বগুড়ায় স্বজন হারানোর শোকের রথযাত্রা
১০ জুলাই ২০২৪রথের উচ্চতা ছিল ৩২ ফুট আর বিদ্যুতের তার ছিল ২৮ ফুট উঁচুতে। ১২ ফুট চওড়া রথটি লোহা আর কাঠের তৈরি রথটি রবিবার বিকাল ৫টায় বগুড়া শহরের সেউজগাড়ী ইসকন মন্দিরের কাছ থেকে যাত্রা শুরুর পর ১৫-১৬ হাজার ভক্ত রশি ধরে রথটি টানতে থাকেন। কিছুদূর যাওয়ার পরই সেউজগাড়ী আমতলায় বিদ্যুতের ১১ হাজার ভোল্টের তারের সঙ্গে রথের চূড়া স্পর্শ করে। এতে রথটি বিদ্যুতায়িত হয়। ফলে রথের ওপর ও নিচে থাকা প্রায় অর্ধশত ভক্ত বিদ্যুতায়িত হয়ে ছিটকে পড়েন। পাঁচজন নিহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ৩৭ জনকে।
জেলা প্রশাসন দাবি করছে তাদের পক্ষ থেকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল, কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষ শোনেনি। রথযাত্রার উদ্ধোধন করেন বগুড়া সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান, জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী। তারা উদ্বোধন করে দিলে রথ এগিয়ে যায় এবং ১৫ মিনিটের মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিকে ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। নিহতদের সৎকারের জন্য পরিবারকে ২৫ হাজার করে টাকা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
ঘটনার পর বগুড়া সদর থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে।
১৫ হাজারের বেশি ভক্ত প্রতি বছর এই উৎসবে যোগ দেন। এবারের রথযাত্রা সঠিকভাবে পালন ও সার্বিক আয়োজন নিরাপদ করার জন্য ১০০ জন সেবক ছিলেন। বগুড়া ইসকন আনন্দ আশ্রমের সভাপতি দিলীপ কুমার দেব বলেন," ২০০৬ সাল থেকে আমরা রথযাত্রা করে আসছি। দেশের ৩০টি মন্দিরে এই রথযাত্রা হয়। শুরু থেকেই আমাদের চূড়াসহ রথের উচ্চতা ৩২ ফুট। এর মূল কাঠামো ১২ ফুট উঁচু এবং চূড়া উঁচু ২০ ফুট। কাঠ এবং লোহা মিলিয়ে তৈরি করা রথের চূড়াটি লোহার রডের। ওই চূড়া ফোল্ডিং করে রথ নিচু করা যায়। কিন্তু ঘটনার সময় রথের ফোল্ডিং গিয়ার কাজ করেনি। ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটে।”
তার কথা, "রথ টেনে নেয়া হলেও রথে হাইড্রোলিক ব্রেক আছে। যখন বিদ্যুতের তারে চূড়া লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন ব্রেকও করা হয়েছিল। কিন্তু হাজার হাজার ভক্ত রথ টানতে থাকায় ওই ব্রেকেও কাজ হয়নি। রথগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে ইসকনের মেকানিকরা তৈরি করেন। এই ঘটনায় রথের চূড়া ফোল্ডিং-এর দায়িত্বে ছিলেন অলোক চন্দ্র ব্রহ্মচারী। তিনিও মারাগেছেন।”
ইসকন আনন্দ আশ্রমের সভাপতি দিলীপ কুমার দেবের দাবি, " জেলা প্রশাসন বা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে আমাদের কখনোই সতর্ক করা হয়নি। এবার দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা রথের উচ্চতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দিয়েছি। আর আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছি।”
বগুড়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩৭ জনের মধ্যে সাত জনকে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। তাদের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইহান ওলিউল্লাহ জানান," ঘটনার পর বগুড়া সদর থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে। আমরা এই দুর্ঘটনার কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত করছি। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেপ্তার করিনি। জেলা প্রশাসনও একটি তদন্ত কমিটি করেছে, তারা কী প্রতিবেদন দেয় তার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।”
তবে ইসকন আনন্দ আশ্রমের সভাপতি দিলীপ কুমার বলেন," এটা তো একটা দুর্ঘটনা। আমরা ইচ্ছা করে তো কিছু করিনি। এটা নিয়ে মামলা হবে কেন? আমরা কোনো মামলা করিনি।”
নিহতদ অলক কুমারের ভাইয়ের ছেলে বিশাল কুমার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রথযাত্রায় অনেক গাফিলতি ও ত্রুটি ছিল। মন্দির কমিটি, প্রশাসন, পুলিশ, বিদ্যুৎ বিভাগ কেউই সতর্ক ছিল না। কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ভারতে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। তারপর তো এখানে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।”
তার কথা, "বগুড়া শহরে এখন অনেক বিদ্যুতের তার। আগের মতো আর নেই। সেই বিবেচনা করে রথের উচ্চতা কমানো যেতো। সেটা না করেও যদি বিদ্যুতের তার যেখানে, তার বেশ দূরে থেকে রথের চূড়া ফোল্ডিং করে নিচু করা হতো, তাহলেও দুর্ঘটনা ঘটতো না। একদম কাছাকাছি গিয়ে চূড়া নামাতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে যদি যে এলাকা থেকে রথ যাবে, সেই সব এলাকার বিদ্যুৎ পার্যায়ক্রমে বন্ধ রাখা হতো তাহলেও এই দুর্ঘটনা ঘটতো না।”
"আমরা আসলে এখন আর কোনো ক্ষতিপূরণ বা সহায়তা চাই না। আমরা চাই ভবিষ্যতে যেন সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে রথযাত্রা করা হয়,” বলেন তিনি।
বগুড়ার নারায়ণ বিগ্রহ মন্দিরের সভাপতি চপল সাহা ইসকনের রথ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, "সনাতন ধর্মমতে লোহা, রড বা স্টিলের রথ করার নিয়ম নেই। ইসকন ছাড়া সারাদেশে যে রথ হয়, সেগুলো কাঠের তৈরি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনসহ অন্যরা কিন্তু কাঠের রথেই যুদ্ধ করেছেন। ইসকনের রথ কাঠের হলে বিদ্যুতায়িত হতো না।”
তিনি বলেন, "পুরো রথটিই তৈরি হয়েছিল লোহা দিয়ে। আর তার উচ্চতা ছিল বিদ্যুৎ লাইনের উচ্চতার চেয়ে বেশি। এটা প্রশাসনের এলাও করা ঠিক হয়নি। আর যারা তৈরি করেছেন, তারাও ঠিক করেননি। তারা পর্যাপ্ত সতর্কতাও নেননি। এর দায় নিতে হবে।”
"এর আগেও একবার বিদ্যুতের তারের সঙ্গে রথ লেগে গিয়েছিল। তখন কেউ মারা না গেলেও সেই ঘটনার পর থেকে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল,” বলেন তিনি।
রথযাত্রায় এমন দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বগুড়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মাসুদার রহমান হেলাল বলেন, "পাঁচজন মানুষের জীবন গেছে অবহেলার কারণে। সতর্ক না হওয়া, নিয়ম না মানা এইসব কারণে তাদের জীবন গেছে। এটাকে দুর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই।”
" এর সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। আর আহত ও নিহতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে, তারও ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন," আমরা প্রশাসনের দিক থেকে সব ধরনের সতর্কতা দিয়েছিলাম। নিরাপত্তা, কোন রোড দিয়ে যাবে, স্বেচ্ছাসেবক কত থাকবে...। পুলিশ, ম্যাজিষ্ট্রেট সব ব্যবস্থাই ছিল৷”
রথের উচ্চতার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আসলে ধর্মীয় বিষয় তো, তাই আমরা উচ্চতা নিয়ে কিছু বলিনি। তবে আমরা বলে দিয়েছিলাম যে, রথযাত্রা যেহেতু শহরের মধ্য দিয়ে যাবে, সেখানে অনেক বিদ্যুতের তার আছে, সেগুলো খেয়াল রেখে যেভাবে যাওয়া যায় সেভাবে যেতে হবে। সব ধরনের সতর্কতা আমরা দিয়েছি।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি মাত্র আজ (বুধবার) থেকে কাজ শুরু করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে বোঝা যাবে কারা দায়ী, কাদের অবহেলা ছিল। আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। তখন প্রয়োজন হলে দুর্ঘটনাজনিত হত্যা মামলা করা যাবে।”