‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে' বইমেলায় এমন বই খুঁজতে পুলিশের উদ্যোগ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক৷ বাংলা একাডেমির সচিব মো. আনোয়ার হোসেন এই সিদ্ধান্তের কথা রবিবার সংবাদমাধ্যমে জানালেও, মহাপরিচালক তা অস্বীকার করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সোমবার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি৷ পুলিশ নিয়েছে বলেও আমার জানা নেই৷''
এরপরেও অবশ্য নজরদারির এই কথিত উদ্যোগ নিয়ে লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে৷
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রবিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সভাপতিত্বে এক বৈঠকের পর, বাংলা একাডেমির সচিব মো. আনোয়ার হোসেন জানান, ‘‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে – এমন বইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ পুলিশ নিজ উদ্যোগে এই ব্যবস্থা নেবে৷ আমরাও জানলে পুলিশকে জানাবো৷''
রবিন আহসান
ঐ দিন এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে – এমন কোনো বই কেউ প্রকাশ করছে কিনা, সেটা অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘কোনো বই ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করছে খবর পেলে সেই বই জব্দ করা হবে৷ তাছাড়া যারা সেই বই প্রকাশ করবেন ও বিক্রি করবেন তাদের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷'' শুধু তাই নয়, পুলিশের সোর্সকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম জানায়, পুলিশ নাকি বই পড়ে দেখবে৷
এই খবরের প্রতিক্রিয়ায় শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেখে শুনে মনে হচ্ছে বাংলা একাডেমি বা সরকার মৌলবাদী গোষ্ঠী, চরমোনাই ও হেফাজতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে৷ পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে এখন সৃজণশীল বইয়ের ক্ষেত্রেও তার হস্তক্ষেপ করছে৷ পৃথিবীর কোনো দেশে এমন কোনো নিয়ম বা আইনের কথা শুনিনি, যেখানে পুলিশ বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে অনুসন্ধান করে৷''
আলতাফ শাহনেওয়াজ
রবিন আহসান বলেন, ‘‘বই প্রকাশের স্বাধীনতায় এটা একটা হস্তক্ষেপ৷ আমি বলবো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি একটি অস্পষ্ট ধারণা৷ এর আগেও নানাভাবে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চা বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশে৷ আর এবার তা আরো পাকাপোক্তভাবে করা হচ্ছে৷''
লেখক আলতাফ শাহনেওয়াজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বইয়ের বিষয়বস্তু মনিটরিং করা যেতে পারে৷ আসলে বাংলাদেশে হোলি আর্টিজানে হামলার পর একটু ভিন্নরকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷ কিন্তু সেই মনিটরিং পুলিশ কীভাবে করবে? এটা তো পুলিশের কাজও নয়৷ পুলিশের কাজ হলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া৷ পুলিশ সেটা করলেই ভালো৷ যার কাজ তাকেই মানায়৷''
ওদিকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ বইয়ের ওপর নজরদারি করবে বা মনিটর করবে – এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত বাংলা একাডেমি নেয়নি৷ আমার এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানাও নেই৷ আমার জানা মতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রবিরোধী কোনো লেখা বা প্রকাশনার ব্যাপারে নজর রাখে, তাদের একটা প্রক্রিয়া আছে৷ তবে তা এভাবে নয়৷''
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান
তিনি আরো বলেন, ‘‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে বা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি হয় এমন প্রকাশনা নিয়ে পুলিশ কী করছে বা না করছে তা আমাদের কিছু জানায়নি৷ তাদের কার্যক্রম দেখা আমাদের এক্তিয়ারও নয়৷ তবে আমরা বইয়ের উপর পুলিশের নজরদারিকে উৎসাহ দেই না৷''
প্রসঙ্গত, গতবছর বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশন-এর ‘ইসলাম বিতর্ক' নামের একটি বই জব্দ এবং তাদের স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ৷ এই ঘটনায় বইয়ের লেখক এবং প্রকাশনীর মালিক সামসুজ্জোহা মানিক এখনো কারাগারে আছেন৷
এ নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬
ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা৷ ইতিমধ্যেই বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যান পরিণত হয়েছে লেখক, প্রকাশক আর পাঠকের মিলনমেলায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
প্রাণ ফিরে পেয়েছে বইমেলা
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রবেশ করতে বইপ্রেমীদের দীর্ঘ সারি৷ পর পর দুই বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতায় কিছুটা ম্লান হওয়া এই বইমেলায় এ বছর প্রাণ ফিরে পেয়েছে ইতিমধ্যেই৷ অমর একুশে গ্রন্থমেলার সাধারণ সময়সূচি প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত৷ তবে ছুটির দিনগুলোয় মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়৷ আর ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে এই গ্রন্থমেলা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
নানা সাজে নতুন নতুন বই
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থাপিত একটা বোর্ডে নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ দেখছেন দর্শনাথীর্রা৷ মেলায় প্রতিদিনই প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন বই৷ ১৬তম দিন পর্যন্ত মেলা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছে ৪৬০টি কবিতা, ২৯৯টি উপন্যাস, ২৯৬টি গল্পের বইসহ অগুন্তি বই৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বেড়েছে বইয়ের পরিধি, ব্যাপ্তি
অন্যবারের তুলনায় এবার একুশে বইমেলার পরিধি বেড়েছে৷ বাংলা একাডেমিসহ ১৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায় ছয় হাজার বর্গফুটের ১৫টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ করা হয়েছে এ বছর৷ একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮৩টি প্রতিষ্ঠানকে ১১১টি ইউনিট; সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ৩২০টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৪০টি ইউনিট এবং সব মিলিয়ে মোট ৪০২টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ৬৫১টি ইউনিট বরাদ্দ করা হয়েছে৷ এছাড়া সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের অংশটিকে ভাগ করা হয়েছে ১৫টি চত্বরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বইয়ের জোয়াড়ে ভাসছে সবাই
শুরু থেকেই এ বছরের বইমেলায় দর্শনাথীর সমাগম ভালো৷ তবে সাধারণভাবে ছুটির দিনগুলোতেই দর্শক সমাগম সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে একুশে গ্রন্থমেলায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
গত বছর মেলা প্রাঙ্গনের অদূরে খুন হয়েছিলেন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়৷ তাই এ বছর বইমেলায় নেয়া হয়েছে পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা৷ বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের প্রবেশ পথে মহিলা ও পুরুষদের জন্য বসানো হয়েছে পৃথক ‘সিকিউরিটি চেক’-এর ব্যবস্থা৷ টিএসসি থেকে শুরু করে মেলার ভেতর ও বাইরে বসানো হয়েছে দুই শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা৷ এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বইমেলা মানেই তারুণ্য
বরাবরের মতোই বইমেলায় তরুণদের উপস্থিতিই বেশি৷ বন্ধু, বান্ধবী, এমনকি জোড়ায় জোড়ায় ঘুরছে তরুণ-তরুণীরা৷ তবে মেলায় শুধু ঘোরাঘুরি আর আড্ডাই নয়, তরুণরা বই কিনছেনও প্রচুর৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বেঁচে আছেন হুমায়ূন আহমেদ
বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ গত হয়েছেন কয়েক বছর৷ কিন্তু এখনো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আছেন তিনি৷ মেলার সোহরাওয়ার্দি উদ্যান প্রাঙ্গণে অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নের সামনে তাই সবসময়ই ভিড় লেগে আছে৷
একুশে বইমেলায় গতবছর থেকে সবচেয়ে সুন্দর স্টল কিংবা প্যাভিলয়নের জন্য দেয়া হচ্ছে শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার৷ বইমেলার স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে তাই সাধ্যমতো নান্দনিকতার ছোঁয়া দিতে চেষ্টা করছেন প্রকাশকরা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
গুলতেকিন খানের কবিতা...
বইমেলার সোহরাওয়ার্দি উদ্যান অংশে প্রকাশনা সংস্থা তাম্রলিপির প্যাভিলিয়ন৷ এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের প্রাক্তন স্ত্রী গুলতেকিন খানের কবিতার বই ‘আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম’৷ এটি তাঁর প্রথম বই৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
শোক পরিণত হয়েছে শক্তিতে
জাগৃতি প্রকাশনীর স্টলে ফয়সাল আরেফিন দীপনের প্রতিকৃতির সামনে তাঁর স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলি৷ স্বামী হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে তিনি আকড়ে ধরেছেন জাগৃতিকে৷ নানান ঘাত-প্রতিঘাত পার করেও জাগৃতি থেকে এ বছর প্রকাশিত হয়েছে দশটির বেশি বই৷ এছাড়া আরো দশটি বই আছে প্রকাশের অপেক্ষায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বইমেলায় ব্যানারে জাগৃতির স্টল
বই প্রকাশের কারণেই ধমীর্য় উগ্রপন্থিদের চাপাতির কোপে নিহন হন প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন৷ তবে জাগৃতির স্টল ছাড়া পুরো মেলা প্রাঙ্গণে তাঁর কোনো স্মৃতি স্থান পায়নি৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
শুদ্ধস্বরের সেই স্টলটা...
মেলার সোহরাওয়ার্দি উদ্যান অংশে প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের স্টল৷ লেখক অভিজিৎ রায়ের ‘সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্বিক অনুসন্ধান’ বইটি গতবছর বের হয় এই প্রকাশনা সংস্থা থকে৷ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বছর না ঘুরতেই গতবছরের শেষের দিকে উগ্রবাদীদের হামলার শিকার হন শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল৷ তবে প্রাণে বেঁচে যান তিনি৷ চিকিত্সা শেষে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে পাড়ি দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
শুদ্ধস্বরের নতুন বই নেই
টুটুলের প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বর থেকে এ বছর নতুন কোনো বই প্রকাশিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ব-দ্বীপের স্টল বন্ধ
ধমীর্য় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে বইমেলার ব-দ্বীপ প্রকাশনার স্টলটি এ বছর বন্ধ করে দেয় পুলিশ৷ এ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘ইসলাম বিতর্ক' বইটিতে মহানবী (সা) সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য আছে, এই অভিযোগে পুলিশ উক্ত প্রকাশনীর প্রকাশকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে৷ বইটির সবগুলো কপিও জব্দ করে নেয়া হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
অটোগ্রাফ প্লিজ!
অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণে ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন জনপ্রিয় লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল৷ হুমায়ূন আহমেদের পরে তাঁর জনপ্রিয়তাই পাঠকদের কাছে সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য...
বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পাঠকদের জন্য স্টল নিয়ে বসেছে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা সংস্থা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার
বইমেলা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করছে বই এবং একুশে বইমেলা বিষয়ক নানা অনুষ্ঠান৷ নতুন বইয়ের খবর, লেখক-প্রকাশকদের সাক্ষাত্কারসহ নানান বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে এ সব অনুষ্ঠানে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
শিশু প্রহর
বইমেলায় শিশুদের জন্যও রয়েছে নানা আয়োজন৷ শুক্র ও শনিবার মেলা শুরু হচ্ছে বেলা ১১টায়৷ এই দু’দিন থাকছে ‘শিশু প্রহর’ নামে শিশুদের জন্য আলাদ সময়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মেলার সঙ্গে সংস্কৃতির মেলবন্ধন
বইমেলা উপলক্ষ্য বাংলা একাডেমি মঞ্চ ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের উম্মুক্ত মঞ্চে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে প্রতিদিন সন্ধ্যায়৷