1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বছরে একটা করে পদ্মাসেতু সম্ভব

২৯ মে ২০১৮

তখন আমি ঢাকায় মাছরাঙা টেলিভিশনে কাজ করি৷ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করা একটি জরিপের ফলাফল হাতে এলো৷ দুর্ঘটনার যে ভয়াবহ চিত্র দেখলাম, তা থেকেই তখন এ নিয়ে প্রতিবেদন করতে উদ্বুদ্ধ হই৷

ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/GettyImages

জরিপের ‘এস্টিমেশন' পদ্ধতি অনুসরণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জন্য প্রতিবেদনটি তৈরি করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, সিআইপিআরবি৷ অর্থাৎ তারা সারা দেশে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিধিত্বমূলক জনসংখ্যার ভেতর দুর্ঘটনার চিত্র বিশ্লেষণ করে পুরো দেশের জন্য একটি পরিসংখ্যান প্রাক্কলন করে৷

সেখানে দেখা গেল, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যান, অর্থাৎ প্রতিদিন ৬৪ জন, যার মধ্যে আবার ১৪ জনই শিশু৷ এর দু'বছর আগে করা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে বছরে মারা যান ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ৷ অর্থাৎ এই দুই রিপোর্টের মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে৷

এছাড়া বছরে ৩৪ লাখ বা প্রতিদিন ৯ হাজার ৩শ' জনেরও বেশি মানুষ আহত নন৷ এঁদের মধ্যে বছরে ৮০ হাজার চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন৷

এই পরিসংখ্যানই বলে, সড়ক দুর্ঘটনা কতটা ভয়াবহ আকারে চলছে বাংলাদেশে৷

জরিপকারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. একেএম ফজলুর রহমান তখন আমাকে বলেছিলেন, সড়ক দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদেরই কেবল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে হিসেবে৷ এর বাইরে অনেক ছোট ছোট সড়ক দুর্ঘটনা হয়, যার অনেকগুলোই তারা নথিবদ্ধ করতে পারেনি৷ এছাড়া দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁরাও আসেননি হিসেবে৷ তার মানে, প্রকৃত চিত্র হয়ত আরো ভয়াবহ৷

এই ভয়াবহতার কথা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, ক্ষয়ক্ষতি কি শুধু মানুষের মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব দিয়ে মাপা যায়? সবাই একবাক্যে না-ই বলবেন৷ নানা সময়ে আমরা শুনি এই সড়ক দুর্ঘটনার অর্থনৈতিক ক্ষতিও অনেক৷ সেই অনেকটা কতটুকু, আসুন তা হিসেব করি৷

২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ট্রান্সপোর্ট রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রথম এক গবেষণার ফলাফলে বলে যে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশটির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ১ দশমিক ৬ ভাগ৷ পরবর্তীতে অন্যান্য গবেষণা বিশ্লেষণ করে ডাব্লিউএইচওসহ বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের মতো অর্থনীতি ও দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশগুলোর জন্য একটি সাধারণ হিসেব তৈরি করে৷ সেখানে বলা হয়, এই ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ২-৫ শতাংশ৷ এখন যদি আমি সর্বনিম্ন হিসেবটিই ধরি, অর্থাৎ জিডিপির ২ শতাংশ ধরে নেই ক্ষতির পরিমাণ, তবে টাকার অঙ্কে তার পরিমাণ বছরে ৩৪ হাজার কোটি টাকা৷ অর্থাৎ এই অর্থ দিয়ে বছরে একটা পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব৷

এখন প্রশ্ন হলো, এই হিসেবটা করা হয়েছে কীভাবে?

একটা উদাহরণ দেই৷ এক দেড় বছর আগে, নরসিংদীর বেলাব উপজেলায় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় বেশ ভালোই হতাহতের ঘটনা ঘটে৷ সেই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় শিশু মারুফ৷ তাকে দেখতে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম৷ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি, মুখে প্রচণ্ড আঘাত নিয়ে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে মারুফ৷ মুখ দিয়ে খাওয়া সম্ভব নয়, তাই সেলাইনের ওপরই আছে সে৷ তাকে দেখভাল করছেন যে নারী, তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানলাম তিনি মারুফের মা নন, প্রতিবেশী৷ মারুফের মা আরো গুরুতর আহত৷ তাঁকে রাখা হয়েছে ইমারজেন্সিতে৷ তাঁর হাত-পা ভেঙে গেছে৷

মারুফের রিক্সাচালক বাবা সেখানে ছিলেন না৷ তাঁর একার আয়ে সংসার চলে না৷ তাই মারুফের মা রাঁধুনির কাজ করতেন মধুমতি নামের একটি কারখানায়৷ এখন পঙ্গু হয়ে যাওয়ায়, মারুফের বাবাকে শুধু একাই সংসার টানতে হবে না, বরং মারুফ ও তার মায়ের চিকিৎসার খরচ আজীবন টানতে হবে৷ একটু সচ্ছলতার মুখ দেখা একটা পরিবার হুট করে এতটা নিঃস্ব আর অসহায় হয়ে পড়লো!

অর্থনীতি বলে, এর প্রভাব শুধু ঐ ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের নয়, গোটা রাষ্ট্রের ওপরই পড়ে৷ যেমন এই মারুফের পরিবারের কথাই ধরুন৷ মায়ের আয়ের অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পরিবার৷ তার ওপর তার ও মারুফের চিকিৎসার খরচ, যা টানতে হবে আজীবন৷ সে কারণে হয়ত মারুফের আর লেখাপড়ার সুযোগই হবে না৷ শুধু ঐ পরিবারই কর্মক্ষম মানুষ হারাননি, হারিয়েছে দেশও৷

ওপরের যে জিডিপির হিসেব দেখানো হয়েছে, তার সূচকগুলো কয়েক ধাপে বিশ্লেষণ করা হয়৷ প্রথমত, দুর্ঘটনায় পড়া যানবাহন, সড়ক ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষতি এর আওতায় আসে স্বাভাবিকভাবেই৷

দ্বিতীয়ত, একজন ব্যক্তি আহত হলে তাঁর চিকিৎসার খরচ, যা সারাজীবন হয়ত বইতে হবে৷ এগুলো হলো সরাসরি টাকার অঙ্কের হিসেব৷

তৃতীয়ত, এবার যে ব্যক্তি মারা গেলেন, বা পঙ্গু হয়ে আর কর্মক্ষম রইলেন না, তিনি দেশের অর্থনৈতিক সিস্টেমের যে অংশে অবদান রাখতেন, তা আর করতে পারছেন না৷

চতুর্থত, আহত ব্যক্তির পরিবার যদি তাঁর ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে গোটা পরিবার যদি মার্জিনালাইজড হয়ে যায়, অর্থাৎ যে অর্থনৈতিক ক্ষতির সন্মুখীন হয়, তা-ও আসবে হিসেবে৷ এমন অনেক অর্থনৈতিক হিসেবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়, উপরোক্ত হিসেবে৷

যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলেছবি: Zobaer Ahmed

এর বাইরেও আছে৷ আরেকটু ম্যাক্রো পর্যায় থেকে দেখা৷ সড়ক দুর্ঘটনার কারণে রাস্তায় তৈরি হওয়া যানজট, কর্মঘণ্টায় এর প্রভাব এবং সর্বোপরি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় বিনিয়োগের সম্ভাবনা হ্রাস পাওয়া, এর সবই ধরা হয় অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে৷

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে ক্ষতির পরিমাণের কথা বলা হচ্ছে তার কত শতাংশ এমন ক্ষতি যেন না হয়, অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যয় করছে রাষ্ট্র? সাদা চোখে দেখাই যায়, তার কিয়দংশও করা হয় না৷ যেমন জাতিসংঘের দেয়া একটি গাইডলাইনে বলা আছে, সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের সময়, মূল প্রকল্পের যা খরচ তার ৩ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করতে হবে সেই অবকাঠামোকে ঘিরে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে৷

যাঁরা এ সব নিয়ে গবেষণা করেন তাঁদের অনেককেই আমি জিজ্ঞেস করেছি৷ তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশে তা যে মানা হয় না, তা বলাই বাহুল্য৷

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির একজন পরিচালককে একবার বিষয়টি জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ তিনি আমাকে সঠিক পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও বলে ফেললেন যে, কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে৷ কোথায়? ব্ল্যাকস্পট প্রকল্পের কথা বললেন৷ বাংলাদেশে দুর্ঘটনাপ্রবণ কিছু সড়কের বাঁক বা সড়কের অবস্থা পরিবর্তন করার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে৷ এটাই ব্ল্যাকস্পট প্রকল্প৷ এই প্রকল্প দিয়ে কিছু সড়ক হয়ত মেরামত করা হচ্ছে৷

কিন্তু উনি বুঝতেই পারেননি যে, আমি সমগ্র সিস্টেমের কথা বলছি৷ যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শুধু সড়ক মেরামত নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে সড়ক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে৷

খুব ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে লেখা শেষ করছি৷ বুয়েটের এক বিশেষজ্ঞ একবার আমায় বলেছিলেন যে, সড়ক দুর্ঘটনা গতির জন্য হয় না৷ হয় গতির তারতম্যের জন্য৷

কথাটা খুবই সত্যি৷ যেমন ধরুন, নসিমন, করিমন এগুলোর কারণে মহাসড়কে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে৷ কারণ এগুলোর গতি কম৷ অনেক মহাসড়কে তো রিক্সাও দেখা যায়৷ কথা হলো, এগুলো তৈরি হয়েছে স্থানীয় প্রয়োজনে৷ এখন এগুলোর জন্য আলাদা সার্ভিস রোড না থাকায় এগুলো মহাসড়কে উঠে আসছে৷ কথা শুনছে না৷

তাহলে এদের স্থানীয় প্রয়োজন মেটাবার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে৷ সার্ভিস রোড করতে হবে৷ এটি শুধু একটি দিক৷

সবচেয়ে কষ্টের জায়গাটি হলো, সড়কে শুধু সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির দুর্ঘটনাই আলোতে আসে৷ দু-একটির ক্ষেত্রে প্রতিকারও পাওয়া যায়৷ কিন্তু প্রতিদিনের যে মৃত্যুর মিছিল তাতে বঞ্চিত, নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর সংখ্যাই বেশি৷ হয়ত তাঁদের ‘জীবনের দাম' কম!

তাই আমরা প্রতিদিনই ভুলে যাই, কত মানুষ মারা যান৷ কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়৷ সার্বিক অর্থনীতির হিসেবটা কতজনই বা করি!

ব্লগটি কেমন লাগলো লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ