জার্মানিসহ অনেক দেশে বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক বেড়ে চলেছে৷ জার্মান বিজ্ঞানীরা এমন এক সমাধানসূত্র প্রস্তুত করছেন, যার সাহায্যে এলাকার নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রকল্পের বিভিন্ন ত্রুটি আগেভাগেই দূর করা যাবে৷
বিজ্ঞাপন
নাগরিকদের অংশগ্রহণে নির্মাণ প্রকল্প
04:32
নতুন বিমানবন্দর, রেল স্টেশন, বায়ুশক্তি কেন্দ্র বা বিদ্যুৎ লাইন বসানোর মতো বড় প্রকল্প নিয়ে আজকাল বিশাল বিতর্ক ও বড় আকারের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে৷ এই ধরনের বিরোধের প্রধান কারণ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাব৷ গ্রামে বা শহরে কোনো বড় প্রকল্পের পরিকল্পনা কী ভাবে নাগরিকদের কাছে আরও স্বচ্ছ ও বোধগম্য করে তোলা যায়, তা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন ফ্রাউনহোফার ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা৷
গেম শুধু খেলবেই না, বানাবেও
বাংলাদেশের অনেক কিশোর-কিশোরী কম্পিউটার গেম খেলতে পছন্দ করে৷ তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেম ডেভেলপার হিসেবে গড়ে তুলতে ‘উই মেক গেমস’ নামে একটি কর্মসূচি শুরু হয়েছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
‘উই মেক গেমস’
স্কুলের শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার গেম তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার কর্মসূচি ‘উই মেক গেমস’৷ এর আওতায় সারা দেশের ৪০০ স্কুলের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা করছে গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাসিভস্টার স্টুডিও লিমিটেড৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: MassiveStar Studio
সরকার সঙ্গে থাকবে
বিশাল এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন ম্যাসিভস্টার স্টুডিও-র প্রধান নির্বাহী মাহবুবুল আলম৷
ছবি: MassiveStar Studio
লক্ষ্য বাজার ধরা
মাহবুবুল আলমের মতে, সারা বিশ্বে কম্পিউটার গেমের ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি বাজার আছে৷ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে তৈরি হওয়া গেম ডেভেলপাররা এই বাজারের একটি অংশ বাংলাদেশে নিয়ে আসবে বলে আশা তাঁর৷
ছবি: Getty Images
নভেম্বরে শুরু হয়েছে
‘উই মেক গেমস’ কর্মসূচিটি শুরু হয়েছে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে৷ ইতিমধ্যে ঢাকার ১১টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের গেম তৈরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বা হয়েছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
প্রতিভাবান কিশোর-কিশোরী
মাহবুবুল আলম মনে করেন, বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থী কম্পিউটারে গেম খেলে তাদের একটা বড় অংশ গেম ডেভেলপ করারও ক্ষমতা রাখে৷ সেসব শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে গেম ডেভেলপার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব৷
ছবি: WCG
‘হাতিরঝিল ড্রিম বিগিনস’
উই মেক গেমস কর্মসূচির বাস্তবায়নকারী সংস্থা ম্যাসিভস্টার স্টুডিও লিমিটেড ‘হাতিরঝিল ড্রিম বিগিনস’ নামে একটি কম্পিউটার গেম বাজারে নিয়ে এসেছে৷ এই গেম তৈরির সঙ্গে মাশরুর মাহমুদ নামে সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরও রয়েছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
পেছনের কারিগর
প্রায় ২১ জন তরুণ ছয় মাস কাজ করে গেমটি ডেভেলপ করে৷ এঁদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট মাশরুর মাহমুদ৷ সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
নির্মাণ কৌশল
থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স, গুগল স্কেচআপ প্রো, ব্লেন্ডার ও মায়া সফটওয়্যার ব্যবহার করে গেমটি নির্মাণ করা হয়েছে৷ গেমটিতে মোট লেভেল আছে ৩১টি৷ একটি লেভেল শেষ করে পরেরটিতে যেতে হবে৷ প্রতিটি লেভেলের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ
খেলার পাশাপাশি চাইলে বিআরটিসির বাস বা গাড়িতে করে হাতিরঝিলে ঘুরে বেড়ানো যাবে৷ স্পিডবোট আর বিমান নিয়েও গেম খেলা যাবে৷
ছবি: MassiveStar Studio
স্মার্টফোনেও
কম্পিউটারের পাশাপাশি স্মার্টফোনেও যেন গেমটি খেলা যায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ আগামী ঈদের আগেই অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরা যেন গেমটি খেলতে পারেন সে চেষ্টা করা হচ্ছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
কোথায় পাবেন?
বর্তমানে ঢাকা শহরের প্রায় ১৬০টি সিডির দোকানে এই গেমটি পাওয়া যাচ্ছে৷ তবে মাস খানেকের মধ্যেই সেটা সারা দেশে পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে৷
ছবি: MassiveStar Studio
11 ছবি1 | 11
এর জন্য তাঁরা নতুন হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে বাস্তবের আদলে এক ত্রিমাত্রিক ভার্চুয়াল জগত গড়ে তোলা যায়৷ এভাবে অনেক বিরোধ আগেভাগেই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা৷ ফ্রাউনহোফার ইন্সটিটিউটের ড. ইওয়াখিম রিক্স বলেন, ‘‘নাগরিকদের অংশগ্রহণ, তাদের পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া, তাদের আইডিয়া কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য৷ ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় তারাও শামিল হতে পারে৷ প্রকল্প তাদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে৷''
গবেষকদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিকল্পনার পর্যায়ে যে পরিমাণ তথ্য সৃষ্টি হয়, তা কম্পিউটারে ভরা৷ তবে সেই তথ্য ডিজিটাল রূপে থাকায় এবং ইনস্টিটিউটের নিজস্ব সার্ভার পার্কের কল্যাণে এখন শুধু অ্যালগোরিদম নিয়েই ভাবতে হয়৷ গবেষকরা এমন সব থ্রিডি মডেল তৈরি করেছেন, যেগুলি বাস্তব বিশ্বের প্রায় অবিকল নকল৷ গবেষকরা দুই ধরনের তথ্য আলাদা করছেন৷ ফ্রাউনহোফার ইন্সটিটিউটের মিশায়েল ক্রেমার বলেন, ‘‘একদিকে রয়েছে জিওবেসিস ডেটা, যা মূলত কোনো সাইটের মডেল কিংবা বিমান বা স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি৷ তার সঙ্গে রয়েছে মানচিত্র, জমির ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য, বায়ুশক্তি কেন্দ্র বা বিদ্যুৎ লাইনের মতো প্রকল্পের সিমুলেশন ডেটা ইত্যাদি৷''
এই সব তথ্য তুলে ধরা হয় এক বিশেষ ‘মাল্টি টাচ টেবিল' ও বড় পর্দায়৷ টেবিলটির মাপ ১.৮০ মিটার বাই ১ মিটার৷ ছোট গ্রুপ মিটিং বা নাগরিক সমাবেশে আলোচনার জন্য এটি ব্যবহার করা যায়৷ বিশেষজ্ঞদের দল, বায়ুশক্তি কেন্দ্রের মালিক ও নাগরিকরা সমস্যা ও তার বিকল্প নিয়ে আলোচনা করতে পারেন৷ টেবিলটি অনেকটা বিশাল স্মার্টফোনের মতো, যা চালাতে বিশেষ বিদ্যাবুদ্ধির দরকার নেই৷
ফ্রাংকফুর্ট শহরের কাছে এক বায়ুশক্তি পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা হচ্ছে৷ বিজ্ঞানীরা আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, কী ভাবে টার্বাইনগুলি ঠিক কোথায় বসানো হবে৷ পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তা দেখা যায়৷ যেমন টার্বাইন ও বসতির মধ্যে ন্যূনতম দূরত্ব বজায় না রাখা হলে৷ তখন টার্বাইন সরিয়ে দিতে হবে৷ গোটা প্ল্যান-ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হয়ে যাবে৷
কম্পিউটার গেমে যৌনতা
কম্পিউটারে যারা গেম খেলেন তাদের অর্ধেকই নারী হলেও নারী ডিজাইনারের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে গেমগুলোতে নারীদের বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে৷
ছবি: DW
যৌনতার উপস্থিতি
ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কম্পিউটার মেলার৷ সেখানে অংশ নিয়েছিল কম্পিউটার গেম ডেভেলপার ‘ইউবিসফট’৷ তাদের নতুন গেম ‘জাস্ট ড্যান্স ২০১৪’-র প্রচারণা উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে এই চার নারী ও পুরুষ মডেল গেমের চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলছেন৷
ছবি: Robyn Beck/AFP/Getty Images
অর্ধেকই নারী
জরিপ বলছে, প্রতি তিন জার্মানের একজন নিয়মিত কম্পিউটার গেম খেলেন এবং গেমারদের অর্ধেকই নারী৷
ছবি: DW/G.Ferreto
পছন্দের ভিন্নতা
পুরুষ গেমাররা পছন্দ করেন অ্যাকশন৷ তবে মেয়েদের পছন্দ এমন গেম, যা তাঁদের জন্য আরামদায়ক এবং অনেকটা কমিউনিটি নির্ভর হয়৷ সংশয়, মারামারি আর প্রতিযোগিতায় ভরপুর গেম তাঁদের বিশেষ পছন্দ নয়৷ বরং সামাজিক গেম, যেগুলো ফেসবুকের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং বন্ধুদের সঙ্গে খেলা সম্ভব, সেগুলোই খেলে থাকেন মেয়ে গেমাররা৷
ছবি: dapd
নারী ডিজাইনারের সংখ্যা কম
জার্মানিতে নারী ডিজাইনারের সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ৷ সে কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও গেম ডেভেলপের ক্ষেত্রে নারীর পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না৷
ছবি: DW
তাই বিতর্কিত উপস্থাপন
ডিজাইনের ক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি কম হওয়ার কারণে গেমগুলোর নারী চরিত্রগুলোকে হয় বাড়াবাড়ি রকম সেক্সি, না হয় অসহায় মানুষ হিসেবে দেখানো হয়৷ নারী ডিজাইনারের সংখ্যা বাড়লে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা৷
ছবি: AP
কেন কম?
জার্মানির আরেক গেম ডিজাইনার ক্যারোলিন গেপার্ট৷ তাঁর নিজের একটি গেম তৈরির কোম্পানি রয়েছে, যার নাম ‘ইয়ো মেই’৷ শুরুতে কাজ করতেন একটি কোম্পানিতে৷ সেখানে কাজ শিখে পরে নিজেই নিজের সংস্থাটি খোলেন৷ কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারেন না, কেন গেম শিল্পে মেয়েদের উপস্থিতি এতটা কম৷
ছবি: DW
6 ছবি1 | 6
নাগরিকদের অভিযোগ থাকলেও দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানো সম্ভব৷ যেমন কোনো বাসিন্দা যদি বলেন যে তাঁর নিজের বা প্রতিবেশীর বাড়ির উপর টার্বাইনের ছায়া পড়ছে, তখন সেই ভুল দ্রুত শুধরে নেওয়া যায়৷ ড.রিক্স বলেন, ‘‘সব তথ্য একত্র করাই হলো লক্ষ্য, যাতে সংঘাতের সব সম্ভাবনাই স্পষ্ট হয়ে যায়৷ কিন্তু সঙ্গে সমাধানসূত্রও দিতে হবে৷ আমাদের বিশ্বাস, প্রকল্প শেষ হলে পরিস্থিতি ঠিক কেমন হবে সেটা আগেভাগে দেখাতে পারলেই সংঘাতের সম্ভাবনা কমে যায়৷ অযৌক্তিক আপত্তি আগেই দূর করা যায়৷''
ছোট আকারের নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও নাগরিকদের এভাবে শামিল করা সম্ভব৷ সরকারি পরিকল্পনার সঙ্গে আকাশ থেকে তোলা ছবি ও জিওডেটা সমন্বয় করতে হয়৷ মিশেল ক্রেমার বলেন, ‘‘নির্মাণের এলাকা ভবিষ্যতে গোটা অঞ্চলের পরিপ্রেক্ষিতে কেমন দেখতে হবে, তা আমরা দেখাতে পারি৷ এলাকার বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে সেই প্রকল্প কেমন দেখতে হবে, তাও আমরা সিমুলেট করতে পারি৷''
ভবিষ্যতে অনলাইন পরিষেবার ক্ষেত্রেও এমন ভিশুয়ালাইজেশন-এর মাধ্যমে নাগরিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ সম্ভব হবে৷ ড. রিক্স বলেন, ‘‘পরের ধাপে এই প্রযুক্তি ইন্টারনেটেও সম্ভব করে তোলা হবে বলে আমাদের ধারণা৷ তখন সরাসরি নাগরিকদের কাছে প্রশ্ন রাখা যাবে, তাদের শামিল করা যাবে৷ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা সরাসরি মন্তব্য করতে পারবে৷''
কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকরা এমন প্রকল্পের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব অনুভব করবেন বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন৷ সে ক্ষেত্রে যুক্তি-নির্ভর আলোচনাও সম্ভব হবে৷