সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধি দল রোববার বঙ্গভবনে এই স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার দ্য ডেইলি স্টার জানিয়েছে, সকাল ১১টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল বের করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজ শিক্ষার্থীরাও এই মিছিলে যোগ দেন।
মিছিল বঙ্গভবনের দিকে যেতে শুরু করলে গুলিস্তানে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। তবে এক পর্যায়ে ব্যারিকেড সরিয়ে তারা আবার বঙ্গভবনের দিকে যেতে থাকেন।
ডেইলি স্টার জানিয়েছে, কয়েক হাজার শিক্ষার্থী গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট এবং সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে পুরো সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এই আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে পরবর্তীতে ১০ জনকে বঙ্গভবনে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আদিল চৌধুরী স্মারকলিপি গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
চীন সফর নিয়ে করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনেও উঠে এসেছে কোটা নিয়ে আন্দোলনের ইস্যুটি। তিনি বলেন, আদালত থেকে রায় এলে সরকারের আর কিছু করার থাকে না।
তিনি বলেন, ''মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছেন। যখন মামলা করার পর আদালত যখন কোনো রায় দেন তখন সরকারের নির্বাহী বিভাগের কিছু করার থাকে না। কারণ আদালতের বিষয় আদালতেই সমাধান করতে হবে।''
কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, ''উদ্দেশ্যটা ছিল—আগে দেখ কোটা বাদ দিলে অবস্থাটা কী হয়। এখনো কী অবস্থা হয়েছে সেটা দেখতে বেশিদূর যাওয়া লাগবে না। এবারই দেখেন, ফরেন সার্ভিসে মাত্র দুই জন মেয়ে চাকরি পেয়েছেন। আর পুলিশ সার্ভিসে চার জন মেয়ে চান্স পেয়েছেন।''
তিনি আরো বলেন, ''কোটা বন্ধ করার আজকে ফলাফলটা কী দাঁড়াল। …আমাদের দেশের সব এলাকা সমানভাবে উন্নত নয়। কোনো কোনো এলাকায় অনগ্রসর সম্প্রদায়ও আছে। সেইসব এলাকার মানুষের কি কোনো অধিকার থাকবে না। কোটা বন্ধ করে দেওয়ার পরে ২৩টি জেলা থেকে একজনও পুলিশে চাকরি পাননি।''
কোটা নিয়ে ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই এর পর্যায়ে ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা। তবে এবারের আন্দোলনে ধ্বংসাত্মক কিছু হলে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ''রাজপথে আন্দোলন করছে, আন্দোলন করতেই থাকবে। তবে কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারবে না। যতক্ষণ তারা শান্তিপূর্ণভবে আন্দোলন করছে ততক্ষণ কেউ কিছু বলছে না। এর বাইরে যখন কিছু করবে, পুলিশের গাড়ি ভাঙবে, বা পুলিশের গায়ে হাত তুলবে তখন আইন তার নিজের গতিতে চলবে।''
২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের পর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল করে সরকার। ওই বছরেরই ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রিট করেন।
এ বছরের ৫ জুন এর রায় ঘোষণা হয়। রায়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ার বাধা দূর করার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। রায় স্থগিত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলাটিতে পক্ষভুক্ত হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া এবং উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান আবেদন করেন।
এরপর মঙ্গলবার (৯ জুলাই) আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে কোটা বহালে হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেয়।
হাইকোর্টের রায়ের পর থেকেই মূলত কোটা পদ্ধতি সংস্কার দাবি করে আবার আন্দোলনে নামে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। ৭ জুলাই থেকে 'বাংলা ব্লকেড' নামে অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়।
কোটা আন্দোলনের আদ্যোপান্ত
কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনের পর এক পরিপত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকার৷ ৫ জুন এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করে উচ্চ আদালত৷ এরপর আবারও শুরু হয়েছে আন্দোলন৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
পদযাত্রা ও অবস্থান কর্মসূচি
২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল, রোববার৷ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে পদযাত্রাসহ নানা কমর্সূচি পালন করে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’৷ পদযাত্রা কর্মসূচি শেষে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা৷
ছবি: bdnews24.com
দিনব্যাপী বিক্ষোভ
ওইদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকে৷ এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকবার উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীরা অনড় থাকে৷
ছবি: bdnews24.com
পুলিশের অ্যাকশন
রাত ৮টার দিকে লাঠিপেটা ও রাবার বুলেট-কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে অবরোধকারীদের উঠিয়ে দেয় পুলিশ৷ অবরোধকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে পিছু হটলে তাদের উপর ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর চড়াও হওয়ার অভিযোগ ওঠে৷
ছবি: bdnews24.com
সংঘাত
শাহবাগ ছাড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় রাতে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ চলে; পুলিশও তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে৷ দু’পক্ষের সংঘাত ছড়িয়ে পরে৷
ছবি: bdnews24.com
উপাচার্যের বাড়িতে ভাংচুর
গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে ভাঙচুর হয়৷ বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুরের পাশাপাশি দুটি গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়৷ ভাংচুর শুরুর আগে সব সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
উপাচার্যের অভিযোগ
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান৷ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তার প্রাণনাশের জন্যই বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে৷ তিনি আরো বলেন, এমন হামলা সাধারণ ছাত্ররা চালাতে পারে তার কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়৷
ছবি: bdnews24.com
সমঝোতা
২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল ওই সময়ের সড়ক যোগাযোগন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সরকারের একটি প্রতিনিধি দল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন৷ মীমাংসাও হয়৷ ফলে আলোচনায় অংশ নেয়া নেতারা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন৷ তবে আন্দোলনকারীদের একাংশ আন্দোলনে থেকে সরে আসেনি৷
ছবি: bdnews24
নারী অংশগ্রহণ
সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ নারী কোটা থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রচুর নারী অংশ নেন৷
ছবি: bdnews24
স্থবিরতা
ঢাকা তো বটেই পুরো দেশের অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই একে একে অচল হয়ে পড়ে৷ রাস্তা বন্ধ করে শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের আন্দোলন শুরু করেন৷
ছবি: bdnews24.com
প্রত্যাখ্যান ও প্রতিবাদ
দেশব্যাপী আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায়৷ আন্দোলনরতরা ছাত্রলীগের একাংশের নির্যাতন এবং সরকারের দুই মন্ত্রীর ‘আপত্তিকর’ বক্তব্যের প্রতিবাদে সমাবেশ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে৷
ছবি: bdnews24.com
অপেক্ষা
কোটা বৈষম্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য দাবি করে আন্দোলনকারীরা৷ ১১ এপ্রিল বিকালে প্রধানমন্ত্রী সংসদে এ বিষয়ে কথা বলছেন জানালে শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর৷
ছবি: bdnews24.com
অবশেষে অপেক্ষার অবসান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সব কোটা তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলে আন্দোলনকারীরা তার এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে আনন্দ মিছিল করে৷
ছবি: bdnews24.com
উচ্চ আদালতের রায়
২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন৷ রিটের শুনানিতে ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়৷ এ বছরের ৫ জুন সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট৷ সেই রায় ১১ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আবারও আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা
উচ্চ আদালতের রায়ের পর তারা কোটা সংস্কার দাবিতে আবারো রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থীরা৷ সরকারি চাকরির সব পদে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা৷ তারা মনে করছেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়৷
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে স্থিতাবস্থা দিয়েছে আপিল বিভাগ৷ ১০ জুলাই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ সিদ্ধান্ত দেয়৷ চার সপ্তাহ পর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে৷ এ সময়কালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে সরকারের দেয়া পরিপত্র বহাল থাকবে৷
ছবি: Suvra Kanti Das/ABACAPRESS/IMAGO
আন্দোলনের সবশেষ অবস্থা
শিক্ষার্থীদের অবরোধে ১০ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ৷ সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্লকেড চলে৷ সারা দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঢাকা৷ দাবি আদায়ে ১১ জুলাই আবারও সারা দেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা৷
ছবি: Habibur Rahman/aal.photo/IMAGO
বাংলা ব্লকেড
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের নাম দিয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’৷ এই কর্মসূচিতে শুরুতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোর অংশগ্রহণ ছিল৷ ধীরে ধীরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন৷