বাংলাদেশের হার আগের দিনই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল৷ তবে তার আগে লিটন উপহার দিলেন ব্যাটিং মাস্টারক্লাস৷ মাঠ আর টিভির পর্দার সামনে সবাইকে বিনোদনে দারুণ মোহিত করলেন লিটন ৷
বিজ্ঞাপন
নান্দনিকতা ও নিয়ন্ত্রণ, কতৃত্ব আর কাব্যিক শটের মহড়া, সবকিছুই ফুটে উঠল একটি ইনিংসে৷ দল বড় হারের পথে৷ ম্যাচ তিন দিনেই খতম হওয়ার দিকে৷ প্রতিপক্ষের পেস আক্রমণের একের পর এক থাবা৷ সবকিছু একদিকে, লিটন কুমার দাস যেন ভিন্ন এক ভুবনে ৷ হ্যাগলি ওভালের সবুজ ক্যানভাসে আঁকলেন তুলি আঁচড়৷ রাজা হয়ে প্রবল দাপটে আছড়ে ফেললেন ‘শত্রুর' সব বাধা!
ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের জয় ইনিংস ও ১১৭ রানে৷ প্রথম টেস্ট হারের ধাক্কা সামলে বিশাল জয়ে সিরিজ ড্র করতে পারল টেস্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নেরা৷ নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট জয়ের অভাবনীয় প্রাপ্তিকে সিরিজ জয়ের উচ্চতায় নিতে পারল না বাংলাদেশ৷তবে এই সফরের আগে ধুঁকতে থাকা দলের জন্য সিরিজ ড্র করতে পারাও বড় অর্জন৷
বাংলাদেশের শেষের প্রাপ্তি লিটনের সেঞ্চুরি৷ দুর্দান্ত সব ড্রাইভ, কাট আর পুল শটের মিশেলে ১১৪ বলে ১০২ রানের ইনিংস৷ ক্যারিয়ারের প্রথম ২৫ টেস্টে সেঞ্চুরি ছিল না তার৷ এখন চার টেস্টের মধ্যে করে ফেললেন দুটি সেঞ্চুরি৷
নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের অনেক রেকর্ডের জয়
মুমিনুল, লিটন, জয় আর শান্তর দুর্দান্ত ব্যাটিং, মিরাজের অলরাউন্ড পারফর্ম্যান্স এবং ইবাদত, শরিফুল ও তাসকিনের বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডে সত্যিই অনেক রেকর্ডের এক জয় পেয়েছে বাংলাদেশ৷ ছবিঘরে সেই জয়ের বিস্তারিত...
ছবি: Hannah Peters/Getty Images
শুরুতে শরিফুল
মাউন্ট মঙ্গানুইতে নিউজিল্যান্ড শিবিরে প্রথম কাঁপনটা ধরিয়েছিলেন শরিফুল ইসলাম৷ ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমে ৬৯ রানে ৩ উইকেট নেন প্রথম ইনিংসে৷ বাঁ হাতি এই পেসারের দুর্দান্ত বোলিং ছাড়া প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ডকে ৩২৮ রানে গুটিয়ে দেয়া কঠিন হতো৷
ছবি: MICHAEL BRADLEY/AFP/Getty Images
মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স
প্রথম থেকে ম্যাচের শেষ দিন পর্যন্ত যখনই প্রয়োজন কিছু-না-কিছু অবদান রেখেছেন ডান হাতি এই অফ স্পিনার৷ দুই ইনিংস মিলিয়ে (৮৬/৩, ৪৩/১) চার উইকেট এবং ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে তার ৪৭ রান বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ে নিঃসন্দেহে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে৷
ছবি: MICHAEL BRADLEY/AFP/Getty Images
জয়ের ব্যাটে প্রথম হাসি
তবে বাংলাদেশ প্রথমে বড় স্বপ্নের আস্থা পেয়েছিল প্রথম ইনিংসে সাদমান ইসলাম আর মাহমুদুল হাসান জয়ের উদ্বোধনী জুটিতে৷ সাদমান ২২ রান করে আউট হওয়ায় ৪৩ রানে ভাঙে তাদের জুটি৷ তবে মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা জয় আউট হন প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির আশা জাগানো ৭৮ রান করে৷
ছবি: MICHAEL BRADLEY/AFP/Getty Images
শান্তর ব্যাটে ভরসা
প্রথম ইনিংসে জয়-শান্তর ১০৪ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটির অবদানের কথাও ভুললে চলবে না৷ শতাধিক রানের জুটিতে শান্তর অবদান ৬৪ রানের৷
ছবি: MICHAEL BRADLEY/AFP/Getty Images
অধিনায়কোচিত মুমিনুল
পঞ্চপাণ্ডবের চারজনই্ নেই দলে৷ প্রতিপক্ষ টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ড৷ মুশফিকুরের পর দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মুমিনুলের কাছে তাই প্রত্যাশা ছিল বেশি৷ মাউন্ট মঙ্গানুইতে হতাশ করেননি মুমিনুল৷ শুধু ব্যাট নয়, বলও কথা বলেছে তার হাতে৷ প্রথম ইনিংসে তার অফ স্পিনে বোকা হয়েছিলেন দুই কিউই ব্যাটসম্যান৷ তারপর ব্যাট হাতে তার ৮৮ রানের ইনিংস কিন্তু পুরো ম্যাচেই বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ৷
ছবি: Hannah Peters/Getty Images
লিটনের প্রত্যাশা পূরণ
উইকেটকিপা ব্যাটসম্যানের ভূমিকাটা প্রত্যাশিতভাবেই পালন করেছেন লিটন কুমার দাস৷ দুই ইনিংস মিলিয়ে তার মোট ক্যাচ চারটি৷ একমাত্র সুযোগে তার ব্যাট থেকেও এসেছে চোখ জুড়ানো ৮৬ রান৷
ছবি: Tsvangirayi Mukwazhi/AP/picture alliance
ইবাদতে হতাশার ইতি
টেস্টে সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেও দেশের মাটিতে হেরেছে বাংলাদেশ৷ এমন ব্যর্থতা ভোলাতে দরকার ছিল বড় কোনো জয়ের৷ সেই জয়টা যে শেষ পর্যন্ত ইবাদত হোসেনই এনে দিয়েছেন সে বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ খুব কম৷ ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ টেস্টে ৮১.৫৪ গড়ে মাত্র ১১ উইকেট ছিল যার ঝুলিতে, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৯ রানে ৬ উইকেট নেয়া ঝড়ের সুবাদে সেই ইবাদতই মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের ম্যান অব দ্য ম্যাচ৷
ছবি: MICHAEL BRADLEY/AFP
তাসকিন, দ্য আনসাং হিরো
দুই ইনিংসেই চমৎকার বোলিং করেছেন তাসকিন আহমেদ৷ প্রথম ইনিংসে ৭৭ রান দিয়ে কোনো উইকেট না পেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ইবাদত-ঝড়ের ফাঁকেও ৩৬ রানে ৩ উইকেট নিয়ে তিনিই বাংলাদেশের দ্বিতীয় সফলতম বোলার৷ বোলিংয়ের সুযোগ না পাওয়া ইয়াসির আলি রাব্বির ব্যাট থেকে পাওয়া ২৬ রানও বাংলাদেশকে প্রথম ইনিংসে ১৩০ রানের লিড পেতে খুব সহায়তা করেছে৷
ছবি: MICHAEL BRADLEY/AFP/Getty Images
অনেক রেকর্ডের জয়
নিউজিল্যান্ডে এর আগে তিন ফর্ম্যাটে ৪৩টি ম্যাচের একটাতেও জিততে পারেনি বাংলাদেশ৷ অন্যদিকে দেশের মাটিতে ২০১৭ সাল থেকে টানা আট সিরিজ জিতেছে কিউইরা৷ শেষ ১৭ টেস্টের একটাতেও হারেনি৷ বাংলাদেশের কাছে হারের ফলে সেই অহঙ্কারগুলো আপাতত শুধুই সুখস্মৃতি৷অন্যদিকে দেশের বাইরে এটি বাংলাদেশের ষষ্ঠ টেস্ট জয়৷ প্রথম বারের মতো রাঙ্কিংয়ের সেরা পাঁচের কোনো দলকে তাদের মাটিতে হারানোকে ইতিহাসের সেরা সাফল্য বলছেন অনেকেই৷
ছবি: Hannah Peters/Getty Images
9 ছবি1 | 9
ম্যাচের ফল যেমন, তেমনি শেষটাও হলো নিউজিল্যান্ডের জন্য হলো প্রাপ্তির পূর্ণতায়৷ শেষ উইকেটের জন্য বল হাতে তুলে দেওয়া হলো বিদায়ী টেস্ট খেলতে নামা রস টেইলরের হাতে৷ ৮ বছর পর টেস্টে বল হাতে নিয়ে প্রথম ওভারেই তিনি দেখা পেলেন উইকেটের৷ নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সফলতম ব্যাটসম্যান টেস্ট থেকে বিদায় নিলেন শেষ বলে উইকেট নিয়ে৷ আড়াইশ রানের ইনিংস খেলা টম ল্যাথাম কিংবা দারুণ বোলিং করা পেসারদের ছাপিয়ে কিউই উৎসবের মধ্যমণি তখন টেইলর৷
লিটনের আগে বাংলাদেশের অন্য ব্যাটসম্যানরাও চেষ্টা করেন লড়াইয়ের৷ উইকেট আঁকড়ে রাখেন বেশ কজন৷ তবে বড় ইনিংস খেলতে পারেননি কেউই৷
তবে প্রথম ইনিংসে ফিফটি করা ব্যাটসম্যান সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি৷ ওয়্যাগনারের আরেকটি বাউন্সার সামলাতে না পেরে সহজ ক্যাচ দেন সেই ল্যাথামের হাতেই (২) ৷ টেস্টে বাংলাদেশের শতরানের জুটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গতিময় এটিই, ওভারপ্রতি রান তোলেন তারা ৫.৮২৷ ষষ্ঠ উইকেটে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম শতরানের জুটিও এটি৷
লিটন সেই পথে পা বাড়াননি৷ আঙুলে কয়েক দফায় আঘাত সয়ে, টেপ পেঁচিয়ে, ব্যথানাশক স্প্রে নিয়ে শতরান পূরণ করেন তিনি ১০৬ বলে৷ মাঠে থাকা সমর্থকেরা তুমুল উল্লাসে অভিনন্দন জানান তাকে অসাধারণ ইনিংসে৷ সেঞ্চুরির পরপরই আউট হয়ে যান তিনি জেমিসনের ভেতরে ঢোকা বলে৷ দ্বিতীয় নতুন বলের আগেই শেষ হয় বাংলাদেশের ইনিংস৷
টানা ১০ ইনিংসে রান না পাওয়া ইবাদত হোসেন অবশেষে রানের মুখ দেখেন৷ তবে তাকে শিকার বানিয়ে ম্যাচ আর নিজের ক্যারিয়ারের ইতি টানেন টেইলর৷
২৫২ রানের ইনিংসের জন্য ম্যাচের সেরা কিউইদের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক ল্যাথাম৷ আর দুই টেস্টে দুই সেঞ্চুরিতে সিরিজের সেরা ডেভন কনওয়ে৷