বছর আটেক আগের কথা৷ তখন আমি টিভি রিপোর্টার৷ সংবাদকর্মী হিসেবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি'-র সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব এসে পড়লো আমার কাঁধে৷
বিজ্ঞাপন
তখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেয়া ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ৷
যখন জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন থেকেই তার ব্যক্তিত্বের প্রতি আমি আগ্রহী৷ একই সঙ্গে তার হাস্যরসও আমার দারুণ পছন্দের৷ তাই সব মিলিয়ে চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল৷ রাষ্ট্রীয় আচার, রীতি-নীতি, নিরাপত্তার বেড়াজাল, নিরাপত্তারক্ষীদের সতর্ক দৃষ্টি- সব যোগ হয়ে চাপ অনুভব করছিলাম৷
ভাবলাম খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে রাষ্ট্রপতির ভাষণ৷ কখন কী বলেন, কোন পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ, তার নোট নিতে হবে৷ টেলিভিশনে কাজ করার একটা সুবিধা আছে, অনলাইন পোর্টাল বা সংবাদপত্রের মতো ‘কোট-আনকোট' লিখতে হয় না৷ কারণ, ক্যামেরায় সব বন্দি থাকে৷ সেখান থেকে নির্ধারিত অংশটা দর্শকদের দেখাতে হবে৷
কয়েকটা অনুষ্ঠান কভার করতে গিয়ে টের পেলাম, বেশিরভাগ সময় রাষ্ট্রপতির ভাষণ পূর্বলিখিত থাকে৷ রাষ্ট্রপতি নির্ধারিত পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে সেটি পাঠ করেন৷ তাই সংবাদ লিখতে গিয়ে খুব একটা বেগ পেতে হয় না৷ সংবাদটি নিজের মতো করে গুছিয়ে লেখাটা সহজ হয়ে দাঁড়ায়৷
স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করে যেহেতু রাষ্ট্রপতি তার ভাষণ দেন তাই ভিডিওগ্রাফারের রেকর্ড করা ভিডিও থেকে কাঙ্ক্ষিত অংশটি খুঁজে পেতে কোনো কষ্ট নেই৷ আট বছরের ব্যবধানে এখন আমি টিভি ছেড়ে অনলাইন সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছি৷ ফলে এখনো কানে হেডফোন গুঁজে শুনে শুনে কোট লেখার যাতনাটাও নেই৷
আর কখনোর যদি লিখিত বক্তব্যে বাইরে কিছু বলেন, তার পুরোটা জুড়ে থাকে হাস্যরস৷ তার মেলা উদাহরণ আছে৷ প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, হার্টহীন মানুষ নিয়ে রাষ্ট্রপতির বলা এমন অনেক কথা ভাইরালও হয়েছে৷
কিন্তু ঝামেলাটা হয় অন্য জায়গায়৷ রাষ্ট্রপতির যেসব অনুষ্ঠানে রিপোর্টারদের অংশ নেয়ার সুযোগ থাকে না, সেসব অনুষ্ঠানের সংবাদ পাওয়াটা বেশ কঠিন৷ ধরা যাক, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে বঙ্গভবন এলেন ঢাকা সফরে আসা কোনো দেশের মন্ত্রী৷ এমন আয়োজনে রিপোর্টারদের বঙ্গভবনে প্রবেশের সুযোগ নেই৷
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এম ইদ্রিস৷ বর্তমানে কাজী হাবিবুল আউয়াল৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের নির্বাচন কমিশনগুলো সম্পর্কে জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Asif Mahmud Ove
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এম ইদ্রিস৷ ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি ৷ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে এই কমিশন৷ সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। নির্বাচনে ২৯৩ আসন জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। জাসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ একটি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পাঁচটি আসন পায়।
ছবি: AP
নুরুল ইসলাম কমিশন
বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব পালন করা সিইসি৷ ১৯৭৭ সালের ৮ জুলাই যখন দায়িত্ব নেন, তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান৷ প্রায় আট বছর দায়িত্ব পালনের পর অব্যাহতি নেন ১৯৮৫ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি৷ ৷ ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয় তার তত্ত্বাবধানে। বিএনপি পায় ২০৭ আসন, আবদুল মালেক উকিলের আওয়ামী লীগ ৩৯ আসন৷
ছবি: imago stock&people
তিন রাষ্ট্রপতির কমিশন
পরপর দুই সামরিক শাসকের অধীনে সিইসির দায়িত্ব পালন করেছেন নুরুল ইসলাম৷ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ‘সামরিক অভ্যুত্থানে’ ক্ষমতায় আসেন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। পরবর্তীতে এরশাদের সরকারে আইনমন্ত্রী ও পরে উপ রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন নুরুল ইসলাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Rahman
মসউদ কমিশন
বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ দায়িত্ব নেন ১৯৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি৷ তিনি পূর্ণ পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করেন ১৯৯০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি৷ এরশাদের আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এই কমিশনের অধীনে৷ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোট গেলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট তা বর্জন করে। চতুর্থ জাতীয় নির্বাচন দুই জোটই বর্জন করে৷
ছবি: DW
সুলতান কমিশন
বিচারপতি সুলতান হোসেন খান ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ তবে মাত্র ১০ মাস দায়িত্বে থেকে কোনো জাতীয় নির্বাচন না করেই ২৪ ডিসেম্বর সরে যেতে বাধ্য হন এরশাদের নিয়োগ পাওয়া এই সিইসি৷ গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হলে প্রধান দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতৈক্যে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ৷ এরপর তিনি ইসি পুনর্গঠন করেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রউফ কমিশন
পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রথম তিন সদস্যের ইসি পায় বাংলাদেশ। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ সিইসি হিসেবে নিযু্ক্ত হন৷ ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে তার কমিশন৷ তিনি ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন৷ রউফ কমিশন নির্বাচনি আইনে ব্যাপক সংস্কার আনে, জারি করা হয় নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কিত হন সিইসি রউফ।
ছবি: AP
সাদেক কমিশন
বিচারপতি একেএম সাদেক সিইসি পদে নিযুক্ত হন ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল৷ ১৯৯৬ সালে এই কমিশনের অধীনেই হয় বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো ভোট বর্জন করে। বিএনপি পায় ২৭৮ আসন৷ দেড় মাস মেয়াদী সংসদের একমাত্র অধিবেশনে ত্রয়োদশ সংশোধনে সংবিধানে যুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা৷ এই ইসিই নির্বাচনি আচরণবিধি চালু করে৷
ছবি: AP
হেনা কমিশন
১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতার মধ্যে সাবেক আমলা মোহাম্মদ আবু হেনা ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ এই প্রথম কোনো আমলা এই পদে নিয়োগ পান৷ তার অধীনে ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল (সখিপুর-বাসাইল) উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির জন্য সমালোচিত হয় তার কমিশন৷ নির্বাচনের গেজেট না করেই ২০০০ সালের ৮ মে দায়িত্ব ছাড়েন আবু হেনা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সাঈদ কমিশন
রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদপূর্তির পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই দায়িত্বে আনে একানব্বইয়ের নির্বচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা শাহাবুদ্দিন আহমেদকে। আবু হেনা সরে যাওয়ার পর সিইসি হন সাবেক আমলা এম এ সাঈদ৷ বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সাঈদ কমিশনের অধীনেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন হয়।
ছবি: Mustafiz Mamun
আজিজ কমিশন
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত কমিশনগুলোর একটি আজিজ কমিশন৷ বিচারপতি এমএ আজিজ ২০০৫ সালের ২২ মে সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ ব্যাপক রাজনৈতিক টানাপড়েনের সময় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন৷ পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ তফসিল বাতিল করেন৷ ২১ জানুয়ারি কোনো জাতীয় নির্বাচন আয়োজন না করেই পদত্যাগ করেন এম এ আজিজ৷
ছবি: DW
শামসুল হুদা কমিশন
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমএ আজিজের উত্তরসূরী হন এটিএম শামসুল হুদা৷ তার কমিশন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে৷ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন হয় ওই কমিশনের সময়েই। সংলাপ করে নির্বাচনি আইন সংস্কার করা হয়। চালু হয় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম ও ইভিএম। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০, বিএনপি ৩০ ও জাতীয় পার্টি ২৭ আসন পায়।
ছবি: DW/Muhammad Mostafigur Rahman
রকিবুদ্দিন কমিশন
ইসি পুনর্গঠনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের পর সার্চ কমিটি গঠন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। ২০১২ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেন সাবেক আমলা কাজী রকিবুদ্দিন আহমদ৷ সংসদে বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা৷ ক্ষমতাসীন দলের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়৷ বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের বর্জন করা নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷
ছবি: DW
নুরুল হুদা কমিশন
এবারও সংলাপ আয়োজন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবুল হামিদ৷ সিইসি করা হয় সাবেক আমলা কে এম নুরুল হুদাকে৷ দ্বাদশ ইসির যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের নতুন কার্যালয় নির্বাচন ভবনে। তার অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ পাওয়ায় যায়৷ বর্তমান কমিশনের মেয়াদ রয়েছে ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
ছবি: bdnews24
13 ছবি1 | 13
করোনাভাইরাস মহামারির আগে বিটিভি ও বেসরকারি চ্যানেলগুলোর মধ্যে কয়েকটি ক্যামেরার মাধ্যমে চিত্রধারণের সুযোগ দেয়া হতো৷ কিন্তু অতিমারির কারণে সেই সুযোগটিও নেই৷ আর রিপোর্টারদের ঢোকার সুযোগ কখনো ছিল না৷
আর এ ধরনের অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহ বেশ কঠিন৷ তথ্য সংগ্রহে বেগ পেতে হয় খুব৷ তথ্য পেতে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং ছাড়া কোনো বিকল্প নেই৷
রাষ্ট্রপতির সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে নিযুক্ত সংবাদকর্মীদের নিয়ে ‘বঙ্গভবন প্রেস উইং' নামের একটি ক্লোজড ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়েছে৷ প্রেস উইংয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা তাদের সময়, সুযোগ অনুযায়ী সেই গ্রুপে তথ্যটি দেন৷ এরপর গণমাধ্যমকর্মীরা সেটা প্রচার করেন৷
মাঝে মাঝে কোনোরকম একটু তথ্য পাওয়া গেলেও আটকে থাকতে হয় ছবির জন্য৷ প্রেস উইংয়ের কাছে আবার অনুরোধ জানাতে হয় ছবির জন্য৷
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশ যখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেই সময় দেশের রাষ্ট্রপতির নামে নেই কোনো ভেরিফায়েড অফিশিয়াল টুইটার বা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট৷
গেল ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে যোগ দিতে ঢাকা আসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷
করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর যা ছিল রাম নাথ কোবিন্দের প্রথম বিদেশ সফর৷ ঢাকার হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিনি যখন নামলেন, তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ৷
কিন্তু সেই ছবিটি পেতে পিআইডির ওয়েবসাইট খুলে দীর্ঘ সময় বসে থাকলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না৷ তখন টুইটার থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতির অফিসিয়াল অ্যাাকাউন্ট ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া' খুঁজে বের করি৷
সেই অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া গেল বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির ছবি৷ ছবি প্রকাশ করা হতো তাৎক্ষণিকভাবেই৷ সঙ্গে থাকতো ক্যাপশনও৷
ওই সময়টাতে তাৎক্ষণিক নিউজ প্রচারে একটি বড় ও আস্থাশীল সোর্স হিসেবে সেই অ্যাকাউন্ট হয়ে উঠলো আমার ত্রাতা৷ তার সফরসূচির সবশেষ আপডেট যেমন পাচ্ছি, প্রতি মুহূর্তে পাচ্ছি ঘটনার ছবি৷
বিপরীতে আমাদের বঙ্গভবনের প্রেস উইংয়ের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যত চোখে পড়েনি৷ হলে বোধহয় সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি খুশি হতো৷
সাম্প্রতিক আরেকটা উদাহরণ সামনে আনা যাক৷ দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে গত ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের বিচারক বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি৷ তার একদিন আগে থেকেই এমন খবরে ছেয়ে গেছে ফেসবুক৷
কিন্তু বিষয়টি অফিশিয়ালি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকলেন পেশাদার সাংবাদিকরা৷ আর যেহেতু প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির, তাই এ সংবাদটি আসার কথা প্রেস উইং থেকে৷ কিন্তু সেদিন প্রেস উইংয়ে ফেসবুক পেজে কোনো আপডেট আসে না৷ প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তারা জানালেন, এ বিষয়ে প্রেস সেক্রেটারি জানাবেন৷ কিন্তু অজ্ঞাত কারণে প্রেস সচিব ফোনই ধরছেন না৷
পরে অবশ্য আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল আমাকে৷ ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিবকে পাওয়া গেল৷ তিনি জানালেন, ঘটনা সত্য৷
কিন্তু অফিশিয়াল কোনো ফেসবুক বা টুইটার অ্যাকাউন্ট থাকলে খুব সহজেই সবার কাছে নির্ভুলভাবে পৌঁছানো যেতো বার্তাটি৷ থাকতো না কোনো সংশয়, সন্দেহ, গুজবের ক্ষেত্রে টানা যেতো লাগাম৷
এবার আসা যাক নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগের বিষয়ে৷ কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে আর মাসখানেকের মধ্যে৷ তাই নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গন৷ সরগরমের কারণটাও সহজ৷ এই নতুন কমিশনের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷
বর্তমান কমিশন নিয়ে অনাস্থা জানিয়ে আসছে বিএনপি৷ যদিও বর্তমান কমিশনের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে দলটি৷
আর এসব ঘিরে কদিন ধরেই বঙ্গভবন আলোচনার তুঙ্গে৷ কারণ নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে শুরু হয়েছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সংলাপ৷
নিবন্ধিত ৩৮টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইংয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৩১টি দলকে ডাকা হয়েছে বঙ্গভবনে৷
সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে গত ২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় এই সংলাপ৷ ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ২০টি দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ হওয়ার কথা ছিল৷ তবে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি চারটি দল: বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)৷
১২ জানুয়ারি বিএনপিকে সংলাপে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রণ জানালেও এখন পর্যন্ত না যাওয়ার কথা জানিয়ে রেখেছে দলটি৷ ধারণা করা হচ্ছে অবশিষ্ট ১৮টি দলের মধ্যে বিএনপিপন্থি দলগুলো সংলাপ বর্জন করতে পারে৷ আর আওয়ামী লীগের সমর্থনে থাকা দলগুলো ঠিকই বঙ্গভবনে যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রস্তাব রাখছে৷
সঙ্গত কারণেই সংলাপে থাকার সুযোগ মিলছে না গণমাধ্যমকর্মীদের৷ তবে সংলাপ শেষে বঙ্গভবন থেকে ফেসবুক গ্রুপে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায় রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং৷ এর আগেরবারও সাংবাদিকদের বঙ্গভবনে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়নি৷
আর এখন তো করোনাভাইরাস মহামারি৷ ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের সুযোগটা আরো সীমিত করা হয়েছে৷ তাই প্রেস উইংয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিই এখন ভরসা সাংবাদিকদের জন্য৷ যদিও সংবাদকর্মীদের কৌতুহুলের তুলনায় তথ্য সেখানে অপ্রতুল৷
২০১২ সাল থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে চার কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে দেশে৷
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ২০১২ সালে এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৭ সালে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছিলেন৷
কিন্তু এবারই প্রথম রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সংলাপে অংশ নিতে বঙ্গভবন যায়নি চারটি দল৷ না যাওয়ার অবস্থান জানিয়েছে বিএনপি৷ সেই সংখ্যাটা আরো বাড়ার শঙ্কা রয়েছে৷
এই বর্জনের কারণে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করে আসা আবদুল হামিদ বা জাতির মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক ‘বঙ্গভবন' বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, কেউ সংলাপে না এলেও নির্বাচন কমিশন গঠন থেমে থাকবে না৷
গত দুইবারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নতুন বছরের আগেই মধ্য ডিসেম্বরে সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেন রাষ্ট্রপতি৷ মধ্য জানুয়ারিতে সংলাপ শেষ হয়৷ সার্চ কমিটি গঠিত হয় জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে; নাম প্রস্তাব, বাছাই শেষে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের নাম প্রকাশ করা হয়৷ এবার কী হতে যাচ্ছে, তার জন্য একটু অপেক্ষায় তো থাকতেই হচ্ছে৷
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
বাংলাদেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উঠে যাবার পর দক্ষিণ এশিয়াতে কেবল পাকিস্তানেই এটি চালু আছে৷ তবে এ অঞ্চলে যেমন রাজতন্ত্র আছে, তেমনি আছে এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো গণতন্ত্রও৷
ছবি: Wakil Kohsar/AFP/Getty Images
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন, ভোটার তালিকা তৈরি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ, সকল স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন ও আনুষঙ্গিক কার্যাদির সুষ্ঠু সম্পাদন কমিশনের দায়িত্ব৷ কমিশন স্বাধীন এবং কেবল সংবিধান ও আইনের অধীন হবেন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।
ছবি: DW/M. M. Rahman
ভারতের নির্বাচন কমিশন
ভারতের নির্বাচন কমিশন পাঁচটি স্বায়ত্ত্বশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের একটি৷ মূলত লোক সভা, রাজ্য সভা, রাজ্যের বিধানসভা, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করার দায়িত্ব কমিশনের৷ এছাড়া কোনো বিশেষ সময়ে যখন বিদ্যমান আইনে সুরাহা হচ্ছে না, তখন নির্বাচন কমিশনের সেখানে ‘যথাযথ উপায়ে’ ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা আছে৷
ছবি: A.K Chatterjee
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে৷ কোনো সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হবার পর বা কোনো কারণে সংসদ বিলুপ্তির পর এই সরকার দায়িত্ব নেয়৷ তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে৷ তবে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের৷ কমিশন জাতীয়, প্রাদেশিক ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করে৷
ছবি: AAMIR QURESHI/AFP/Getty Images
শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশন
এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো গণতন্ত্র হলো শ্রীলঙ্কা৷ সেখানেও রাষ্ট্রপতি, সংসদ, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের৷
ছবি: AP
মালদ্বীপের নির্বাচন কমিশন
মালদ্বীপে আলাদা নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে মাত্র এক দশক আগে৷ ২০০৮ সালের আগষ্টে এই স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয় নির্বাচন আয়োজন করত৷ পরে এই অফিসটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অধীনে চলে যায়৷ রাষ্ট্রপতিই কমিশনার নিয়োগ দিতেন৷
ছবি: ADAM SIREII/AFP/Getty Images
নেপালের নির্বাচন কমিশন
১৯৫০ সালের নেপাল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নেপালের নির্বাচন কমিশনের জন্ম৷ এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান৷ শুধু জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠানই নয়, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নিবন্ধন করার দায়িত্ব রয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশনের কাঁধে৷ ছয় জন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত কমিশন ছয় বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে৷
ছবি: PRAKASH MATHEMA/AFP/Getty Images
ভূটানের নির্বাচন কমিশন
ভূটানে রাজতন্ত্র আছে৷ তবে সংসদও আছে৷ সংসদের নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন৷ প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, সংসদের স্পিকার, জাতীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের প্রধানের দেয়া তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দুইজন কমিশনারকে নিয়োগ দেন রাজা৷ কমিশনের ক্ষমতাও অনেক৷ নির্বাচন ছাড়াও বিধি তৈরি, নির্বাচন পদ্ধতি রিভিউ করাসহ যে কাউকে তলব, তদন্ত ও কিছু অ্যাডজান্কটিভ ক্ষমতা রয়েছে৷
ছবি: AP
আফগানিস্তানের নির্বাচন কমিশন
যুদ্ধ-বিগ্রহ আর সহিংসতার কারণে আফগানিস্তানে ক্ষমতা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে৷ সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতাতেও তার প্রভাব পড়েছে৷ তবে সংবিধান অনুযায়ী, রেফারেন্ডাম, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের৷