‘‘প্রতি বছর নতুন ২০ লাখ মানুষ কাজের বাজারে আসছে৷ সেই পরিমান কাজ তো সৃষ্টি হচ্ছে না,’’ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন বাংলাদেশ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ৷
বিজ্ঞাপন
তাঁর কথায়, ‘‘ বাংলাদেশ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে কৃষির বিভিন্ন খাতে প্রায় ২২ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোগকে অর্থায়ন করা হচ্ছে৷ এর মধ্যে নতুন ধরনের ফসল ও পণ্য উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন প্রায় তিন লাখ উদ্যোক্তা৷আমরা এখন টাকার ব্যবস্থা করছি, প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছি, তাদের বাজারজাতকরণে সহায়তা করছি৷ সে কারণে অনেকে এগিয়ে আসছে৷ তবে এখনো অনেক পথ বাকি আছে৷''
অধ্যাপক ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ : আমার মনে হয় এটা করা উচিৎ৷ কারণ আমাদের কর্মসংস্থান দরকার৷ তরুণ প্রজন্ম যদি এই কাজে না আসে তাহলে দেশের অগ্রগতি যত তাড়াতাড়ি হওয়া উচিৎ তা হবে না৷ কারণ আমাদের দেশে অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে কম বয়সের ছেলে-মেয়ে৷ অতত্রব এগিয়ে আসছে এটা সুখবর৷ এই এগিয়ে আসার জন্য কিছু কাজ করতে হচ্ছে৷ আগে শিক্ষিত হলে কৃষিতে আসতে চাইত না, এটাই ছিল এখানের মোটামুটি ব্যবস্থা৷ এখন এমন অনেক ছেলে-মেয়ে গ্রামে এমনকি শহরেও আছে যাদের কর্মসংস্থান নেই, বেকারত্ব তাদের উপর চেপে বসছে৷ এ অবস্থায় তারা কিছু কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে, যেখান থেকে তাদের উপার্জন হতে পারে৷ এই আগ্রহটাকে কাজে লাগাতে হবে৷ আমরা সেটাই করার চেষ্টা করছি৷ আমারা তাদের প্রশিক্ষন দিচ্ছি, অর্থ দিচ্ছি৷ এক সময় অর্থায়নও হতো না৷ টাকা পাওয়া যেত না৷ আমরা এখন টাকার ব্যবস্থা করছি, প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছি, তাদের পন্য বাজারজাতকরণে সহায়তা করছি৷ সে কারণে অনেকে এগিয়ে আসছে৷ তবে এখনো অনেক পথ বাকি আছে৷
দেশের তরুণরা ঝুঁকছে খামারে
ঢাকা শহরের ভেতরেই একটি খামার৷ সেখানে টার্কি, তিতির ও কোয়েল পাখির ‘চাষ’ বা ‘উৎপাদন’ করা হচ্ছে৷ নিজেদের প্রচেষ্টায় বাড্ডায় চালু হয়েছে এই খামার৷ দেশের ৬৪টি জেলায় তা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে৷ ছবি পাঠিয়েছেন মিরাজ হোসেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যেভাবে শুরু
একজন শৌখিন, কৃষিমনস্ক প্রকৌশলী শাহীন হাওলাদার ও একজন তরুণ উদ্যোক্তা মিরাজ হোসেনের যৌথ প্রয়াসে ঢাকার বাড্ডায় গড়ে উঠেছে একটি টার্কি খামার৷ খামারে সার্বক্ষনিক চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকেন ফার্মাসিস্ট এনামুল হক৷
ছবি: Miraz Hossain
দুবাই থেকে ফিরে খামার
মিরাজ হোসেন জানান, দুবাই থেকে আসার পর কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না৷ পরবর্তীতে অনলাইনে টার্কি সম্পর্কে জানতে পারেন৷ তারপর টার্কি পালনের উপর কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মাত্র ৬ টি টার্কি নিয়ে খামারটি শুরু করেন৷
ছবি: Miraz Hossain
‘টার্কি মিরাজ’
বর্তমানে টার্কি ‘উৎপাদন’ বাংলাদেশেও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ এক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রেখেছে ‘মিরাজের টার্কি ফার্ম’৷ এই ফার্মের কারণে মিরাজ আজ সবার কাছে ‘টার্কি মিরাজ’ নামে পরিচিত৷ ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে মাত্র ৬টি টার্কি দিয়ে এই ফার্মটি শুরু করলেও বর্তমানে খামারে ২-৩ মাস বয়সী ১৫০ টি এবং ৭-৮ মাস বয়সি ৪৬ টি টার্কি রয়েছে৷
ছবি: Miraz Hossain
টার্কির আকার
পুরুষ টার্কি স্ত্রী টার্কির তুলনায় বড় এবং অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়৷ একটি পুরুষ টার্কির ওজন হয় ১০-১২ কেজি৷ পুরুষ টার্কির তুলনায় স্ত্রী টার্কি আকৃতিতে ছোট এবং ওজনে কম হয়৷ একটি স্ত্রী টার্কি বছরে ৮০-১০০ টি ডিম দেয়৷ (এই ছবিটি ডয়চে ভেলের)
ছবি: DW/E. Musli
রোগ প্রতিরোধ
অনুকুল পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পরিবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর ও নিয়মিত খাবার দিলে টার্কি মুরগি রোগাক্রান্ত হয় না৷ ৪ থেকে ৫ বর্গফুট জায়গা রাখতে হবে একটি টার্কির জন্য৷ নিয়মিত বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেয়া জরুরি৷ এতে রোগ সংক্রমণ কম হয়৷ চারটি ভ্যাকসিনেশন সিডিউল আছে৷ রানীক্ষেতসহ চারটি রোগের জন্য ভ্যাকসিন দিতে হয়৷
ছবি: Miraz Hossain
বাচ্চা উৎপাদন
ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ২৮ দিনে টার্কির বাচ্চা উৎপাদন হয় এবং প্রতিমাসে আমার এখানে ২০০ থেকে ২৫০ টি বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে৷ এছাড়া দেশি মুরগির সাহায্যে সনাতন পদ্ধতিতেও ২৮ দিনে বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব৷
ছবি: Miraz Hossain
প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস
দেশের মানুষের প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা পূরনের ক্ষেত্রে পোল্ট্রির পাশাপাশি টার্কি মুরগি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে বলে খামারিরা আশা করছেন৷
ছবি: Miraz Hossain
টার্কি ও তিতিরের দাম
টার্কির একমাস বয়সের একটি বাচ্চার দাম তিন হাজার টাকা, তিতিরের বাচ্চার দাম দুই হাজার টাকা৷ বড় একজোড়া টার্কির দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা৷ এছাড়া প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ১৫০ টাকায়৷
ছবি: Miraz Hossain
উট পাখি
মিরাজ হোসেন উট পাখিও পোষা শুরু করেছেন৷ এ থেকে লাভজনকভাবে উটপাখি উৎপাদন সম্ভব কিনা তা দেখছেন৷ ছবিতে উট পাখির একটি বাচ্চা হাতে নিয়ে আছেন মিরাজ হোসেন৷
ছবি: Miraz Hossain
কোয়েলের খামার
সাধারণত একটি ভালো জাতের কোয়েল পাখি বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ টি ডিম দিয়ে থাকে৷ প্রায় প্রতিটি ডিম থেকেই বাচ্চা হয়৷ এই বাচ্চা পরবর্তী ৬ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যেই ডিম দেওয়া আরম্ভ করে৷ এই বয়সের কোয়েল পাখির বাজারে প্রচুর চাহিদা৷ অত্যন্ত স্বল্প পুঁজি নিয়ে কোয়েল পাখির খামার করা যায় এবং খুব দ্রুতই লাভ পাওয়া সম্ভব৷
ছবি: Miraz Hossain
কোয়েলের যত্ন
ঘরের যেখানে পর্যাপ্ত আলো -বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানেই কোয়েলের খাঁচা রাখা উত্তম৷ তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, বৃষ্টির পানিতে কোয়েলের খাঁচা যেন ভিজে না যায়৷ ভিজে এবং স্যাঁতস্যাতে জায়গায় রাখলে কোয়েলের রোগ ব্যাধি বেশি হয়৷
ছবি: Miraz Hossain
আরও কয়েকজন
নুরুল হুদা, পার্থ মজুমদার বাপ্পি এবং শরীফ আব্দুল কাইয়ুমও এ ধরণের খামার করছেন৷ কেবল টার্কি নয় তিতির, কোয়েল পাখির খামার গড়েও সফলতা পেয়েছেন৷ শৌখিন পাখি যেমন ঘুঘু,কবুতর,টিয়া ইত্যাদি পাখিও যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের৷
ছবি: Miraz Hossain
অন্যদের উৎসাহিত করা
মিরাজের ইচ্ছা বাণিজ্যিকভাবে সারা বাংলাদেশে এই খামারের পরিকল্পনা ছড়িয়ে দেওয়া৷ বর্তমানে তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার মানুষ টার্কি ফার্ম গড়ে তুলছেন৷ মিরাজ হোসেন টার্কি বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন দেখেন৷ বেকারত্ব দূর করার জন্য এটা একটা ভালো উদ্যোগ বলে মনে করেন তিনি৷ প্রতি শুক্রবার তাঁর খামারটি পরিদর্শনে আসেন অনেক উদ্যোক্তা৷
ছবি: Miraz Hossain
13 ছবি1 | 13
সরকারের পক্ষ থেকে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে বা সহায়তা দিতে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
সরকারের পক্ষ থেকে তো অনেকগুলো পদক্ষেপ আছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ ‘চাকরি না খুঁজে চাকরি দাও-' এই ধরনের একটা স্লোগান সরকারের আছে৷ যারা আসছে, তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষনও দেয়া হয়৷ শুধু কৃষি নয়, কৃষির বাইরেও প্রশিক্ষন দেয়া হয়৷ আমি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান৷ এটাও সরকারি প্রতিষ্ঠান৷ আমরাও সরকারের নীতির আঙ্গিকে কাজ করি৷ আমরা দুটো কাজ করছি, একটা হলো তাদের দক্ষতা দিয়ে কাজ করা আর অপরটি হলো তাদের মানবিক মূল্যবোধ যাতে বিকশিত হয় সেদিকে নজর দেয়া, কারণ, অনেক তরুণ বিপথে যাচ্ছে৷ তাদের যাতে ফিরিয়ে আনা যায়৷ আমরা তাদের দক্ষতা সৃষ্টিতেও নজর দিচ্ছি, যাতে তারা কাজ করে আয়-উপার্জন বাড়াতে পারে৷
এই তরুণদের আপনারা কিভাবে কৃষিতে আনলেন?
একটা উদাহরণ দেই৷ একটা ছেলে এমএ পাশ করে গ্রামে যাচ্ছে৷ সেখানে গিয়ে বেশ কিছুদিন কিছু করার চেষ্টা করেছে৷ এরপর শহরে ফিরে চাকরির চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু চাকরি সে পায়নি৷ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন সরাসরি কাজ করে না৷ আমাদের কিছু সহায়ক এনজিও আছে৷ তাদের মাধ্যমে কাজ করি৷ এমন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে প্রস্তাব দেয়া হলো, ‘‘তুমি যদি কিছু করতে চাও, আমরা সহায়তা করব৷'' শেষ পর্যন্ত সে রাজি হলো এবং একটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করল৷ দুই- তিন বছরের মধ্যে তার অনেকগুলো পুকুর হয়ে গেছে৷ এখন সে স্বচ্ছল৷ গ্রামে আমি দেখেছি, একটা কাজ করে একজন যদি সফলতা পায় তাহলে আরো অনেকেই ওই কাজে আগ্রহী হয়৷
তরুণরা এত কাজ থাকতে কেন কৃষিতে আসবে? আপনি কী মনে করেন?
এত কাজ নেই তো৷ ব্যাপারটা হচ্ছে, কাজ পাওয়া যায় না বলেই তো আসছে৷ প্রতি বছর নতুন ২০ লাখ মানুষ কাজের বাজারে আসছে৷ সেই পরিমান কাজ তো সৃষ্টি হচ্ছে না৷ আর এখন তো কৃষি মানে শুধু ধান আর গম না৷ মাছ চাষ, গাভী পালা, মুরগি পালা এ সবই কিন্তু কৃষির মধ্যে৷ সবগুলোতেই তারা আসছে৷ এখানে আমরা প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছি, অর্থায়ন হচ্ছে৷ কখনও কখনও আমরা অনেককে নিয়ে একসঙ্গে প্রশিক্ষন দেই৷ যে যেটা নিতে চায়, কেউ কৃষিতে যেতে চায়, কেউ মাছ চাষ করতে চায়, যে যেটা করতে চায় আমরা সেদিকে তাকে প্রশিক্ষন দেই৷
Interview of Pof Dr. Qazi Kholiquzzaman Ahmad - MP3-Stereo
কৃষির চেয়ে শিল্প বা প্রযুক্তিতে প্রবৃদ্ধি বেশি৷ তাদের যদি সেদিকে নিতে পারলে তো রাষ্ট্রের লাভ, নাকি?
অবশ্যই৷ দেশের লাভ, ওদের নিজেদের লাভ, সমাজের লাভ, এমনকি ওদের পরিবারেরও লাভ৷ একজন পিছিয়ে পড়া মানুষ, যার আয়-উপার্জন নেই, তার যদি আয়-উপার্জন বাড়ে, তাহলে তার নিজের উন্নতি হয়, পরিবারের উন্নতি হয় এবং জাতীয় আয়েও সংযোজিত হয়৷ এতে আরেকটা কাজ হয়, সেটা হলো বৈষম্য কিছুটা কমে আসে৷
তরুণরা কৃষিকাজ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা ও কারিগরিসহায়তা কি পাচ্ছে?
প্রয়োজনীয় বলব না, কারণ পাচ্ছে, কিন্তু সেটা আরো বাড়ানো দরকার৷ আমি তো পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের কথা বললাম, আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও করছে৷ এটা আগাচ্ছে, তবে আরো সময় লাগবে৷ এখনো বেকারত্ব অনেক ব্যাপক৷
যে তরুণের অর্থ নেই, জমি নেই, কিন্তু শিক্ষিত, সে কিভাবে কৃষিতে সম্পৃক্ত হবে?
অর্থ তো বললাম আমরা পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন থেকে দেই, অন্য প্রতিষ্ঠানও দেয়, আমরা প্রশিক্ষনও দেই৷ সুতারাং তার যদি জমি না-ও থাকে, আগে যে উদাহরণ দিলাম যে পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করেছে, সেটা করা সম্ভব৷ সবার যে ধান করতে হবে তা না৷ সবজি করাও তো কৃষি৷ বিভিন্নজন বিভিন্ন রকমের কাজ করছে৷ মাছটা বেশ ব্যাপক আকারে হচ্ছে৷ একটা ভুল ধারণা হয়েছে, কৃষি বললে মানুষ মনে করে ধান৷ শুধু এটা না, অন্যসবও কৃষি৷
বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় তরুণদের আপনারা কৃষিতে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন?
অনেক এলাকায়৷ আমাদের তো সারাদেশে কাজ আছে৷ প্রতিটি উপজেলায় কাজ আছে৷ বিশেষ করে ১৫০টি ইউনিয়নে আমরা কাজ করছি৷ যেমন উপকূলীয় এলাকা আছে, যেখানে খরা আছে সেখানেও কাজ আছে৷ লালমনিরহাটসহ সব এলাকায়ই আমাদের কাজ আছে৷ ফলে এক জায়গায় না সবজায়গাতেই কিছু কিছু কাজ হচ্ছে৷ অনেক এলাকা বাকি আছে৷ আমাদের আরো অনেকদূর যেতে হবে৷
প্রকৃতি ও মানুষ বাঁচাতে দেলোয়ার ও তাঁর সঙ্গীদের উদ্যোগ
কুষ্টিয়ার ছেলে দেলোয়ার জাহান ও তাঁর সঙ্গীরা মিলে ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করেছেন৷ সার ও কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই কৃষকদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করছেন তাঁরা৷
ছবি: Delowar Jahan
বিষমুক্ত খাবারের অঙ্গীকার
বাংলাদেশে ফসলের ক্ষেতে প্রতি মিনিটে ৭২ কেজি ‘বিষ’ ছিটানো হয় বলে জানান দেলোয়ার জাহান৷ এতে মাটির যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে যে ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর৷ এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিকাজ পদ্ধতিকে উৎসাহিত করছেন দেলোয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা৷
ছবি: Delowar Jahan
‘প্রাকৃতিক কৃষি’ আন্দোলন
দেলোয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত৷ এর মাধ্যমে তাঁরা আশেপাশের কৃষকদের দেখান যে, এভাবেও ফসল উৎপাদন করে লাভ করা সম্ভব৷ এছাড়া কৃষকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনায় বসে প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিকাজের নতুন নতুন পদ্ধতি বের করেন তাঁরা৷ ছবিতে দেলোয়ারকে কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Delowar Jahan
শুরুর কথা
২০১৩ সালে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আমতলি গ্রামে জমি লিজ নিয়ে গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদন শুরু করেন দেলোয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা৷ বর্তমানে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার হাজীপুর গ্রামে দেড় একর জমিতে প্রায় ৪০ রকমের সবজি উৎপাদিত হয় বলে জানান তিনি৷ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দেলোয়ার নিজে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে জড়িত ছিলেন৷ আর তাঁর সঙ্গীদের পরিবারও কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত৷
ছবি: Delowar Jahan
লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন দেলোয়ার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্সে দ্বিতীয় ও মাস্টার্সে যৌথভাবে প্রথম হয়েছিলেন দেলোয়ার৷ এরপর সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন৷ কিন্তু মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন ভেবে সেখানে যাননি তিনি৷ ‘প্রাকৃতিক কৃষি’র পাশাপাশি ঢাকায় একটি পত্রিকায় কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতা করছেন দেলোয়ার৷
ছবি: Delowar Jahan
সঙ্গীদের কথা
দেলোয়ারের সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন তরুণ-তরুণী৷ তাঁদের প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়ালেখা শেষ করেছেন৷ ছবিতে দুজনকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Delowar Jahan
সাফল্যের কথা
দেলোয়ারদের যেখানে খামার আছে, সেই মানিকগঞ্জ ছাড়াও ঝিনাইদহ, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁ জেলার অনেক কৃষক বর্তমানে প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল উৎপাদন করছেন৷ ছবিতে দেলোয়ারের সঙ্গীদের ফসল তুলতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Delowar Jahan
পণ্যের বাজার
বিভিন্ন জেলার কৃষকদের প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করা সবজি, ফল ঢাকায় কিনতে পাওয়া যায়৷ এজন্য মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে ‘প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র’ চালু করা হয়েছে৷ ছবিটি বিপণন কেন্দ্রের সামনে তোলা৷
ছবি: Delowar Jahan
যা পাওয়া যায়
কী চান? শাক-সবজি, ফল, চাল, ডাল, হাতে ভাজা মুড়ি, মসলা, তেল, ঘি, দুধ, ডিম; বলে শেষ করা যাবে না৷ মাঝেমধ্যে বাসায় চাষের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রাকৃতিক সারও পাওয়া যায় ঐ কেন্দ্রে৷ হালনাগাদ তথ্য পেতে ‘প্রাকৃতিক কৃষি’র ফেসবুক পাতা দেখা যেতে পারে৷ এজন্য উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Delowar Jahan
নিরাপদ ফসল
ঢাকায় প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কিষাণীরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে এসেছেন৷
ছবি: Delowar Jahan
গ্রামে যাওয়া হয়নি
দেলোয়ার কুষ্টিয়ার ছেলে৷ কিন্তু নিজের গ্রামে না গিয়ে মানিকগঞ্জে কাজ করার কারণ বলতে গিয়ে তিনি জানান, সেটি সম্ভব ছিল না৷ ‘‘যখন পড়ালেখা করতাম তখন গ্রামে গেলে সবাই জানতে চাইতো কতদিন আছি কিংবা কবে যাব? তখনই বুঝতে পারি যে, আসলে গ্রামে ফেরা সম্ভব না,’’ ডয়চে ভেলেকে বলেন দেলোয়ার৷
ছবি: Delowar Jahan
চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষিকাজ
বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে কেউ যদি উচ্চশিক্ষার পর চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষিকাজে জড়িত হয়ে জীবনযাপন করতে চায় তাহলে সেটি সম্ভব বলে মনে করেন দেলোয়ার৷ ‘‘কেউ যদি সমন্বিত খামার করেন, যেখানে মাছ চাষ থাকবে, গরু থাকবে, দুধের জন্য ছাগল থাকবে, হাঁস থাকবে, সবজি থাকবে- তাহলে সম্ভব৷’’
ছবি: Delowar Jahan
তবে...
দেলোয়ার বলেন, সমস্যা হচ্ছে তরুণরা মনে করে, কৃষিকাজ মানে অচ্ছুতের কাজ৷ তাই এটি কেউ করতে চায় না৷ ‘‘কারণ চারপাশে এত রং, এত প্রত্যাশা জীবনে যে, কেউ আসলে কৃষিকাজ করতে চায় না৷ প্রচুর ছেলেমেয়ে আমাদের কাছে (প্রাকৃতিক কৃষির কাজ দেখতে) আসে৷ যে পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে আসে তার দ্বিগুণ পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে চলে যায়’’, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানান দেলোয়ার৷
ছবি: Delowar Jahan
12 ছবি1 | 12
আমাদের দেশে তো হাজার হাজার তরুণ এখনো বেকার৷ তাদের মধ্যে আপনারা যাদের সহযোগিতা করছেন, তাদের বাছাই করছেন কিভাবে?
আমরা ১৫০টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিকে সহায়তা দিচ্ছি৷ এখানে বাছাই করার কোনো ব্যাপার নেই৷ এই ১৫০টি ইউনিয়নে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করছি৷ অন্যান্য জায়গায় তো আমরা সবাইকে দিতে পারি না৷ শুধু যারা উৎসাহিত হয়, তাদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করি৷ যুব উন্নয়ন অধিদপ্ততর তো সারাদেশেই কাজ করছে৷ তারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষন দিচ্ছে৷ সুতারাং প্রশিক্ষন আস্তে আস্তে বাড়ছে৷ প্রশিক্ষন হলে অর্থায়নের ব্যবস্থাও বিভিন্নভাবে হয়৷ আসলে যতটা প্রয়োজন, ততটা এখনো সম্ভব হয়নি৷ আশা করি ভবিষ্যতে অর্থায়ন আরো বাড়বে এবং তরুণরা আরো এগিয়ে আসবে৷
সরকারের কাছে এই মুহুর্তে তরুণদের জন্য আপনার কী চাওয়ার আছে?
আমার কিছু চাওয়ার নেই৷ আমি চেষ্টা করছি৷ সরকারের একটা নীতি আছে৷ সেই নীতির আওতায় যে কাজগুলো হচ্ছে, সেগুলো যেন আরো সঠিকভাবে হয়৷ আমাদের নীতির কোনো সমস্যা নেই৷ সমস্যা হলো যেভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা সেভাবে বাস্তবায়ন হয় না৷ যাদের জন্য এই উদ্দেশ্য তাদের কাছে অনেক সময় এটা পৌঁছায় না৷ সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে যার যেটা প্রাপ্য সেই জায়গায় যদি আমরা ভালো করে কাজ করতে পারি, দেশটা এমনিতেই এগিয়ে যাচ্ছে, তাহলে আরো অনেক বেশি এগিয়ে যাবে৷
তরুণদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
ওদেরকে আমি দুই-তিনটা জিনিস বলি৷ যারা পড়াশোনা করছে, তাদের ভালোভাবে পড়াশোনাটা করতে হবে৷ পড়াশোনা শেষ হলে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা আছে৷ প্রশিক্ষন নিতে হবে এবং সেটা কাজে লাগাতে হবে৷ আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমি এই কাজটা করব৷ আর আমি যদি আরেকটা কাজ চাই, কিন্তু পাচ্ছি না, তাহলে কিন্তু হবে না৷ সিদ্ধান্তটা নিতে হবে যে আমি এই কাজটা করব৷ অনেকের সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে৷ কেউ অঙ্গীকার নিয়ে এলে সে ভালো করবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷