বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বুধবার তুবা গ্রুপের পাঁচটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের দু'মাসের বেতন দেবে বলে জানিয়েছে৷ কিন্তু পোশাক শ্রমিকদের তিন মাসের বকেয়া বেতন ও বোনাস চাই, অন্যথায় ধর্মঘট৷
বিজ্ঞাপন
বিজিএমইএ-র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম মান্নান কচি মঙ্গলবার জানিয়েছেন যে, বুধবার বিজিএমইএ ভবন থেকে তুবা গ্রুপের গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুই মাসের বকেয়া বেতন দেয়া হবে৷ তিনি দাবি করেন, শ্রমিকরা বেতন নিতে আসবেন বলে আশ্বাস পেয়েছেন তিনি৷ তবে কেউ বেতন নিতে না আসলে তাদের কিছু করার নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ এছাড়া শ্রমিকদের আন্দোলন বন্ধ করার আহ্বান জানান মান্নান কচি৷
অন্যদিকে, বিজিএমইএ-র সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম দাবি করেন, ‘‘একটা সমাধানে আসার পরও তুবা গ্রুপের শ্রমিকদের নিয়ে অনেকেই রাজনীতি করার চেষ্টা করেছেন৷'' তিনি বলেন, ‘‘যে শিল্পটির ওপর দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে, তা নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়৷''
তাই তাঁর দাবি, ‘‘তুবা গ্রুপে যে চারটি শ্রমিক সংগঠন ছিল সেসব সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই শ্রমিকদের দুই মাসের বকেয়া বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷''তবে তুবা গ্রুপের শ্রমিকরা বিজিএমইএ-র এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন৷ তাঁরা বলেছেন, বুধবার তাঁদের তিন মাসের বকেয়া বেতন আর বোনাস দিতে হবে৷ আর তা না হলে তাঁরা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেবেন৷ সারা দেশের পোশাক কারাখানায় ধর্মঘট ডাকা হবে৷
বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, ‘‘বিজিএমইএ-কে বলবো শ্রমিক আন্দোলন ও বেতন নিয়ে রাজনীতি না করতে৷ শ্রমিক আন্দোলনকে বিভক্ত করার চেষ্টা হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ৷ বেতন দিতে হলে সব বকেয়া বেতন একসঙ্গে তুবার কারখানায় গিয়ে দিতে হবে৷'' গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহকারী সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘‘কালকের (বুধবার) মধ্যে শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন, বোনাস ও ওভারটাইমের সব পাওনা শোধ করা নাহলে তারপর দিন থেকে অবরোধ ও হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হবো৷ আমরা সারা দেশের পোশাক কারখানায় ধর্মঘট ডেকে অচল করে দেব৷''
বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করেন শ্রমিকরা৷ তবে ভবনের মূল ফটকে প্রবেশের সময় তাঁদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেন পুলিশ৷ পরে বিজিএমইএ ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শ্রমিকরা৷ সেখানে শ্রমিকরা বুধবারের মধ্যে তাঁদের বকেয়া বেতন, বোনাস এবং ওভারটাইমের মজুরি দেয়ার দাবি জানান৷ তুবা গ্রুপের শ্রমিক হান্নান বলেন, ‘‘ভিক্ষার টাকা দিয়ে বিজিএমইএ চলে৷ আমরা চলি না৷ আমাদের পাওনা আমাদের কারখানায় গিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে৷ যদি আমাদের দাবি মানা না হয়, তাহলে আমরণ অনশন চালিয়ে যাব৷''
বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, ছাত্র ইউনিয়ন গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি, গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, শ্রমিক আন্দোলন, গার্মেন্টস শ্রমিক সভা, বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতিসহ বিভিন্ন সংগঠনও অংশ নেয়৷
ঈদের আগে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, তিন মাসের বেতন বোনাস না পেয়ে গত ২৮শে জুলাই থেকে অনশন শুরু করেন তুবা গ্রুপের ১,৬০০ শ্রমিক৷ নবম দিন মঙ্গলবারেও তাঁরা অনশন অব্যাহত রেখেছেন৷ এ পর্যন্ত অনশনে প্রায় শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?