সাহিত্যে অন্ধকারময় অদ্ভুত সব ঘটনা তাঁর অসাধারণ ভাষার সৌন্দর্যে উজ্জ্বল৷ অস্তিত্ববাদী লেখক ফ্রানৎস কাফকা তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয় প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে, দক্ষতার সাথে৷
বিজ্ঞাপন
পুরো নাম: ফ্রানৎস কাফকা
জন্ম: ৩রা জুলাই, ১৮৮৩, প্রাগ, চেক প্রজাতন্ত্র৷ (তখন নাম ছিল বোহেমিয়া৷ অঞ্চলটি তখন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অন্তর্ভুক্ত ছিল৷)
শারীরিক এবং মানসিক নিষ্ঠুরতা, বিচ্ছিন্নতাবোধের আদিরূপ, পিতা-মাতা-সন্তানের দ্বন্দ্ব, আতঙ্ক, আমলাতন্ত্রের গোলকধাঁধা আর রহস্যময় রূপান্তরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে কাফকার অধিকাংশ রচনা৷ সমাজের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সময় উদ্ভট রূপ পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে, ছোট গল্পে৷ তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য মেটামরফোসিস' বা রূপান্তর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা গ্রেগর সামসা৷ একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে তিনি এক কিম্ভূতকিমাকার বিরাট পোকার রূপে নিজেকে আবিষ্কার করেন৷ তারপর থেকেই শুরু হয় অসহনীয় এক পরিস্থিতি৷ পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার কারণে তাঁর বিক্রেতার চাকরি হারান এবং ধীরে ধীরে গোটা পরিবারের সহানুভূতিও হারান তিনি৷ হয়ে ওঠেন অবাঞ্ছিত৷ এক সময় মারা যান তিনি৷ ঘরের পরিচারিকারা ময়লার সাথে বাইরে ফেলে দিয়ে আসেন তাঁকেও৷ তাঁর উপন্যাস বা গল্পের চরিত্র প্রায়ই পক্ষপাতিত্ব, লজ্জা এবং অপরাধবোধ বা এমন বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন৷ ‘দ্য ট্রায়াল' গল্পের কথাই ধরা যাক৷ সেখানে ব্যাংক কর্মচারী ইয়োসেফকে এক সকালে গ্রেপ্তার হলেন বিরাট কোনো অপরাধ না করেই এবং শেষ পর্যন্ত তিনি জানতেই পারলেন না তাঁর বিরুদ্ধে আসল অভিযোগটা কী৷ এমনকি বিচারকের সামনেও তাঁকে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি৷
নিজের জীবনের বহু অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে কাফকার রচনায়৷ বড় হয়েছেন জন্মস্থান প্রাগে, সংখ্যালঘু জার্মান ভাষী ইহুদি পরিবারে৷ বাবা ছিলেন ব্যাবসায়ী৷ ছেলের ওপর তাঁর ছিল কঠোর কর্তৃত্ব৷ বলা হয়ে থাকে কাফকার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তিনি কিছুটা অশ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন৷ তবুও কাফকা সারাজীবন চেষ্টা করেছেন দাম্ভিক বাবার কাছাকাছি যেতে৷ জার্মান ভাষীদের স্কুলের শিক্ষা শেষে প্রাগের চার্লস ফ্যার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করেন৷ আইনজীবী হিসেবে একটি বীমা কোম্পানিতে কাজ করেছেন বহু বছর৷ এমন চাকরি উপভোগ করতেন না, তাই সবসময় বলতেন ‘রুটির জন্য এই চাকরি'৷
ফ্রানৎস কাফকা: প্রাগ থেকে গোটা বিশ্বে
কাফকার সময় প্রাগ ছিল ইউরোপের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র৷ শহরটি ও সেখানকার মানুষ মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে কাফকার উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল৷ প্রাগেই তিনি যন্ত্রণাভোগ করেছেন, লিখেছেন এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
লেখক ফ্রানৎস কাফকা
১৮৮৩ সালের তেসরা জুলাই প্রাগে জন্মগ্রহণ করেন ফ্রানৎস কাফকা৷ লেখক তাঁর নিজস্ব সংবেদনশীল মন দিয়ে এই শহরের পুরো পরিবেশ নিজের করে নিয়েছিলেন৷ প্রাগের মানুষ, সেখানকার বই সবকিছুই কাফকার উপর প্রভাব ফেলেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘ডি ফেরভান্ডলুং’
একজন মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করেন যে, তিনি এক বীভৎস, বিকটাকার পোকার রূপ ধারণ করেছেন৷ এই রূপান্তরের কারণে সমাজে তার অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়৷ তিনি চাকুরি হারান এবং তার পরিবারও তাকে অস্বীকার করেন৷ উপন্যাসে এই চরিত্রের নাম ‘গ্রেগর সামসা’৷ ‘ডি ফেরভান্ডলুং’ বা ‘রূপান্তর’ বইটির মাধ্যমে কাফকা সমাজের কাছে জটিল প্রশ্ন তুলে ধরেেছেেন
ছবি: public domain
‘ডেয়ার প্রৎসেস’
একদিন ইয়োসেফ কে. আদালতে হাজির হওয়ার সমন পেলেন৷ কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা ছিল না৷ ইয়োসেফ কে. শুধু এটুকু বুঝেছিলেন যে, বিচারের জটিল প্রক্রিয়ার চাকা ঘুরতে শুরু করেছে এবং তিনি সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে জড়িয়ে গেছেন৷ তিনি যা জানলেন, তা হচ্ছে রাষ্ট্র সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত ক্ষুদ্র৷ ‘ডেয়ার প্রৎসেস’ বা ‘দ্য ট্রায়াল’ এর চলচ্চিত্র সংস্করণের একটি দৃশ্য এটি৷
ছবি: Studiocanal
মহানগরী প্রাগ
কাফকার সময়ে ইউরোপের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল প্রাগ৷ এটি হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল এবং উনিশ শতকের শেষে এটি জার্মান ও চেক সাহিত্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়৷ কাফকার মতো অনেক লেখক উভয় ভাষাতেই পারদর্শী ছিলেন৷ মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিকোণ থেকে এই শহর ও শহরের মানুষ কাফকার উপর প্রভাব ফেলেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
পিতা: হ্যারমান কাফকা
আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হ্যারমান কাফকা (১৮৫২-১৯৩১) পেশায় একজন মাংস বিক্রেতা ছিলেন৷ তাঁর পরিবারে তাঁর কথাই ছিল আইন৷ তরুণ বয়সে বাবাকে লেখা এক চিঠিতে কাফকা নিজেকে ‘‘পাতলা, দুর্বল ও চর্মসার’’ এবং বাবাকে ‘‘ শক্তিশালী, লম্বা, চওড়া’’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন কাফকা তাঁর রচনায় শক্তিধর পুরুষদের ব্যঙ্গাত্মক চরিত্রে পরিণত করে৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
বন্ধু: ফ্রানৎস ভেরফেল
ভোলটাভা নদীর তীরে গ্রীষ্মের লম্বা দুপুর কিংবা প্রাগের পাবে দীর্ঘরাত কাটাতে কাফকার সঙ্গী হতেন ফ্রানৎস ভেরফেল৷ কাফকার চেয়ে বয়সে সামান্য বড় ভেরফেল তখন সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন৷ বন্ধুর সাফল্যে কাফকা ঈর্ষাবান ছিলেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি ডাব্লিউ. (ভেরফেল) কে ঘৃণা করি৷ সে স্বাস্থ্যবান, তরুণ ও সম্পদশালী আর আমি সবকিছুতেই তার থেকে আলাদা৷’’ এই মন্তব্য সত্ত্বেও অবশ্য ভেরফেল ও কাফকা বন্ধু ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
বাগদত্তা: ফেলিস বাওয়ার
ফেলিস বাওয়ারকে প্রথম দেখার পর কাফকা তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘প্রায় ভাঙ্গা নাক, খোড়োচুল, কিছুটা সোজাসাপ্টা, অনাকর্ষণীয় চুল, দৃঢ় চিবুক৷’’ এই বর্ণনা সত্ত্বেও ফেলিসের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন কাফকা এবং তাঁকে পাঁচশত চিঠি লেখেন৷ তাদের মধ্যে দু’বার বাগদান হলেও বিয়ে হয়নি৷ আর তার কারণ কাফকা৷ এক পর্যায়ে, কবির কাছ থেকে বহুদূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান বাওয়ার৷
ছবি: picture-alliance/maxppp
চিকিৎসক: সিগমুন্ড ফ্রয়েড
অস্ট্রীয় স্নায়ুবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে সম্মান করতেন কাফকা৷ তাঁর একটি লেখায় সেটা প্রকাশও পায়৷ তবে ফ্রয়েড এর রোগ নিরাময়ের পন্থা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন কাফকা৷ আধুনিক মনোবিজ্ঞান ফলাফল দেখালেও কাফকার মত ছিল, ‘‘এখনো পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে আসলে কিছুই হয়নি৷’’
ছবি: Hans Casparius/Hulton Archive/Getty Images
প্রকাশক: কুর্ট ভোল্ফ
প্রকাশক কুর্ট ভোল্ফ তাঁর সময়কার তরুণ, মেধাবীদের নিয়ে কাজ করেছিলেন৷ তবে কাফকার সঙ্গে তাঁর কঠিন সময় গেছে৷ ১৯১২ সালে কাফকার প্রথম গল্পের বই প্রকাশ করেন তিনি৷ বইটির আটশো কপি ছাপা হয়েছিল কিন্তু সেগুলো ভালো বিক্রি হয়নি৷ বই প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ পর কাফকা লিখেছিলেন, ‘‘এগারো কপি বিক্রি হয়েছে৷ এর মধ্যে দশ কপি আমি নিজে কিনেছি৷ এগারোতম কপিটি কে কিনেছে সেটা জানতে মন চাইছে৷’’
ছবি: picture-alliance/akg-images
জীবনীকার: সল ফ্রিডল্যান্ডার
ইতিহাসবিদ সল ফ্রিডল্যান্ডার নিজের জীবনের সঙ্গে কাফকার জীবনের অনেক মিল খুঁজে পান৷ এই কবির মতো ফ্রিডল্যান্ডারের বাবাও প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন৷ আর কাফকার বোনেদের মতো এই ইতিহাসবিদের পরিবারের একাধিক সদস্যরা নাৎসি বন্দিশিবিরে প্রাণ হারান৷ কাফকার একটি প্রামাণ্য জীবনী লিখেছেন ফ্রিডল্যান্ডার৷ ১৯২৪ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে মারা যান ফ্রানৎস কাফকা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
চাকরির পাশাপাশিই চলে সাহিত্য চর্চা৷ ১৯১২ সালে প্রথম প্রকাশ পায় ১৮টি ছোট গল্পের সংকলন ‘বেত্রাখটুং' (কন্টেমপ্লেশন)৷ একাধিকবার প্রেমে পড়েছেন তিনি৷ কিন্তু কোনোটিই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বা বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি৷ ৩৪ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন কাফকা৷ বলা যায়, তাঁর প্রায় সারাটি জীবনই কেটেছে অসুস্থতাজনিত বিষণ্ণতা এবং সামাজিক উদ্বেগের মধ্য দিয়ে৷ মারা যান ৪১ বছর বয়সে৷ মৃত্যুর কিছুকাল আগে নিজের যাবতীয় পাণ্ডুলিপি এবং না পাঠানো চিঠি ও স্মৃতিচারণামূলক বই দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘকালের বন্ধু, সাহিত্যিক ও প্রকাশক মাক্স ব্রোডকে৷ দেয়ার সময় একটা অনুরোধও করেছিলেন – সব কিছুই যেন তাঁর মৃত্যুর পর ধ্বংস করে ফেলা হয়৷ ব্রোড তা করেননি৷ কাফকা বেঁচে থাকতে তাঁর খুব কম রচনাই প্রকাশিত হয়েছিল৷ মৃত্যুর পরই সিংহভাগ প্রকাশিত হয়৷ ফ্রানৎস কাফকার সাহিত্যকর্মই তাঁর লেখক সত্তাকে চিরজীবী করেছে৷