1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বঙ্গভবন ও সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ

৭ জানুয়ারি ২০২২

বছর আটেক আগের কথা৷ তখন আমি টিভি রিপোর্টার৷ সংবাদকর্মী হিসেবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি'-র সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব এসে পড়লো আমার কাঁধে৷

Abdul Hamid Präsident Bangladesh 29.10.2013
ছবি: Getty Images

তখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেয়া ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ৷

যখন জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন থেকেই তার ব্যক্তিত্বের প্রতি আমি আগ্রহী৷ একই সঙ্গে তার হাস্যরসও আমার দারুণ পছন্দের৷ তাই সব মিলিয়ে চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল৷ রাষ্ট্রীয় আচার, রীতি-নীতি, নিরাপত্তার বেড়াজাল, নিরাপত্তারক্ষীদের সতর্ক দৃষ্টি- সব যোগ হয়ে চাপ অনুভব করছিলাম৷

ভাবলাম খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে রাষ্ট্রপতির ভাষণ৷ কখন কী বলেন, কোন পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ, তার নোট নিতে হবে৷ টেলিভিশনে কাজ করার একটা সুবিধা আছে, অনলাইন পোর্টাল বা সংবাদপত্রের মতো ‘কোট-আনকোট' লিখতে হয় না৷ কারণ, ক্যামেরায় সব বন্দি থাকে৷ সেখান থেকে নির্ধারিত অংশটা দর্শকদের দেখাতে হবে৷

কয়েকটা অনুষ্ঠান কভার করতে গিয়ে টের পেলাম, বেশিরভাগ সময় রাষ্ট্রপতির ভাষণ পূর্বলিখিত থাকে৷ রাষ্ট্রপতি নির্ধারিত পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে সেটি পাঠ করেন৷ তাই সংবাদ লিখতে গিয়ে খুব একটা বেগ পেতে হয় না৷ সংবাদটি নিজের মতো করে গুছিয়ে লেখাটা সহজ হয়ে দাঁড়ায়৷

স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করে যেহেতু রাষ্ট্রপতি তার ভাষণ দেন তাই ভিডিওগ্রাফারের রেকর্ড করা ভিডিও থেকে কাঙ্ক্ষিত অংশটি খুঁজে পেতে কোনো কষ্ট নেই৷ আট বছরের ব্যবধানে এখন আমি টিভি ছেড়ে অনলাইন সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছি৷ ফলে এখনো কানে হেডফোন গুঁজে শুনে শুনে কোট লেখার যাতনাটাও নেই৷

আর কখনোর যদি লিখিত বক্তব্যে বাইরে কিছু বলেন, তার পুরোটা জুড়ে থাকে হাস্যরস৷ তার মেলা উদাহরণ আছে৷ প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, হার্টহীন মানুষ নিয়ে রাষ্ট্রপতির বলা এমন অনেক কথা ভাইরালও হয়েছে৷

কিন্তু ঝামেলাটা হয় অন্য জায়গায়৷ রাষ্ট্রপতির যেসব অনুষ্ঠানে রিপোর্টারদের অংশ নেয়ার সুযোগ থাকে না, সেসব অনুষ্ঠানের সংবাদ পাওয়াটা বেশ কঠিন৷ ধরা যাক, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে বঙ্গভবন এলেন ঢাকা সফরে আসা কোনো দেশের মন্ত্রী৷ এমন আয়োজনে রিপোর্টারদের বঙ্গভবনে প্রবেশের সুযোগ নেই৷

করোনাভাইরাস মহামারির আগে বিটিভি ও বেসরকারি চ্যানেলগুলোর মধ্যে কয়েকটি ক্যামেরার মাধ্যমে চিত্রধারণের সুযোগ দেয়া হতো৷ কিন্তু অতিমারির কারণে সেই সুযোগটিও নেই৷ আর রিপোর্টারদের ঢোকার সুযোগ কখনো ছিল না৷

আর এ ধরনের অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহ বেশ কঠিন৷ তথ্য সংগ্রহে বেগ পেতে হয় খুব৷ তথ্য পেতে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং ছাড়া কোনো বিকল্প নেই৷

রাষ্ট্রপতির সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে নিযুক্ত সংবাদকর্মীদের নিয়ে ‘বঙ্গভবন প্রেস উইং' নামের একটি ক্লোজড ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়েছে৷ প্রেস উইংয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা তাদের সময়, সুযোগ অনুযায়ী সেই গ্রুপে তথ্যটি দেন৷ এরপর গণমাধ্যমকর্মীরা সেটা প্রচার করেন৷

মাঝে মাঝে কোনোরকম একটু তথ্য পাওয়া গেলেও আটকে থাকতে হয় ছবির জন্য৷ প্রেস উইংয়ের কাছে আবার অনুরোধ জানাতে হয় ছবির জন্য৷

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশ যখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেই সময় দেশের রাষ্ট্রপতির নামে নেই কোনো ভেরিফায়েড অফিশিয়াল টুইটার বা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট৷

গেল ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে যোগ দিতে ঢাকা আসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷

করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর যা ছিল রাম নাথ কোবিন্দের প্রথম বিদেশ সফর৷ ঢাকার হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিনি যখন নামলেন, তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ৷

কিন্তু সেই ছবিটি পেতে পিআইডির ওয়েবসাইট খুলে দীর্ঘ সময় বসে থাকলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না৷ তখন টুইটার থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতির অফিসিয়াল অ্যাাকাউন্ট ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া' খুঁজে বের করি৷

সেই অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া গেল বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির ছবি৷ ছবি প্রকাশ করা হতো তাৎক্ষণিকভাবেই৷ সঙ্গে থাকতো ক্যাপশনও৷

ওই সময়টাতে তাৎক্ষণিক নিউজ প্রচারে একটি বড় ও আস্থাশীল সোর্স হিসেবে সেই অ্যাকাউন্ট হয়ে উঠলো আমার ত্রাতা৷ তার সফরসূচির সবশেষ আপডেট যেমন পাচ্ছি, প্রতি মুহূর্তে পাচ্ছি ঘটনার ছবি৷

বিপরীতে আমাদের বঙ্গভবনের প্রেস উইংয়ের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যত চোখে পড়েনি৷ হলে বোধহয় সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি খুশি হতো৷

সাম্প্রতিক আরেকটা উদাহরণ সামনে আনা যাক৷ দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে গত ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের বিচারক বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি৷ তার একদিন আগে থেকেই এমন খবরে ছেয়ে গেছে ফেসবুক৷

কিন্তু বিষয়টি অফিশিয়ালি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকলেন পেশাদার সাংবাদিকরা৷ আর যেহেতু প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির, তাই এ সংবাদটি আসার কথা প্রেস উইং থেকে৷ কিন্তু সেদিন প্রেস উইংয়ে ফেসবুক পেজে কোনো আপডেট আসে না৷ প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তারা জানালেন, এ বিষয়ে প্রেস সেক্রেটারি জানাবেন৷ কিন্তু অজ্ঞাত কারণে প্রেস সচিব ফোনই ধরছেন না৷

পরে অবশ্য আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল আমাকে৷ ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিবকে পাওয়া গেল৷ তিনি জানালেন, ঘটনা সত্য৷

কিন্তু অফিশিয়াল কোনো ফেসবুক বা টুইটার অ্যাকাউন্ট থাকলে খুব সহজেই সবার কাছে নির্ভুলভাবে পৌঁছানো যেতো বার্তাটি৷ থাকতো না কোনো সংশয়, সন্দেহ, গুজবের ক্ষেত্রে টানা যেতো লাগাম৷

এবার আসা যাক নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগের বিষয়ে৷ কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে আর মাসখানেকের মধ্যে৷ তাই নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গন৷ সরগরমের কারণটাও সহজ৷ এই নতুন কমিশনের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷

বর্তমান কমিশন নিয়ে অনাস্থা জানিয়ে আসছে বিএনপি৷ যদিও বর্তমান কমিশনের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে দলটি৷

আর এসব ঘিরে কদিন ধরেই বঙ্গভবন আলোচনার তুঙ্গে৷ কারণ নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে শুরু হয়েছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সংলাপ৷

তানজীর মেহেদী, সাংবাদিকছবি: Privat

নিবন্ধিত ৩৮টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইংয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৩১টি দলকে ডাকা হয়েছে বঙ্গভবনে৷

সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে গত ২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় এই সংলাপ৷ ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ২০টি দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ হওয়ার কথা ছিল৷ তবে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি চারটি দল: বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)৷

১২ জানুয়ারি বিএনপিকে সংলাপে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রণ জানালেও এখন পর্যন্ত না যাওয়ার কথা জানিয়ে রেখেছে দলটি৷ ধারণা করা হচ্ছে অবশিষ্ট ১৮টি দলের মধ্যে বিএনপিপন্থি দলগুলো সংলাপ বর্জন করতে পারে৷ আর আওয়ামী লীগের সমর্থনে থাকা দলগুলো ঠিকই বঙ্গভবনে যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রস্তাব রাখছে৷

সঙ্গত কারণেই সংলাপে থাকার সুযোগ মিলছে না গণমাধ্যমকর্মীদের৷ তবে সংলাপ শেষে বঙ্গভবন থেকে ফেসবুক গ্রুপে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায় রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং৷ এর আগেরবারও সাংবাদিকদের বঙ্গভবনে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়নি৷

আর এখন তো করোনাভাইরাস মহামারি৷ ফলে গণমাধ্যমকর্মীদের সুযোগটা আরো সীমিত করা হয়েছে৷ তাই প্রেস উইংয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিই এখন ভরসা সাংবাদিকদের জন্য৷ যদিও সংবাদকর্মীদের কৌতুহুলের তুলনায় তথ্য সেখানে অপ্রতুল৷

২০১২ সাল থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে চার কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে দেশে৷

সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ২০১২ সালে এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৭ সালে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছিলেন৷

কিন্তু এবারই প্রথম রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সংলাপে অংশ নিতে বঙ্গভবন যায়নি চারটি দল৷ না যাওয়ার অবস্থান জানিয়েছে বিএনপি৷ সেই সংখ্যাটা আরো বাড়ার শঙ্কা রয়েছে৷

এই বর্জনের কারণে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করে আসা আবদুল হামিদ বা জাতির মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক ‘বঙ্গভবন' বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, কেউ সংলাপে না এলেও নির্বাচন কমিশন গঠন থেমে থাকবে না৷

গত দুইবারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নতুন বছরের আগেই মধ্য ডিসেম্বরে সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেন রাষ্ট্রপতি৷ মধ্য জানুয়ারিতে সংলাপ শেষ হয়৷ সার্চ কমিটি গঠিত হয় জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে; নাম প্রস্তাব, বাছাই শেষে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের নাম প্রকাশ করা হয়৷ এবার কী হতে যাচ্ছে, তার জন্য একটু অপেক্ষায় তো থাকতেই হচ্ছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ