একটি বই নিয়ে বাংলা একাডেমির আপত্তি থাকায় এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল পায়নি আদর্শ প্রকাশনী৷ বাংলাদেশে বই নিয়ে ‘আপত্তি’ বা মেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়৷
বিজ্ঞাপন
এবার একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাদের আপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করেছে৷ তারা বলছে বইমেলার নীতিমালা অনুসরণ না করে ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ নামের একটি বই প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য বইমেলার স্টলে রাখতে চাওয়ায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না৷ বইটির লেখক ফাহাম আব্দুস সালাম৷
বাংলা একাডেমি তাদের চোখে বইয়ের ‘বিতর্কিত’ অংশটুকুও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তুলে ধরেছে৷ তারা বলছে, বইটির ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় বাঙালি জাতিসত্তা; ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বিচার বিভাগ, বিচারপতি, বাংলাদেশের সংবিধান, সংসদ সদস্য; ২০ নম্বর পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ৭১ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশ্লীল, রুচিগর্হিত, কটাক্ষমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে, যা সংবিধানের ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থী৷ কমিটি মনে করে, বইটি বইমেলার নীতিমালা ও নিয়ামাবলির পরিপন্থি৷
আদর্শ-র বইয়ে যা আছে
আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল না দেয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে রোববার একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি৷ এতে আদর্শ থেকে প্রকাশিত ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইয়ের চারটি পৃষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়৷
ছবি: Adarsha publication
বাংলা একাডেমির প্রেস রিলিজ
বাংলা একাডেমি বলেছে, ‘‘আদর্শের বিতর্কিত বইটির ১৫ নং পৃষ্ঠায় বাঙালি জাতিসত্তা; ১৬ নং পৃষ্ঠায় বিচার বিভাগ, মাননীয় বিচারপতিগণ, সংবিধান, জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্যবৃন্দ; ২০ নং পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ৭১ নং পৃষ্ঠায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশ্লীল, রুচিগর্হিত, কটাক্ষমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে৷’’
ছবি: Adarsha publication
‘বাক ও ভাব-প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থি’
বাংলা একাডেমি বলেছে, ‘‘উপর্যুক্ত বক্তব্য বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত মত-প্রকাশের স্বাধীনতা, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও ভাব-প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থি৷’’
ছবি: bdnews24.com
সংবিধানের ৩৯(২) ধারায় যা বলা আছে
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আদর্শের বইয়ের ১৫ নং পৃষ্ঠায় যা লেখা আছে
‘‘বাঙালি কখনো এলাবোরেট স্বপ্ন দেখতে পারে না- তার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন৷ তার স্বপ্ন হলো তাৎক্ষণিকতার স্বৈরাচার - অর্ধেক তার দেখা, তার অর্ধেক তার স্বপ্ন৷ আর সেই সিকিস্বপ্নের পুরোটাই হলো ধ্বংসের ছক৷... তার (বাঙালির) কলোনিয়াল মাথার সব থেকে বড় চিহ্ন হোলো আইন-ফেটিশ৷ কলোনিয়াল মাথা মনে করে যে সব কিছুর জন্য আইন দরকার, পা. মারা এবং পা.. থেকে রক্ষা পাওয়া দুটোর জন্যেই আইনের প্রয়োজন আছে৷’’
ছবি: Md Rafayat Haque Khan/ZUMA Wire/IMAGO
১৬ নং পৃষ্ঠায় যা লেখা আছে
‘‘বাংলাদেশের বিচারপতিরা শক্তিমানের প্রতি পরমব্রতী; বিচার করার চেয়ে বিহিত করার দিকে তাদের ঝোঁকটা একটু বেশি৷... গর্দভদের সংবিধানে সবসময় সর্বোচ্চ সংখ্যক আইন ও সংশোধনী থাকতে হয়৷ গর্দভরা নিরাপদ হওয়ার চেয়ে নিরুপদ্রব হওয়াকে বড় পাওয়া মনে করে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
২০ নং পৃষ্ঠায় যা লেখা আছে
‘‘পাকিস্তান আমলের শীর্ষ পর্যায়ের এমন কোনো অপকর্ম ছিলো না যেটা বলবৎ রাখিনি আমরা বাংলাদেশ আমলে৷ বরঞ্চ বহু ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পরে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা পাকিস্তানিদের ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হই (যেমন নির্বিচার লুটপাট ও মেরিটোক্রেসির ওপরে স্বজনপ্রীতিকে স্থান দেয়া)৷’’
ছবি: AP/picture alliance
২০ নং পৃষ্ঠায় আরও যা লেখা আছে
‘‘পরমতসহিষ্ণুতার কথা বললে আমি কেবল একটিই উদাহরণ দেবো: ৭ই মার্চ শেখ মুজিবর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন— বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের সাথে ডিনার করতে পেরেছিলেন৷ আজকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতা কাছাকাছি কোনো আহবান করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে জেলে ঢোকানো হবে পল্টন ময়দান থেকেই৷’’
ছবি: Journey/M. Alam
৭১ নং পৃষ্ঠায় যা লেখা আছে
‘‘আওয়ামী লীগের হয়ে এলেকশান করা এক রাজনীতিবিদ আমাকে বলেছেন যে শেখ হাসিনার চেয়ে বড় একনায়ক ভারতবর্ষের ইতিহাসে কখনো আসেনি৷ যত বড় একনায়কই হোক, অন্তত পার্টি মেন কিংবা জেনারেলদের সাথে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত দেন৷ সিনিয়র মেম্বারদের মতামত আপনি নেবেন কি না, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ কিন্তু একনায়করা অন্তত আলোচনা করেন৷ শেখ হাসিনা এ প্রয়োজনটুকুও বোধ করেন না৷ দলের মহাসচিবও জানেন না তিনি কী করবেন৷’’
‘‘শেখ হাসিনা যে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুরো দেশটাকে বিস্ফোরণমুখ করে ফেলেছেন এবং এর দায়ভার যে প্রায় এককভাবে তার- এই কথা কোনো সুস্থ মানুষ অস্বীকার করতে পারবেন বলে মনে হয় না৷ কিন্তু বিস্ময়করভাবে নন-রেসিডেন্ট শাহবাগী, যাদের অনেকেই খুব ভালো পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় ডিগ্রী করছেন; তারাও কোনো উচ্চবাচ্য করেন না৷ এমনকি অনেকে এখনও এই বিষয়ে হাসিনাকে সমর্থনও করেন৷’’
ছবি: PID Bangladesh government
9 ছবি1 | 9
‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটির লেখক ফাহাম আব্দুস সালাম বলেন, ‘‘আমার বইটি যদি কেউ পড়েন, তাহলে তাদের মনে হতে পারে বাংলা একাডেমিতে আমার কোনো লোক আছে, তাদের দিয়ে আমি বইটি বই মেলায় নিষিদ্ধ করিয়েছি চাহিদা বাড়ানোর জন্য৷ বইয়ে এমন কিছু নেই যার জন্য আপত্তি করা যায়৷ আমরা মনে হয়, কেউ আমার বইটির কিছু লাইন মার্ক করে বাংলা একাডেমিকে দিয়েছে, তারা সরকারকে খুশি করতে আদর্শ প্রকাশনীকে ‘নিষিদ্ধ' করেছে৷’’
তার কথা, ‘‘এতে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি৷ কিন্তু আরো অনেকের বই তারা প্রকাশ করতো, সেই লেখকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ এখন পাঠকরা বাইরে থেকে আমার বই হুমড়ি খেয়ে কিনছেন৷ তারাও আবার পড়ে হতাশ হতে পারেন৷ কারণ, তারা মনে করছেন হয়ত অনেক কিছু পাবেন, কিন্তু তারা যেরকম চান, সেরকম কিছু পাবেন না৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার বই নিষিদ্ধ না, কিন্তু প্রকাশক ‘নিষিদ্ধ’৷ এর মাধ্যমে বাংলা একাডেমি প্রকাশকদের বলে দিলো আমাদের চিন্তার বাইরে কোনো বই প্রকাশ করলে তোমরাও বই মেলায় আসতে পারবে না৷’’ তিনি বলেন, তিন বছর আগের বই নিয়ে এখন তারা স্টল দিলো না৷ এই তিন বছর তারা কী করেছেন? আর আদর্শর কর্ণধার মাহবুব রহমান বলেন, ‘‘বাংলা একডেমি তো বই নিষিদ্ধ করতে পারে না৷ তারা স্টল নিষিদ্ধ করে উৎসে সেন্সর করলো৷ জানিয়ে দিলো, তাদের পছন্দের বাইরে গেলে স্টল পাওয়া যাবে না৷ ফলে এমনিতেই তো প্রকাশকরা নিজেরা সেন্সর করে, এটা আরো বাড়বে৷ ফলে সরকারকে আর সেন্সর করতে হবে না৷’’
তার কথা, ‘‘এর ফলে ভিন্নমত, ভিন্নস্বর কমে যাবে৷ সেটাই চাওয়া হচ্ছে৷ এ বছর ৬০ জন লেখকের বই নিয়ে আসতাম, তাদের বই এলো না৷ প্রকাশক হিসেবেও আমি ক্ষতিগ্রস্ত হলাম৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমাকে যদি সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী প্রকাশ করতে হয় , লিখতে হয়, তাহলে তো আমাকে সরকারি চাকরি করতে হবে৷’’
এরফলে ভিন্ন মত, ভিন্নস্বর কমে যাবে: মাহবুব রহমান
স্টল বরাদ্দের নীতিমালায় যা আছে
বাংলা একাডেমি তার নীতিমালায় বলেছে-অশ্লীল, রুচিগর্হিত, জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন বা জননিরাপত্তার জন্য বা অন্য যে কোনো কারণে বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনো বই বা কোনো পত্রিকা বা অন্য কোনো দ্রব্য অমর একুশে বইমেলায় বিক্রি, প্রচার ও প্রদর্শন করা যাবে না৷ একাডেমি বা বইমেলা পরিচালনা কমিটি যদি বইমেলায় কোনো বই, ম্যাগাজিন, লিফলেট বা এ জাতীয় অন্য কোনো দ্রব্য বিশেষ কারণে বা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রচার বা প্রদর্শন বা বিক্রি করা বাঞ্ছনীয় বিবেচনা না করে, তাহলে কোনো অংশগ্রহণকারী তা প্রদর্শন বা প্রচার বা বিক্রি করতে পারবেন না৷ এ সিদ্ধান্ত কোনো অংশগ্রহণকারী যদি মানতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার স্টল বরাদ্দ বাতিল হবে, তার জমা দেয়া টাকা ফেরত দেয়া হবে না৷ এবং ভবিষ্যতে তিনি মেলায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না৷
লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘এইসব নীতিমালার কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ আর এর মানদণ্ড কী হবে তা-ও স্পষ্ট নয়৷ আসল কথা হলো, আমার পছন্দ হলে ঠিক আছে আর পছন্দ না হলে ঠিক নাই৷ এটা নির্ভর করে কখন কারা ক্ষমতায় তার ওপর৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বিকৃত রুচি বললে এর পক্ষে বিপক্ষে দুই গ্রুপ কথা বলবে৷ কিন্তু আমাদের বিকৃত রুচির কারণ হলো আমাদের রাজনীতি খুব বিকৃত রুচি হয়ে গেছে৷’’
আসল কথা হলো আমার পছন্দ হলে ঠিক আছে, পছন্দ না হলে ঠিক নাই: আফসান চৌধুরী
‘‘আগেও এটা হতো৷ তবে এখন বাড়ছে৷ বাংলা একাডেমি একটা উদাহরণ সৃষ্টি করে দিলো৷ আগামীতে যে কত স্টল আর বই বন্ধ হবে তা ভাবা যায় না,’’ বলেন আফসান চৌধুরী৷
নিষেধাজ্ঞার অতীত
২০১৫ সালে ‘নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর’ নামের একটি বইয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিয়েছিল বাংলা একাডেমি৷ সেটি ছিল এক ইরানি লেখকের বইয়ের অনুবাদ৷ এরপর ২০১৬ সালে ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বইয়ের কারণে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগার আশঙ্কায় অমর একুশে বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ৷ এ ঘটনায় লেখকসহ পাঁচ জনকে আটকও করা হয়৷ একই বছর শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য বাংলা একাডেমিতে নিষিদ্ধ করা হয় ধর্ম নিয়ে ‘আপত্তিকর’ বই প্রকাশের প্রস্তুতির অভিযোগে৷
২০২০ সালে বই মেলা চলাকালে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অভিযোগে দুইটি বই নিষিদ্ধ করে হাইকোর্ট৷ বই দুইটি হলো দিয়ার্ষি আরাগ নামের এক লেখকের ‘দিয়া আরেফিন’ এবং ‘নানীর বাণী’৷ আদালত তখন বই মেলার সব স্টল এবং সারা বাংলাদেশ থেকে বই দুটি তুলে নেয়ার নির্দেশ দেয়৷
বাংলাদেশে আদালতের নির্দেশের বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি আইনের অধীনে বই বা কোনো লেখা নিষিদ্ধ করতে পারে৷ হুমায়ূন আজাদের নারী, তসলিমা নাসরিনের লজ্জা-সহ ছয়টি বই এ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্তণালয় নিষিদ্ধ করেছে৷ কর্নেল অলি আহাদের ‘রেভ্যুলিউশন, মিলিটারি পার্সোনেল অ্যান্ড দ্য ওয়ার অব লিবারেশন’ বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল আদালতের নির্দেশে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০২০ সালের আগস্টে নিষিদ্ধ হয় সাইফুল বাতেন টিটোর ‘বিষফোড়া’৷ ওই বছরের বইমেলায় বইটি প্রথমে বিক্রি হলেও শেষ দিকে বইটির সব কপি মেলা থেকে তুলে নেয় পুলিশ৷
আসছে ফেব্রুয়ারি, আসছে বইমেলা
মনের খোরাক ও জ্ঞানের অন্যতম বাহক বই৷ বাংলাদেশে বইকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় আয়োজন অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু হচ্ছে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে৷ চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি৷ ছবিঘরে দেখুন তার নানা চিত্র৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বই মানেই বাংলাবাজার
পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাওয়ার পথেই পড়বে বাংলাবাজার৷ এখানে রয়েছে শত শত বইয়ের দোকান৷ বই ছাপানো, প্রচ্ছদ, প্রুফ রিডিংসহ বইমেলার যাবতীয় প্রস্তুতি সারছেন তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দোকানে বইয়ের স্তুপ
বাংলাবাজারের প্রকাশনা সংস্থাগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সেখান বইয়ের স্তুপ জমে আছে৷ বইমেলা উপলক্ষে বই ছাপানো বেড়েছে বিধায় গোডাউনের পাশাপাশি দোকানেও যতটুকু সম্ভব বই এনে রাখা হচ্ছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘পট্টি’ থেকে চাহিদা পূরণ
দেশে ডলার সংকটের কারণে দেশের বাইরে থেকে কাগজ তৈরির ‘পাল্প’ আমদানি কমে গেছে৷ এ সংকট সমাধানে কাগজের উচ্ছিষ্ট অংশ বা পট্টি থেকে ফের কাগজ তৈরি করা হচ্ছে৷ এতে অবশ্য পট্টির চাহিদা ও দাম গত তিনমাসে কমপক্ষে তিনগুণ বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘কাগজের দাম বেড়েছে’
প্রকাশনা সংস্থা শব্দ শিল্পের কর্ণধার মোঃ শরিফুর রহমান বলেন, ‘‘বইমেলার আগে আমরা যখন মোটামুটি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি, তখনি বই ছাপানোর যে মূল উপকরণ, সেই কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হলো৷ এখন অনেক প্রকাশনা সংস্থাই বই ছাপানো থেকে আকস্মিকভাবে সরে আসছেন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শিশুতোষ বইয়ের চাহিদা
শিশুতোষ বই ছাপানোর প্রকাশনা সংস্থা আবির বুক ডিপোর স্বত্বাধিকারী আওলাদ মিয়া বলেন, ইউটিউব বা অনলাইনভিত্তিক শিশুদের অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যম বেড়ে যাওয়ায় এখন বাচ্চাদের শিক্ষামূলক বই কম বিক্রি হচ্ছে৷ তাছাড়া আনুষাঙ্গিক জিনিসের দাম বাড়ার কারণে বইয়ের দামও বেশি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাড়তে পারে বইয়ের দাম
পুরান ঢাকার বাংলাবাজার ও প্যারিদাস রোডে ঘুরে একাধিক প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কাগজের দাম বাড়ায়, এবার বইমেলায় বইয়ের দামও বাড়তে পারে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জানুয়ারি মাসের উলটো চিত্র
পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের আনমন প্রিন্টার্সের কর্মচারি মোঃ মাসুদ বলেন, ‘‘আমি প্রায় ৩২ বছর ধরে প্রিন্টিংয়ের কাজ করি৷ কিন্তু করোনার লকডাউন বাদে কোনো জানুয়ারি মাসে এতো কম কাজ হতে দেখি নাই৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব বইয়ে
ঢাকার একাধিক প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশক ও লেখক মনে করেন, এখন শিক্ষিত শ্রেণির প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন থাকায় সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন প্লাটফর্মে তারা ব্যস্ত থাকছেন৷ এর প্রভাবে পাঠকেরা বই বিমুখ হচ্ছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রভাব অন্যান্য পেশায়
বাংলাবাজারে বই পরিবহণের কাজে নিযুক্ত ভ্যানচালক মোঃ আসগর আলী বলেন, গত বছরগুলাতে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে দম নেওয়ার ফুরসত থাকতো না৷ প্রচুর কাজের চাপ থাকত৷ অথচ এবার চিত্র একেবারেই ভিন্ন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
টুকটাক অর্ডার আসছে
পুরান ঢাকার কাগজিটোলার জনতা প্রেস, আইডিয়াল প্রেসসহ একাধিক প্রকাশনা ও ছাপাখানা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের এখন যে টুকটাক কাজের অর্ডার আছে, তা দিয়ে কোনমতে চলে গেলেও কতদিন এভাবে টিকে থাকা যাবে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা সন্দিহান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বইমেলা ঘিরে সমালোচনা
অমর একুশে বইমেলা শুরু হওয়ার ঠিক আগে সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা একাডেমীর একটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা শুরু হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ‘আদর্শ’ প্রকাশনা সংস্থা বাংলা একাডেমীর নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ৩টি বই প্রকাশ করেছে৷ এ কারণে মেলায় তাদের স্টল বরাদ্ধ দেয়া হয়নি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বইমেলার ভেন্যুর প্রস্তুতি
অমর একুশে বইমেলার জন্য নির্ধারিত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও শাহবাগের সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বইয়ের বিভিন্ন স্টল প্রস্তুতির কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তবুও অমর একুশে বইমেলা
সময়, অন্যপ্রকাশ, কাজল, মাওলা ব্রাদার্সের মতো বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে মানুষের কাছে বইয়ের চাহিদা কমে গেছে৷ তবে তাদের আশা, বইপ্রেমীদের ভিড়ে এবারও সরব হবে বইমেলা, বইও কিনবেন তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
13 ছবি1 | 13
প্রতিবছর বইমেলার বইগুলো মনিটর করার দায়িত্বে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ৷ তাদের পক্ষে কাজটি করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ৷ কোনো বই তাদের কাছে আপত্তিকর মনে হলে তারা প্রথমে বইটি তুলে নেয়৷ পরে তাদের প্রতিবদেনের ভিত্তিতে প্রয়োজনে নিষিদ্ধও করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলয়৷ তাদের বিবেচনায় থাকে ‘শান্তিশৃঙ্খলা পরিপন্থী’ বিষয়টি৷ তবে এ বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও একটি কমিটি গঠন করে বই মনিটর করছে৷
বিষফোড়া বইয়ের লেখক সাইফুল বাতেন টিটো তার বই নিষিদ্ধ হওয়ার পর দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন৷ তিনি বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমার বইটি নিষিদ্ধ করে৷ তারা সংবাদমাধ্যমে নিষিদ্ধের প্রেসরিলিজও পাঠায়৷ আমার বইটি ছিল কওমী মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন ও বলাৎকার নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ৷ অবাক করা ব্যাপার হলো, মাদ্রাসা থেকে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি৷ কিন্ত তথাকথিত প্রগতিশীলরাই আমার বিরুদ্ধে লেগেছিল৷ বই নিষিদ্ধের পর নানা ধরনের হুমকি পাওয়ায় আমি দেশ ছাড়ি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বই নিষিদ্ধ করা মুক্ত চিন্তা ও বাক স্বাধীনতাবিরোধী৷ আমি চাই এই প্রক্রিয়া বন্ধ হোক৷’’
আফসান চৌধুরি বলেন, ‘‘গত ৫০ বছর ধরেই এই চর্চা চলে আসছে৷ আমরা এখন বলছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা৷ বিএনপি আমলে আমরা পাকিস্তানি বাহিনিকে পাকিস্তানি বাহিনি, ঘাতক বাহিনি বলতে পারতাম না৷ এখানে সব কিছুকেই রাজনীতি প্রভাবিত করে৷ সরকার চাইলে বন্ধ হবে, সরকার চাইলে চলবে৷ বই মেলায় স্টল বন্ধ হলো, এটা কি বাংলা একাডেমি করেছে, না সরকার করেছে? সরকার চাইলে তো বাংলা একাডেমির সেটা করতে হবে৷’’
‘‘যেটা হবে, তা হলো, তাদের পছন্দের বাইরে লেখকের পছন্দ বা স্বাধীনতা সংকুচিত হবে,’’ বললেন আফসান চৌধুরী৷
বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ডা. এ কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘বইয়ের ব্যাপারে আমাদের নীতিমালা আছে, সেটা অনুসরণ করি৷ আর এটা প্রকাশকদেরও দায়িত্ব৷ স্টল নিষিদ্ধ হওয়ায় লেখকের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে কিনা আমি বলতে পারবো না৷ আমি তো লেখক না৷ সেটা দেখবে মেলা পরিচালনা কমিটি, মিডিয়াসহ অন্যান্যরা৷’’