দক্ষিণ এশিয়ার মৌসুমী আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছেন৷ বঙ্গোপসাগরে একটি রোবোট ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা, যার মাধ্যমে জানা যাবে কীভাবে সাগরের পরিস্থিতি বৃষ্টির ধরণে প্রভাব ফেলছে৷
বিজ্ঞাপন
সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে৷ বছরের ৭০ ভাগ বৃষ্টিপাতই হয় এই সময়টাতে৷ গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশ ও ভারতের কোটি কৃষক অপেক্ষায় থাকে কখন হবে বৃষ্টিপাত আর কখন জমির ফসল পানি পাবে৷ কেননা বৃষ্টির অভাবে দেখা দিতে পারে খরা, নষ্ট হতে পারে ক্ষেতের ফসল৷
বৃষ্টিপাত কখন হবে গত কয়েক বছরে এর পূর্বাভাস দেয়া বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে এ সব অঞ্চলে৷ কেননা বৈশ্বিক আবহাওয়া এবং সাগরের আচরণ জটিল হয়ে ওঠায় এ ব্যাপারে পূর্বানুমান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক হচ্ছে না৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন এবং বায়ুদূষণ বৃদ্ধি৷
এটা কি জলবায়ু পরিবর্তন?
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা – এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য কি জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী? নাকি এটা কাকতালীয়? ‘ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ একটি নতুন প্রতিবেদনে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে৷
ছবি: Fotolia/Daniel Loretto
আবহাওয়া এবং জলবায়ু
কখন আপনি এটাকে জলবায়ু পরিবর্তন বলবেন? যখন কয়েকদিন ধরে মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি হবে? নাকি বন্যার পানিতে তলিয়ে যাবে জমির ফসল? নাকি একটা পর একটা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে কোনো কারণ ছাড়াই? এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে আসলেই জলবায়ু পরিবর্তনের কোন যোগসূত্র আছে কিনা – তা বের করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন গবেষকরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকি বাড়ছে
এখনো বিজ্ঞানীদের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার ব্যাপক রকমফের হচ্ছে৷ একটি গবেষণায় তাঁরা ২০১২ সালের ১২টি দুর্যোগ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, এর মধ্যে অর্ধেক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ঘটেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দাবদাহ এবং খরার জন্য দায়ী
যুক্তরাষ্ট্রে দাবদাহ এবং খরার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করা হয়েছে৷ ২০১২ সালের জুলাই মাসে সেখানে ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে৷ এছাড়া কম বৃষ্টিপাতের কারণে সেখানে গম এবং শস্যের ফলনও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
সুমেরুর বরফ গলছে
আর একটি কারণ সুমেরুর বরফ৷ ২০১২ সালে আগের বছরগুলোর তুলনায় অধিক মাত্রায় বরফ গলেছে সেখানে৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা হঠাৎ করে হয়নি বরং গ্রীষ্মকালীন প্রচণ্ড গরম তাপমাত্রা এর জন্য দায়ী৷ তাঁদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী৷
ছবি: DW/I.Quaile
ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি
ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় ছিল৷ এর ব্যাপ্তি ছিল ৩ হাজার কিলোমিটার৷ স্যান্ডি এত শক্তিশালী হওয়ার কারণ ২০১২ সালে আটলান্টিক বা অতলান্ত মহাসাগর স্বাভাবিকের চেয়ে উত্তপ্ত ছিল৷ বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই এর জন্য দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
বৃষ্টি এবং বন্যা
তবে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে গবেষকরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি৷ ইউরোপ, চীন, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রবল বৃষ্টিপাতকে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সোমালিয়া এবং কেনিয়ার খরা
এমনকি সোমালিয়া ও কেনিয়ার ভয়াবহ খরার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন নয় বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ বলছেন, এটা আবহাওয়ার বৈচিত্রের কারণে হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নয়৷ তবে এ বিষয়ে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত নন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঘটনা এবং সংস্কার
জলবায়ু আসলেই বেশ জটিল ব্যাপার৷ বাস্তবে বিশ্বের প্রকৃতিতে কি কারণে কি ঘটছে, তা অনেক উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত৷ তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে৷ আর একটি বিষয় হলো মানুষের আচরণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী৷ এ কারণেই সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে, সেই সাথে দ্বীপগুলোর জন্য বাড়ছে ঝুঁকিও৷
ছবি: picture alliance/chromorange
সামুদ্রিক প্রাণীরা ঝুঁকির মুখে
কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সাগরে অম্লতার পরিমাণ বেড়ে গেছে৷ ফলে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক – এগুলো ঝুঁকির মুখে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
অতিরঞ্জন বাস্তব বর্জিত
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই৷ এর কারণ হয়ত ইস্যুটি নিয়ে অত্যধিক মাত্রায় আলোচনা৷ কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, এর ফলে বিজ্ঞানের সত্যতা হুমকির মুখে পড়বে, হুমকির মুখে পড়বে মানবজাতিও৷
ছবি: Reuters
10 ছবি1 | 10
ইস্ট অ্যাঙ্গোলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং প্রধান গবেষক আদ্রিয়ান ম্যাথুস বলেছেন, সাগরের আচরণ সঠিকভাবে বোঝার লক্ষ্যেই তাঁরা এ প্রকল্প নিয়েছেন৷ তবে এর প্রধান লক্ষ্য ভারতীয় উপমহাদেশে বৃষ্টির সঠিক পূর্বাভাস দেয়া৷
এই প্রকল্পে খরচ হচ্ছে ১ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার৷ বিজ্ঞানীরা আগামী একমাস ধরে বঙ্গোপসাগরে এ পরীক্ষা চালাবেন৷ সে লক্ষ্যে সাতটি রোবট সমুদ্রে ছাড়বেন তারা৷ যে রোবটগুলো সমুদ্রগর্ভে যেতে সক্ষম৷ টর্পেডো আকৃতির রোবোটগুলোতে পানির মধ্যে পরিচালনা করা হবে জাহাজ থেকে৷ তারা সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা, তাপমাত্রা আর স্রোতের সঠিক পরিমাপ জানাবে৷ ভারত সরকারের সহায়তায় ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং এর বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে এই পরীক্ষা চালাচ্ছে৷
রোবটগুলো থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বর্ষায় সাগরের পরিস্থিতি ভালো বুঝতে পারবেন বলে আশা করছেন৷ এ বছর ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষা এসেছেন ৮ জুন, সাধারণত এর এক সপ্তাহ আগেই বৃষ্টি শুরু হওয়ার কথা৷ ভারতের মধ্য, পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে এবার ব্যাপক খরা হওয়ায় ভারত সরকার এ গবেষণার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহী৷
জলবায়ু পরিবর্তনের শক্তিশালী কয়েকটি ছবি
জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করা যায়৷ একটি সংস্থা প্রবাল প্রাচীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সেটা আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
দুই মাস আগে, পরে
জলবায়ু যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝার অন্যতম উপায় প্রবালের দিকে খেয়াল করা৷ উপরে যে ছবিটি দেখছেন তার বাম পাশেরটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তোলা, আর ডানেরটি দুই মাস পর, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের৷ এবার নীচে কোরালগুলোর দিকে তাকান৷ বামেরগুলো এক রংয়ের আর ডানেরগুলো সাদা হয়ে গেছে৷ হ্যাঁ, এটা জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে৷ ছবিটি অ্যামেরিকান সামোয়া এলাকার৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
সাদা হয়ে যাওয়া
এই ছবিটি হাওয়াই এলাকার৷ এখানেও সাদা হয়ে যাওয়া কোরাল দেখা যাচ্ছে৷ কোরাল তার গায়ে থাকা জলজ উদ্ভিদ, অ্যালজির কারণে বেঁচে থাকে৷ কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে গেলে কোরাল থেকে ঐ উদ্ভিদ ঝরে পড়ে৷ ফলে কোরালেরও আয়ু শেষ হতে থাকে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
একেবারে স্পষ্ট
এতক্ষণ দূর থেকে সাদা অংশ দেখেছেন৷ এখন দেখুন একেবারে কাছ থেকে তোলা ও বর্ধিত করা একটি ছবি৷ এটি কোরালের একটি অংশ৷ দেখুন, গায়ে থাকা জলজ উদ্ভিদ আর না থাকায় কীরকম সাদা হয়ে গেছে কোরালটি৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
চারদিক কেমন যেন খাঁ-খাঁ করছে
মন খারাপ করা একটি ছবি৷ অ্যালজি না থাকায় মরে গেছে কোরাল৷ পড়ে আছে শুধু কঙ্কাল৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
কয়েক দশক সময় প্রয়োজন
এবার আরেকটি ছবি৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি থেকে কোরাল রিফের বেঁচে উঠতে (আদৌ যদি বেঁচে ওঠে) কয়েক দশক সময় লাগতে পারে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
প্রমাণ সংগ্রহ
বিশ্বের কোরাল রিফগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণে ২০১২ সালে ক্যাটলিন গ্রুপের সহায়তায় ‘এক্সএল ক্যাটলিন সিভিউ সার্ভে’ নামে একটি সমীক্ষা শুরু হয়৷ এর মাধ্যমে উচ্চপ্রযুক্তির ক্যামেরা ও রোবট ব্যবহার করে কোরালের বর্তমান অবস্থা তুলে আনা হচ্ছে৷ অনেক ছবি গুগল স্ট্রিট ভিউ-তে আপলোড করা হয়েছে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে তাপমাত্রা বাড়ছে তার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি অংশ শুষে নেয় সাগর৷ ফলে জলবায়ু যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝার একটি ভালো উপায় হচ্ছে কোরাল৷ সমুদ্রের প্রায় ২৫ শতাংশ প্রজাতির বেঁচে থাকার পেছনে রয়েছে কোরাল রিফ৷ তাই কোরাল না থাকে মানে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়া৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
প্রাণিকুলের খাবার
দেখছেন অ্যামেরিকান সামোয়ার ‘এয়ারপোর্ট রিফ’৷ স্বাস্থ্যবান এ সব কোরালের মধ্যে যে গাছপালা থাকে সেখান থেকেই খাবার সংগ্রহ করে পানির নীচে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
খাবার পাবে কোথায়?
লম্বা নাকের সুন্দর এই মাছটি কোরাল থেকে খাবার সংগ্রহ করে থাকে৷ কিন্তু কোরালই যদি না থাকে তাহলে তার কী হবে?