়িয়ে রয়েছে৷ এর মধ্যে কয়েকটি উৎসবের অংশ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে৷
কাই হর্স্টমায়ার/এসবি
আফগান নারীদের কণ্ঠস্বর যখন দেয়াল ফুটে ওঠে
শামসিয়া হাসানি আফগানিস্তানের প্রথম গ্রাফিতি ও স্ট্রিট আর্ট শিল্পী হিসাবে তুলে ধরছেন আফগান নারীদের কথা৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: Shamsia Hassani
কে এই শিল্পী?
২০১৪ সালে ফরেন পলিসি পত্রিকার বিশ্বের ১০০ শীর্ষ চিন্তাবিদদের তালিকায় উঠে আসে আফগান এই খ্যাতনামা শিল্পীর নাম৷ শামসিয়া হাসানি উত্তর অ্যামেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বহু দেশে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসাবে প্রশংসা কুড়োন তার আগেই৷ ১৯৮৮ সালে ইরানে আফগান শরণার্থীদের পরিবারে জন্মানো হাসানি ২০০৫ সালে দেশে ফিরে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন৷
ছবি: Shah Marai/AFP/Getty Images
নতুন করে আলোচনায় হাসানি
আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা তালেবান গোষ্ঠীর হাতে উঠে আসার পর নতুন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার হন শামসিয়া হাসানি৷ অল্প সময়েই ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে শামসিয়ার দুটি দেওয়াল চিত্রের ছবি৷ সাথে, কাবুলের বাসিন্দা হাসানির নিরাপত্তার প্রার্থনা উঠে আসে ফেসবুক, টুইটারের মন্তব্যে৷
ছবি: Shah Marai/AFP/Getty Images
‘দুঃস্বপ্ন’
ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাসানির ’নাইটমেয়ার’ বা দুঃস্বপ্ন শীর্ষক চিত্রটি৷ ৯ আগস্ট যখন আফগানিস্তান আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে তালেবানের হাতে, হাসানি সোশাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন এক নারীর ছবি৷ ছবির নারীকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে কয়েকজন পুরুষ৷ তার হাতে ধরা বাদ্যযন্ত্র, গায়ে বোরকা৷
ছবি: Shamsia Hassani
আফগান নারীদের অবস্থা
তালেবান সমর্থকদের বিধিনিষেধ বা আক্রমণের শঙ্কায় রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে না নারীদের৷ বহু শিল্পীও একই ভয়ে মুছে ফেলছেন তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপস্থিতি৷ হাসানি কিছু দিন নীরব থাকায় তার ভক্তদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে তার নিরাপত্তা নিয়ে৷ তবে ডয়চে ভেলেকে তার ম্যানেজার জানিয়েছেন যে তিনি নিরাপদে আছেন৷
ছবি: Shamsia Hassani
দ্বিগুণ ঝুঁকিতে নারী শিল্পীরা
নব্বইয়ের দশকের মতো আবার বাড়তি ঝুঁকিতে থাকবেন আফগান নারী শিল্পীরা, এমনই মত বহু বিশেষজ্ঞের৷ শরিয়া আইনের সাথে সাংঘর্ষিক শিল্পচর্চায় রত নারীদের জন্য রয়েছে ঝুঁকি৷ হাসানির শিল্পে বারবার উঠে এসেছে আফগান নারীদের সমাজের সাথে লড়াইয়ের আখ্যান৷
ছবি: Shamsia Hassani
কেন গ্রাফিতি
২০১০ সালে পড়াশোনা শেষ করার পর থেকেই গ্রাফিতিকে নিজের পছন্দের মাধ্যম হিসাবে বেছে নেন হাসানি৷ গণপরিসরে নারীদের লড়াই ও তাদের হার না মানা স্বভাবের কথা তুলে ধরতে চান তিনি৷ ফলে, তার পছন্দের ক্যানভাস রাস্তার বা যে কোনো গণপরিসরের দেওয়াল৷
ছবি: Shamsia Hassani
তালেবানের বিরুদ্ধে
২০২০ সালের নভেম্বেরের একটি চিত্রে হাসানি বলেন বিধ্বংসী হামলার পরের দৃশ্যের গল্প৷ কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তালেবান হামলার ফলে যে হাহাকার সৃষ্টি হয় মানুষের মধ্যে, তা ফুটে উঠেছে হাসানির সাম্প্রতিক কাজে৷ ধারাবাহিক সিরিজের ছবিতে ছিল হামলায় মৃত এক সন্তানসম্ভবা মায়ের মৃত্যুর ছবি৷
ছবি: Shamsia Hassani
হাসানির নারীরা যেমন
শিল্পী জানান যে, তার ছবিতে নারী চরিত্রের মুখে সব সময় ফুটে ওঠে আশা, স্বাধীনতা, ভয়, প্রতিবাদ ও বিরহ৷ সব ছবিতেই মুখহীন থাকে এই নারী চরিত্ররা, যা আফগান সমাজে নারীদের মত প্রকাশের অভাব বা সিদ্ধান্তহীনতার প্রতীক৷ ‘‘আমার নারীদের চোখ বন্ধ থাকে, কারণ, সে ভবিষ্যৎ দেখতে অপারগ, কিন্তু সে অন্তর থেকে অন্ধ নয়’’, বলেন হাসানি৷
ছবি: Shamsia Hassani
হাসানির ভবিষ্যৎ
২০১৮ সালে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শামসিয়া বলেন, ‘‘আমি গণপরিসরকে ভয় পাই, কারণ, যে কোনো সময় হামলা হতে পারে৷ আমি সব সময় সতর্ক থাকি৷ আমার কাজের মাধ্যমে মানুষের কাছে ভাবনা পৌঁছাতে পারবো, তাদের চিন্তাধারা বদলাতে পারবো হয়তো৷’’ সোশাল মিডিয়ায় এখনো সোচ্চার হাসানি, সরে আসেননি ভার্চুয়াল দেয়াল থেকে৷