ফ্রান্সে বোরখা নিষিদ্ধ করা নিয়ে রাজনৈতিক হাওয়া গরম
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১০জানুয়ারি মাসের শেষে ফরাসি সংসদের একটি কমিটি বোরখা পরার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে৷ এই যুক্তিকে সমর্থন করছে সংসদের ডান এবং বামপন্থী রাজনীতিকরা৷ এমনকি ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সার্কোজি পর্যন্ত বলেছেন, ফ্রান্সে এ ধরণের পোশাক পরিধান করা যাবে না৷ বোরখা যা পুরো শরীর আবৃত করে রাখে, মুখ ঢাকা থাকে নেকাবে শুধু চোখ দুটো দেখা যায়৷ প্রেসিডেন্ট সার্কোজি নিজেউ বলেছেন, ফ্রান্সে সম্পূর্ণ শরীর এমনকি পুরো মুখ ঢেকে চলাফেরা করা যাবে না৷ সেটা গ্রহণযোগ্য নয়৷
এখন অন্যান্য সাংসদদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আইন করে ফ্রান্সে বোরখা পরা নিষিদ্ধ করা সম্ভব কি না, সেটা সঠিক কাজ হবে কিনা৷ যদি নিষিদ্ধ করা হয় তবে তা কিভাবে করা হবে, কোথায় কোথায় করা হবে৷ তবে সাংসদদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে মতৈক্য৷ একদল বলছে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা কোন ব্যাপারই না৷ সে দিকেই এগিয়ে যাওয়া উচিৎ৷
প্রতি শুক্রবার প্যারিসের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা গুত দ’র -এ মুসলমানরা ভীড় করেন জুম্মার নামাজ আদায় করতে৷ সেখানে রয়েছে এল ফাতেহ মসজিদ৷ প্রতি শুক্রবার সেখানে প্রায় এক হাজারেরও বেশি মুসলমান আসেন৷ মসজিদের ভেতর জায়গা না হওয়ায় অনেকই রাস্তায় নামাজ পড়েন, সঙ্গে নিয়ে আসেন জায়নামাজ, পাটি বা কাগজের শক্ত বোর্ড৷ পুরো রাস্তা তখন আটকে যায়৷ পাঁচ বছর আগেও এই এলাকায় বোরখা পরা কোন মহিলা দেখা যেত না৷ এখন এক ঘন্টায় অন্তত তিন থেকে চারজন বোরখাধারী মহিলা অনায়াসেই চোখে পড়বে৷ যেমন মালি থেকে আগত এই মহিলা৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিলা বললেন, ‘‘বোরখা আমি আনন্দের সঙ্গে পরি৷ এবং এটা পুরোপুরি আমার সিদ্ধান্ত৷ অনেকেই অবশ্য অনেক কিছু আমাকে বলেছে৷ আমাকে ইঙ্গিত করে নানা রকমের মন্তব্যও করা হয়৷ কিন্তু বোরখা পরা আমার অধিকার৷ সবার ইচ্ছেমত পোশাক পরার স্বাধীনতা রয়েছে৷’’
ফ্রান্সের গোয়েন্দা দপ্তরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ঠিক কতজন মহিলা বোরখা পরে রাস্তায় বের হন তা খুঁজে বের করতে৷ দেখা যায়, প্রায় দু হাজার মহিলা বোরখা পরেন৷ তবে ব্রিটেনের তুলনায় বোরখা পরিহিত মহিলার সংখ্যা ফ্রান্সে অনেক কম৷ এ কারণেই যারা বোরখার বিরুদ্ধে তাদের দাবি : ‘অঙ্কুরেই এর বিনাশ হোক ’৷ নয়তো ব্রিটেনের মত অবস্থা হবে ফ্রান্সের৷ এবং সেটা কেউই দেখতে চান না৷
সিহেম হাবচি একটি নারীবাদি সংস্থার সভাপতি৷ প্রতিবাদমুখর কন্ঠ তাঁর৷ তাঁর কাছে নারী নির্যাতনের একটি হাতিয়ার হল এই বোরখা৷একই সঙ্গে এই বোরখা হল নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার যন্ত্র৷ বোরখা মেনে নেয়ার অর্থ হল বৈষম্যকে মেনে নেয়া৷ তিনি বলেন, আমরা যদি এর বিরোধিতা এখনই না করি তাহলে অনেক দেরী হয়ে যাবে৷ যদি ব্রিটেনের দিকে তাকানো যায় তাহলে আমরা দেখবো যে, বোরখা বিষয় নিয়ে কোন আলোচনাই করা সম্ভব হচ্ছে না কারণ এই বিষয়টি সমাজের অত্যন্ত গভীরে প্রবেশ করেছে৷ বোরখা নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠনগুলো জ্বলে উঠবে সবার আগে৷ বোরখার সমর্থকরা এই সংগঠনগুলোর মধ্যেও ঢুকে গেছে৷ আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিদের আমরা কি করে প্রতিহত করবো যদি খোদ ইউরোপেই এই সমস্যা সামলানো না যায় ?’’
সংসদের কমিটি দুটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে৷ প্রথমত, তারা চাচ্ছে একটি প্রস্তাব পাশ করা হোক যেখানে বোরখা পরা নিষিদ্ধ করা হবে৷ দ্বিতীয়ত, প্রস্তাব পাশ হয়ে যাওয়ার পর সাংবিধানিক আদালতের পরামর্শ অনুসারে সরকারি অফিসে, আদালতে, জনসম্মুখে বোরখা পরে উপস্থিত হতে দেয়া হবেনা৷ মহিলারা যদি কোন সরকারি অফিসে কোন কাজে যান তাহলে তাদের মুখের নেকাব সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলতে হবে৷ এমনকি রাষ্ট্রীয় যানবাহনে চলাফেরা করতে হলেও নেকাব সরিয়ে ফেলতে হবে৷ যুক্তি দেখানো হচ্ছে প্রকাশ্যে যাতায়াতের জন্য যে যাত্রী টিকিট কিনছেন তাঁর মুখ যেন দেখা যায়, তাঁকে যেন সনাক্ত করা যায়৷
ফরাসি মুসলিম পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ মুসাভি৷ তিনি নিজেও বোরখার বিরুদ্ধে৷ তবে বোরখা নিষিদ্ধ করার জন্য আইনের প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন না৷ মুসাভি জানান, ‘‘যদি আইন করা হয় তাহলে রাস্তায় সব সময় পুলিশ থাকবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে৷ যদি কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে তাহলে প্রত্যক্ষদর্শীরা সঙ্গে সঙ্গে তা মোবাইল ফোন বা ভিডিওর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে দেবে৷ বোরখা নিষিদ্ধ হবার কারণে ফ্রান্স নিজেই সমালোচনার সম্মুখীন হবে, এটা ফরাসি জাতির জন্য কোন গৌরবের কথা নয়৷’’
ফ্রান্সে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ জ্যাক মিয়ার্দ৷ বোরখা নিষিদ্ধকরার পক্ষে তিনি৷ তাঁর মতে একবার আইন করা হলে তা পালনে কোন সমস্যা হবে না৷ তিনি বেশ জোর দিয়েই বললেন, খুব সহজ কথা৷ কেউ যদি নেকাব পরে রাস্তায় বের হয় তাহলে তাঁকে সোজা বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে৷ অবশ্য কেউ যদি তা একেবারেই আইন মান্য করতে অস্বীকার করে তাহলে ৭৫০ ইউরো জরিমানা করা যেতে পারে৷ এবং আইন নিয়ে খেলা করার সাহস তখন আর কেউ পাবে না৷ অনেকেই বলছে, আইন প্রণয়ন করা এত সহজ হবে না৷ আমি মোটেই তা মনে করি না৷ কারণ আমরা দেখেছি স্কুলে হিজাব পরে ঢোকা নিষিদ্ধ করার পর সবাই তা মেনে নিয়েছে, কোন ঝামেলা হয়নি৷
২৮ বছরের মাবরুকা বুনিয়াহ বোরখা এবং নেকাব - দুটোই পরেন৷ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন৷ তিনি বলেন, ‘‘পুরো বিষয়টি অমানবিক৷ আমি আতঙ্কে সারারাত ঘুমাতে পারি না৷ আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আর কখনো আমার পরিবারকে দেখতে পাবো না৷ আমার জীবন যাপন হবে অস্বাভাবিক৷ আমরা কোন্ অপরাধ করেছি যে আমাদের এ ধরণের শাস্তি দেয়া হচ্ছে৷ আমরা নাকি উগ্রপন্থী৷ আমাদের শুধু অপমান করা হচ্ছে৷’’
প্রতিবেদক: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদক: আবদুল্লাহ আল-ফারূক