বছর ঘুরলেও নাজিবের খোঁজ নেই
১৮ অক্টোবর ২০১৭অভিযুক্তদের ‘পলিগ্রাফ টেস্ট' না করানোয় সিবিআইয়ের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আদালত৷ এবার কি খোঁজ মিলবে নাজিবের? আশায় বুক বাঁধছেন নাজিবের অসহায় মা ফাতিমা নাফিস৷
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিব আহমেদের অন্তর্ধানের এক বছর পরেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাত খালি! যা দেখে দিল্লি হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এই রহস্যের সমাধানে সিবিআইয়ের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই৷''
সোমবার আদালত চত্বরে নাজিবের বৃদ্ধা মা ফাতিমা নাফিসকে চূড়ান্ত হেনস্থা করলো পুলিশ৷ তাঁর হাত-পা টেনে ধরে পুলিশের গাড়িতে তুললেন মহিলা পুলিশকর্মীরা৷ যার জেরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ছবি পোষ্ট করেছে জেএনইউ'র ছাত্রছাত্রীরা৷ তা নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে৷ পুলিশের আচরণের নিন্দায় সরব হয়েছে সব মহল৷
গতবছর ১৫ অক্টোবর জেএনইউ-এর হোস্টেলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি সমর্থকদের হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন বায়োটেকনোলজি বিভাগের মাস্টার্স অফ সায়েন্সের ছাত্র নাজিব৷ পাঁচ মাস আগে, ১৬ মে আদালতই নাজিব মামলা তদন্তের জন্য সিবিআইকে গিয়েছিল৷ পরদিন, অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর সকাল থেকেই নিখোঁজ হয়ে যান তিনি৷ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আগেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আদালত৷ প্রথমে দিল্লি পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছিল৷ আদালতের ক্ষোভ, পুলিশ মুখ বন্ধ খামে করে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিচ্ছে ঠিকই, অথচ খামে এমন কিছুই নেই যা গোপনীয় বা যে খবর ছড়িয়ে পড়লে তদন্তে বিরাট কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে৷ কাজের কাজ না করে বিষয়টি নিয়ে খামোকা শোরগোল ফেলতে চাইছে পুলিশ৷ সারা দেশে লোক পাঠাচ্ছে৷ বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছে৷ অথচ নাজিবের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে যে নয় পড়ুয়ার হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ, তাদেরকে না জেরা করা হয়েছে, না হেফাজতে নেওয়া হয়েছে৷
নাজিবকে নিগ্রহের ঘটনায় এক এবিভিপি সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল জেএনইউ-র তদন্ত কমিটি৷ তাঁর নাম বিক্রান্ত কুমার৷ নাজিবের ভাই মুজিবের ক্ষোভ, ‘‘আমরা প্রথম দিন যে রকম অন্ধকারে ছিলাম, আজও সে রকমই অন্ধকারে৷'' পরে নাজিবের মায়ের দায়ের করা আর্জিতে মামলাটির তদন্তের ভার সিবিআইকে দেয় আদালত৷ সেই মামলার শুনানিতে এ দিন বিচারপতি জি এস সিস্তানি ও চন্দ্রশেখরের বেঞ্চ কার্যত সিবিআইকে একহাত নিয়েছে৷ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সরকারকে তোপ দেগেছেন ছাত্র-নেতা কানহাইয়া কুমারও৷ তাঁর লেখা বই ‘ফ্রম বিহার টু তিহার'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কানহাইয়া বলেন, ‘‘ওদের এত পুলিশ যে, জেএনইউতে ক'টা কন্ডোম ব্যবহার হয়, তা গুণতে পারে, আর এত দিন ধরে নাজিব কোথায় আছে তা খুঁজে বের করতে পারে না৷''
জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভানেত্রী গীতা কুমারীর কথায়, ‘‘নাজিবের মতো ছাত্র, যার ইউনিভিসিটির ক্যাম্পাস থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় প্রথমে পুলিশ কোনও অভিযোগ নিতেই চায়নি, পরে অনেক কষ্টে অভিযোগ নিলেও তদন্তে আগ্রহ দেখায়নি৷ পরে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন হলেও সেটিও ছিল লোক দেখানো৷ তারপর নাজিবের মায়ের দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে সিবিআই তদন্ত হলেও কোনও অজানা কারণে তারাও তদন্তে কোনও দিশা দেখাতে পারেনি৷
লাই ডিটেক্টর টেস্টের জন্য বারবার বলা হলেও এখনও তারা তা করেনি৷ এতকিছুর পর সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে যখন নিখোঁজ ছাত্রের মা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন, তখন তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদশ্যদেরও শারীরিকভাবে হেনস্থা করতে ছাড়েনি পুলিশ৷ জেএনইউ-এর মতো সুরক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এই ঘটনা ঘটে, তাহলে ভারতের অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷’’
গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সিবিআইকে সমঝে দিয়েছিল আদালত৷ কিন্তু, তাতেও কোনও কাজ হয়নি৷ এদিন বিচারপতিরা বলেছেন, ‘‘নাজিব মামলায় বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি, এমনকি কাগজ-কলমেও এতটুকু তদন্ত এগোয়নি!'' নাজিব অন্তর্ধান রহস্যে যে ছাত্রদের দিকে সন্দেহের তির, তাদের ফোন ও এসএমএস খতিয়ে দেখে আদালতে রিপোর্ট দিয়েছে সিবিআই৷ আরও একটি ‘স্ট্যাটাস রিপোর্ট'-ও জমা দেওয়া হয়েছে৷ আদালতের বক্তব্য, ‘‘দুটির মধ্যে বিস্তর গরমিল আছে৷''
পলিগ্রাফ টেস্ট প্রক্রিয়ার সময় মিথ্যা কথা বললে অভিযুক্তের বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়া, যেমন, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠা-নামা, মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয়৷ এসব কয়েকটি মিটারের সাহায্যে পরিমাপ করা হয়৷ এবং একে এক কথায় ‘লাই ডিটেক্টর' বলা হয়৷ এক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তার মানসিকতা অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়৷ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে একের পর এক প্রশ্ন করা হয় অভিযুক্তদের৷ প্রশ্নকর্তা যদি নিজে নিরপেক্ষ না হন, তাহলে সঠিক ফল পাওয়া প্রায় অসম্ভব৷
এদিকে, দু' দিন আগে নিখোঁজের এক বছর পরেও ছেলের কোনও খোঁজ না মেলায় দিল্লি হাইকোর্টের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন নাজিবের মা ও অন্যান্যরা৷ হাইকোর্টের সামনে নাজিবের মা ফাতিমা নাফিসকে হেনস্থার পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে৷ যদিও দিল্লি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বি কে সিং জানিয়েছেন, ‘‘কোনোরকম অসভ্যতা করেনি পুলিশ৷ আসলে নাজিবের মায়ের সঙ্গে তাঁর পরিবার ও জেএনইউয়ের বেশকিছু ছাত্রছাত্রী বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন৷ একসময় তাঁরা আদালত চত্বরে ঢুকতে চেষ্টা করছিলেন৷ তখনই তাঁদের আটক করা হয়েছে৷ মোট ৩৫ জনকে আটক করে বারাখাম্বা রোড থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে৷''