1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বউবাজারের মিষ্টি বিলাস

পায়েল সামন্ত
৭ মে ২০১৮

কলকাতা জুড়ে অজস্র মিষ্টির দোকান৷ তা সত্ত্বেও কলকাতার বউবাজার এলাকায় গড়ে উঠেছে মিষ্টির একচ্ছত্র সাম্রাজ্য৷ মিষ্টিরদোকানগুলি এই এক জায়গাতেই গড়ে তোলার কারণ কী? মিষ্টি পরিক্রমায় তারই অনুসন্ধান করলো ডয়চে ভেলে৷

ছবি: DW/P. Samanta

সাবেক মিষ্টির ভাণ্ডার

বউবাজার এলাকা সাবেক কলকাতার নিদর্শন৷ বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে মহাত্মা গান্ধি রোড, মানে কলকাতার মানুষের কাছে বউবাজার নামে পরিচিত এলাকাটি মূলত সোনার দোকানের জন্যই বিখ্যাত৷ উৎসবে কেনাকাটার জন্যই এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধি৷ কিন্তু এ অঞ্চলের মিষ্টির খ্যাতি সারা কলকাতা জুড়ে৷ এখানকার দোকানগুলিতে বংশ পরম্পরায় কাজ করে চলেছেন হাওড়া, হুগলি এবং বর্ধমানের কারিগরেরা৷ এঁদের পূর্বপুরুষরাই ইংরেজ আমলের বউবাজারে এসে শুরু করেছিলেন মিষ্টি তৈরির কাজ৷ আজকের বউবাজারের মিষ্টির খ্যাতির মূলে তাঁদের ভূমিকাও কিছু কম ছিল না৷

সোনার বিজ্ঞাপন, টানা রিকশা, পুরনো বাড়ি আর ট্রাম এ এলাকার বৈশিষ্ট্য৷ তার সঙ্গে বিশেষ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই রাস্তার ধারে পরপর সার বেঁধে দাঁড়ানো এলাকার শতাব্দী প্রাচীন মিষ্টির দোকানগুলি৷ সোনার দোকানগুলি পার করে বহু পুরনো নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট ধরে হাঁটলেই চোখ পড়বে ডাকসাইটে নামগুলো ভীম নাগ, জয়শ্রী, নবকৃষ্ণ গুঁই, ভীমচন্দ্র মোদক৷ পাশাপাশি চোখে পড়বে উদয় চন্দ্র ঘোষ, গুপ্তা স্ন্যাকস, আপনজন, পাল সুইটস৷ রাস্তার নাম পাল্টালেই আবার পাল্টে যাবে দোকানগুলিও৷ হিদারাম ব্যানার্জি লেনে অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, আরেক নবকৃষ্ণ গুঁই, ভূপতিচরণ রায়, রামপদ রায়, শ্রদ্ধাঞ্জলি, জ্যোতির্ময় রায়৷ নটবর দত্ত রোড বা শশীভূষণ দে স্ট্রিট ধরে হাঁটলে দেখা যাবে তালিকাটা এখানেই শেষ নয়৷ 

অক্ষুণ্ণ ঐতিহ্য

বাঙালির কয়েকশ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যমণ্ডিত দই-মিষ্টি-সন্দেশ-রসগোল্লার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, একদিন এই বউবাজারেই তৈরি হয়েছিল বাঙালির চিত্তহরণকারী রসগোল্লা৷ ১৯ শতকের সেই প্রসিদ্ধ ইতিহাস স্মরণ করে নবীনচন্দ্র দাসকে বলা হতো ‘বউবাজারের কলম্বাস’৷

তারপর গঙ্গার ওপর দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে৷ পাল্টে গিয়েছে কলকাতার হালচাল৷ চাইনিজ আর মোগলাই খানা সাবেক কলকাতার অনেক খানদানি ঐতিহ্যকে চেঙ্গিজ খাঁয়ের মতো করেই ভূলুন্ঠিত করে দিয়েছে৷ পাশাপাশি  মিষ্টির রাজ্যেও অনেক উত্থান-পতন দেখা গিয়েছে৷ জমে উঠেছে ফিউশনাল মিষ্টির বাজার৷ কিন্তু বউবাজার চত্বরের দেড়শ’ বা পৌনে দুশ’ বছরের সাবেকি মিষ্টির দোকানগুলি এখনও বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে৷ পালাপার্বণে বাঙালির ট্র্যাডিশনাল দেবভোগ্য মিষ্টি, যেমন, ঘি পোহা, নাড়ু, তালের ফুলুরি, মালপো ইত্যাদিও ভরপুর মাত্রায় পাওয়া যায়৷ পুরো তল্লাটে চক্কর দিয়ে দেখা গেল কোনও মোমো, চাউমিন বা মোগলাইয়ের দোকান নেই৷ ডয়চে ভেলেকে স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এখানকার মানুষ এখনও সকাল-বিকেলে মিষ্টির দোকানের সিঙ্গাড়া, কচুরি, জিলিপিই পছন্দ করেন৷ খাবারের পাতে মিষ্টি ছাড়া চলে না৷ মিষ্টিপ্রিয়তার রহস্যটা কী? খুলে বললেন স্থানীয় বাসিন্দা অশোক ভট্টাচার্য৷ তিনি বললেন, ‘‘বউবাজার তল্লাটে বনেদি সুবর্ন বণিকদের বাস৷ তাঁরা বাস্তবের মিষ্টিগত প্রাণ, সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেবতাকে মিষ্টির নৈবেদ্য দিয়ে মিষ্টির পর্ব শুরু করেন৷ রাত অবধি তাই চলে৷ মূলত তাঁদের জন্যই এ অঞ্চলে মিষ্টির দোকানগুলি পরপর গজিয়ে উঠেছে৷ এ ইতিহাস সেই জব চার্নকের কলকাতার জন্মের আগের আমল থেকে শুরু৷ কলকাতার এই সুবর্ণ বণিক বাবুরা প্রাতঃরাশ থেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবধি মিষ্টিতেই নিমজ্জিত থাকেন৷’’ ইংরেজ কেতায় বাবু কালচার হাবুডুবু খেলেও কলকাতা যে অতীতে শেঠ-বসাক-সাবর্ণদের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে, তা প্রমাণ করার সেরা উপায় হয়তো এই মিষ্টিপ্রিয়তা৷   

বউবাজারের রাস্তায় ভীম নাগের ইতিহাস প্রসিদ্ধি কম নয়৷ ১৮৫৬ সালে কলকাতায় সপত্নী লর্ড ক্যানিংয়ের আগমনকে ভীম নাগ মিষ্টির রাজ্যেও স্মরণীয় করে রেখেছিলেন৷ সে ইতিহাস সর্বজনপ্রসিদ্ধ৷ লেডি ক্যানিংকে  তিনি উপহার দিলেন নতুন এক মিষ্টি৷ ছানাকে কড়া করে ভেজে মিষ্টির রসে ডুবিয়ে নতুন কায়দায় তৈরি এই মিষ্টির নাম দিলেন ‘লেডি ক্যানিং’৷ লোকমুখে আজ তা ‘লেডিকেনি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আজ সেই লেডিকেনির বাজারও কম জনপ্রিয় নয়৷ কথিত আছে, বাংলার বাঘ আশুতোষ থেকে রাজা রামমোহন ও রানি রাসমনি সকলেই ভীম নাগের সন্দেশের ভক্ত ছিল৷ প্যাঁড়া, ক্ষীরের পুতুলের পাশাপাশি পেস্তা সন্দেশ, স্ট্রবেরি সন্দেশের মতো ফিউশনাল মিষ্টিতেও জমে উঠেছে আজকের ভীম নাগ৷ ভীম নাগের পরেই ১৮৫ বছরের প্রাচীন দোকান নবকৃষ্ণ গুঁই৷ পুরনো মিষ্টি তৈরিতেই তাঁদের ঝোঁক বেশি৷ ছানার মুড়কি, প্যারাডাইস সন্দেশ, আবার খাবো’র পাশাপাশি তাঁরা অতীতের বড় বোঁদে বানানোও বন্ধ করেননি৷ কর্ণধার উৎপল দে জানালেন, ‘‘বউবাজারের চত্বর কড়া রসের মিষ্টির জন্যই বিখ্যাত৷ এ কারণে রসগোল্লার চাহিদা এখানে ততটা নেই৷ ঠাকুরদেবতাকে কড়া রসের মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয় বলে নিয়মিতভাবে এর উৎপাদন হয়৷ তারকেশ্বর সংলগ্ন এলাকা থেকে এখানকার ছানা আসে৷ অনেকে নিজেরাই ছানা কাটিয়ে নেন৷’’ উৎপল জানালেন, এখানে যখন অফিসপাড়া ছিল, তখন আরও বিক্রিবাটা ছিল৷ সল্টলেক সেক্টরে অফিস পাড়া উঠে যাওয়ায় এখন টেবিল খদ্দের কম পাওয়া যায়৷ তবে নিয়মিত খদ্দেরের ঘাটতি হয় না৷

বউবাজারের চত্বর কড়া রসের মিষ্টির জন্যই বিখ্যাত: উৎপল দে

This browser does not support the audio element.

সাবেক বনাম ফিউশনাল

দক্ষিণ কলকাতার বড় বড় দোকানে রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে আইসক্রিমের সঙ্গে সন্দেশের মিশেল বা ক্যাডবেরির সঙ্গে ছানার মিলন৷ এসব ফিউশনাল মিষ্টির কথা শুনে ৬০ বছরের পুরনো দোকান জয়শ্রীর নিয়মিত খদ্দেররা সাবেকি ভাজা মিষ্টিকে এই এলাকার বিশেষত্ব বলে দাবি করলেন ৷ জিভে গজা, সরভাজা, ক্ষীরের চপের খ্যাতি এখনও টেনে আনে দূর দুরান্তের মানুষ৷ কিন্তু সময় বদলেছে যে, তার প্রমাণও মিলছে৷ ১১৬ বছরের পুরনো ভীমচন্দ্র মোদকের কারিগর খোকনচন্দ্র দে জানালেন, ‘‘এখনকার প্রজন্ম মিষ্টি খেতে চাইছে না৷ এটা সত্যি৷ বিকেলে এই তল্লাটের নোনতা খাবার চাহিদা কমেছে৷ কচুরি জিলিপি ক্ষীরের চপ ভাজার প্রবণতা কমেছে৷’’

এখানকার মিষ্টি এখনও সাবেক ঘরানা বজায় রেখেছে৷ মিষ্টি ব্যবসায়ী স্বরূপ দে জানালেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতার গবেষণামূলক ফিউশনাল মিষ্টির কথা যদি বলেন, তা ওদিকে ভালো চলে৷ তবে আমাদের এদিকে লোকে গবেষণামূলক মিষ্টি পছন্দ করেন না৷ পুজো, উপনয়ন, বিয়ে, অন্নপ্রাশনে আজকাল যুগের হাওয়া লেগেছে৷ ওসব ক্ষেত্রে দেখছি ক্যাডবেরি সন্দেশ, প্যারাডাইস মিষ্টি খাওয়ার ঝোঁক বাড়ছে৷’’

বউবাজারের সাবেক ছানার মিষ্টি কলকাতার আর কোথাও এত কম দামে পাওয়া যায় না: রবীন্দ্রনাথ রায়

This browser does not support the audio element.

৯৩ বছরের প্রাচীন ভূপতিচরণ রায়ের কর্ণধার রবীন্দ্রনাথ রায় ডয়চে ভেলেকে জানালেন, আদতে বর্ধমানের কারিগর দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁদের এই পারিবারিক ব্যবসা৷ এখন সেটা এখানকার কারিগর দিয়েই চলছে৷ তাঁর মতে, আজকাল সুগার ফ্রি মিষ্টি বা যতই আধুনিক মিষ্টির চল হোক না কেন, বউবাজারের সাবেক ছানার মিষ্টি কলকাতার আর কোথাও এত কম দামে পাওয়া যায় না৷ তাই হয়তো সেই চাহিদা এই যুগেও বাজার ধরে রাখতে পেরেছে৷ 

মিষ্টি দোকানে এখন কারিগরের অভাব, নতুন প্রজন্ম আর মিষ্টি তৈরিতে আগ্রহ খুঁজে পায় না৷ পাশাপাশি জিএসটির আঘাতও মিষ্টি সাম্রাজ্যকে আহত করেছে৷ তবুও বউবাজারের সোনা সমৃদ্ধ এলাকায় জেগে থাকবে এখানকার সাবেক মিষ্টিমহল৷ কসমোপলিটন কলকাতায় জেগে থাকবে সাবেক কলকাতার নিজস্ব ঐতিহ্য৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ