বছর ঘুরে আবার এসে গেল বড়দিন৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে দিনটি পালন করে৷ জার্মানিতেও কয়েক সপ্তাহ ধরে এই উৎসবকে ঘিরে চলেছে নানা আয়োজন৷
বিজ্ঞাপন
ঐতিহ্যের প্রতি বিশেষ অনুরাগ রয়েছে জার্মানদের৷ ক্রিসমাসকে ঘিরে পুরানো ঐতিহ্য, রীতি-নীতির সমাহার চোখে পড়ে সর্বত্র৷ অফিস আদালত ও বাড়িতে বাড়িতে চোখে পড়ে আলোক সজ্জিত ক্রিসমাস ট্রির বাহার৷
জার্মানদের নিজস্ব ঐতিহ্য
বড়দিনের উৎসব পালনেও জার্মানদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস৷ অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বড়দিনের উৎসবটা যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন ২৫ শে নয় বরং আগের দিনই অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয়৷ কয়েকশ বছর ধরে উৎসবটাকে এগিয়ে আনা হয়েছে৷ মিডনাইট মেস থেকে শুরু করে ক্রিসমাস ট্রির নীচে রাখা উপহার বিতরণ – এসব কিছুই চলে ২৪ তারিখ অর্থাৎ পবিত্র রাতে৷
জার্মানিতে বড়দিনের উৎসব পালন
যে-কোনো উৎসব মানেই আনন্দ আর তা সবার জন্যই৷ চলুন এই ছবিঘরের মধ্য দিয়ে জানা যাক কে কিভাবে উৎসবের আনন্দ গ্রহণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রিসমাস ট্রি
যে-কোনো উৎসব মানেই হৈচৈ, আনন্দ, উপহার, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া৷ তবে তা যদি হয় ধর্মীয় কোনো উৎসব তাহলে স্বাভাবিকভাবে সবকিছুর মাত্রা খানিকটা বেড়ে যায়৷ জার্মানিতে বড়দিনের উৎসব নানাজনে নানাভাবে উদযাপন করে৷ বেশিরভাগ মানুষই অতি যত্নে ক্রিসমাস ট্রি সাজান৷ আর সবাই অপেক্ষা করে থাকে ক্রিসমাস ট্রির নীচে রাখা উপহারের জন্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আস্ত মাছ ভাজি
যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন ২৪ ডিসেম্বর রাতে৷ তাই এ রাতকে পবিত্র রাত বলা হয় অর্থাৎ তখন থেকে বড়দিনের মূল উৎসব শুরু হয়ে যায়৷ জার্মানিতে সেদিন রাতে পুরনো ঐতিহ্য অনুযায়ী মাছ খাওয়া হয়, বিশেষ করে কারফেন মাছ, তবে সব অঞ্চলে নয়৷ আস্ত মাছটি ওভেনে বেক করে পরে কেটে কেটে পরিবেশন করা হয়৷ এবং এ রাতেই উপহারগুলো সুন্দর প্যাকেটে ভরে ক্রিসমাস ট্রির নীচে সাজিয়ে রাখা হয়৷
ছবি: Fotolia/Teressa
রাজহাঁসের রোস্ট
বড়দিন পারিবারিক উৎসব৷ তাই যারা পরিবার থেকে দূরে থাকে তারা উৎসবের দিনগুলো একসাথে উদযাপন করতে চায়৷ খাবারের আয়োজন হয় বেশ ঘটা করে৷ সেদিন খাওয়া হয় বিশাল আকারের ওভেনে রোস্ট করা রাজহাঁস৷ এর জন্য রয়েছে বিশেষ রেসিপি৷ রাজহাঁসের পেটের ভেতরে যে মশলা বা পুর ভরা হয় তার ওপরই নির্ভর করে রাজহাঁসের রোস্টের স্বাদ৷
ছবি: picture-alliance/Tobias Hase
ক্রিসমাসের দ্বিতীয় দিন
আয়োজনের দিক থেকে এই দিনটিও অনেকটা ২৫ তারিখের মতো৷ তবে যাদের পরিবারের বেশিরভাগ মানুষ কাছাকাছি থাকেন তারা সাধারণত দুদিন দু বাড়িতে যান, অর্থাৎ একদিন মা-বাবার বাড়ি আর পরের দিন শ্বশুর বাড়ি৷ অথবা একদিন নিজেরা যায়, পরের দিন অন্যরা আসে৷ তবে দুদিনই খাবারের আয়োজনে থাকে উৎসবের ছোঁয়া৷ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি প্রচুর মিষ্টি খাবারও থাকে৷ বিশেষ ধরণের কেক, বিস্কুট কত কি!
ছবি: Erika Klein
উপহার
বড়দিন উপলক্ষ্যে প্রিয়জনদের পছন্দের উপহার দেয়ার জন্য আগে থেকে টাকাও জমিয়ে রাখেন৷ জার্মানিতে একটা রীতি বেশ প্রচিলিত, বড়দিন উপলক্ষ্যে কি পেতে চান বা কি প্রয়োজন তেমন একটি তালিকা তৈরি করে রাখেন এবং সেটা দেখেই পরিবারের অন্যরা উপহার কিনে আনেন৷ যদি কারো পছন্দ না হয়, বদল করে আনার সুবিধার্থে কেনার রশিদটিও সাথে দিয়ে দেয়৷ বলা যায়, বাড়ির বাচ্চারা ওদের নানু-দাদুর কাছ থেকে সবচেয়ে দামি উপহারটি পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/chromorange
তরুণ প্রজন্ম
জার্মানরা ঐতিহ্যপ্রিয়, তবে তা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে তেমন লক্ষ্য করা যায় না৷ ওরা অনেকেই এতো ঝামেলায় যেতে চায় না৷ তারা ঐতিহ্যবাহী খাবারের চেয়ে হালকা বা সহজ উপায়ে তৈরি খাবারই বেশি পছন্দ করে থাকে৷ যেমন বিদেশি খাবার রাকলেট বা ফনড্যু৷ যা আগে থেকে তৈরি বা প্রস্তুত না করে অতিথি আসার পরে একসাথে বসে ঝটপট করে ফেলা যায় এবং গরম গরম খাওয়া যায়৷
শীতকালীন হলিডে
অনেক জার্মান বড়দিনের ঝামেলায় না যেয়ে চলে যান অন্য কোথায়ও ছুটি কাটাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে৷ জার্মানিতে এখনো তুষারপাত হয়নি৷ কাজেই এবারও ‘সাদা বড়দিন’ হচ্ছে না৷ তাই একসাথে কয়েকদিন ছুটি থাকায় অনেকেই স্কিয়িং করতে চলে যায় সুইজারল্যান্ড বা অস্ট্রিয়ার কোনো পর্বতমালায়৷
ছবি: Fotolia/Gorilla
চলো যাই গরমের দেশে
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা বিশ্বের আবহাওয়ায় এসেছে বিরাট পরিবর্তন৷ জার্মানি শীতপ্রধান দেশ৷ বছরের এ সময়ে যতটা শীত পড়ার কথা তত শীত না পড়লেও যথেষ্টই শীত৷ গত বছরও ছিলো প্রচণ্ড ঠান্ডা৷ তাই এই শীত থেকে পালাতে অনেকেই বড়দিনের ছুটিতে এমন কোনো দেশে চলে যায় যেখানে হালকা পাতলা পোশাক পরে যথেষ্ট সূর্যের তাপ গ্রহণ করা সম্ভব৷ শীতের বাকি দিনগুলোর জন্য রিজার্ভে রেখে দিতে পারে প্রচুর ভিটামিন ‘ডি’৷
ছবি: picture alliance/dpa
বড়দিনে বিদেশিরা কি করেন?
আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে কোনো উৎসবই আর শুধু নিজস্ব উৎসব হিসেবে নেই৷ জার্মানিতে ৪০ লাখেরও বেশি মুসলমানের বসবাস৷ তাছাড়া অন্যান্য ধর্মের মানুষও রয়েছেন৷ তারাও ছুটির দিনগুলোতে পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিলিত হন, খাওয়া-দাওয়া করেন৷ করেন উপহার আদান-প্রদান৷ আসলে ‘ধর্ম যার যার হলেও উৎসব কিন্তু সবার’ – এই রীতিই মানুষের মাঝে লক্ষ্য করা যায়৷ অনেক বিদেশির বাড়িতেও মোমবাতি বা আলোকসজ্জা দেখা যায়৷
তবে ঠিক কোন দিনটি পবিত্র রাত এটা জিজ্ঞেস করলে মানুষজন একটু গোলমাল পাকিয়ে ফেলেন৷ এক নারী বলেন, ‘‘আমার মতে পবিত্র রাত হলো ২৪ তারিখে৷'' আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘‘আমার মতে ২৫ তারিখ৷'' আরেক মহিলা উত্তর দেন, ‘‘যখন দারুচিনির গন্ধে চারিদিক ভুরভুর করে, যখন চারিদিক আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে তখন৷''
উপহারগুলি কে নিয়ে আসে কে?
উপহারগুলি কে নিয়ে আসে এব্যাপারেও জার্মানদের মতভেদ রয়েছে৷ এক মহিলা বলেন, স্যান্টাক্লজ বা ভাইনাখটসমান, এক ছেলে বলে না না ক্রিস্টকিন্ড (ক্রিস্ট-চাইল্ড), আরেক মেয়ে বলেন, নানা স্যান্টা ক্লজ, আরেক ছেলে বলে আমার বাবা-মা৷
স্যান্টাক্লজ বা ক্রিস্টকিন্ড যেই উপহার আনুক না কেন জার্মানরা এব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত৷ প্রটেস্টান্ট অধ্যুষিত উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের মানুষজন স্যান্টাক্লজকে বিশ্বাস করেন৷ আর ক্যাথলিক অধ্যুষিত দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে ক্রিস্টকিন্ডের প্রভাবটাই বেশি৷
আরো কিছু বিশেষত্ব রয়েছে জার্মানিতে
ক্রিসমাসের আরো কিছু বিশেষত্ব রয়েছে জার্মানিতে৷ জার্মানিতে বড়দিনের উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় প্রায় চার সপ্তাহ আগে থেকেই৷ এই সময়টাকে বলা হয় ‘আডভেন্টৎসাইট'৷ অর্থাৎ (যিশুর) আবির্ভাবের সময়৷ উৎসবের সময়টাকে ‘কাছাকাছি' আনার জন্যই এতসব আয়োজন৷ এই সময় তৈরি করা হয় ‘আডভেন্টক্রানৎস'৷ এটির যাত্রা শুরু ১৮৩৯ সালে জার্মানির হামবুর্গে৷ ফার গাছের পাতা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বানানো একরকম তোড়া৷ এটি টেবিলে রাখা হয় কিংবা জানালায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় অনেক বাড়িতে৷ তার ওপর গেঁথে দেয়া হয় চারটা মোমবাতি৷ বড়দিনের আগের চার সপ্তাহে প্রতি রোববার একটি করে মোমবাতি জ্বালানো হয়৷ চারটা মোমবাতি জ্বালানো হয়ে গেলে বুঝতে হবে বড়দিন আসন্ন৷ আডভেন্ট ক্যালেন্ডারও জার্মানদের সৃষ্টি৷ পরিবারের বড়রা আডভেন্ট ক্যালেন্ডার তৈরি করে তার খোপে খোপে ছোটদের জন্য রেখে দেন বাদাম, ফল, চকলেট বা খেলনা৷ এক এক দিন এক একটা জিনিস পেয়ে বাচ্চাদের আনন্দ আর ধরে না৷
পারিবারিক উৎসব
জার্মানদের জন্য বড়দিন বিশেষ করে পারিবারিক উৎসব৷ এই দিন পরিবার পরিজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন সবাই৷ বিশেষ করে মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের কাছে পাবার আশায় দিন গুণতে থাকেন৷ এদিক দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জার্মানদের মিল রয়েছে৷