বার্লিনের জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল আ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স-এর বিশেষজ্ঞ গ্যুন্টার জয়ফার্ট-এর মতে, সুরুচ-এর বোমাবাজি ছিল তুরস্কের সাম্প্রতিক নীতিবদলের বিরুদ্ধে ইসলামিক স্টেট-এর প্রতিশোধ৷
বিজ্ঞাপন
সুরুচ নামধারী ছোট্ট শহরটি সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সীমান্তের অদূরে অবস্থিত৷ সোমবার সেখানে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন সীমান্তের অপরপারে আইএস-এর সঙ্গে কুর্দ পেশমার্গার যুদ্ধে প্রায় পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত কোবানে শহরটি পুনর্নির্মাণে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে৷ সমাবেশে সম্ভবত এক আইএস সন্ত্রাসী অথবা আইএস সমর্থক একটি আত্মঘাতী বোমা আক্রমণ চালিয়ে ৩২ জন মানুষের প্রাণ নেয়, আহত হন শতাধিক৷
এবার তুর্কি প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতোলু-ও স্বীকার করেছেন যে, আততায়ীর ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে যোগ থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে৷ তবে কি এবার আইএস-এর প্রতি তুরস্কের মনোভাব পাল্টাতে চলেছে? ডয়চে ভেলের ক্রিস্টফ হাসেলবাখ তুরস্ক বিশেষজ্ঞ গ্যুন্টার জয়ফার্ট-এর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা বলেন৷
ডিডাব্লিউ: কুর্দ গোষ্ঠীগুলির মতে, সুরুচ-এর আক্রমণের জন্য তুর্কি সরকারও অংশত দায়ী৷ এই অভিযোগ কি যুক্তিযুক্ত?
গ্যুন্টার জয়ফার্ট: তুরস্ক যে ইসলামিক স্টেট-কে বাস্তবিক সাহায্য করেছে, তার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ এ'যাবৎ অবর্তমান৷ তবে আমরা জানি যে, তুরস্ক সরকারিভাবে বিভিন্ন জিহাদি গোষ্ঠীকে সাহায্য করে থাকে, যেমন আল নুসরা ফ্রন্ট, যাদের যোদ্ধাদের তুরস্ক ও সৌদি আরবে প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি দেওয়া হয়ে থাকে৷ আল নুসরা ফ্রন্ট এবং ইসলামিক স্টেটের মতাদর্শ মোটামুটি এক৷
এ বছরের ১৭ই জুন যখন সিরিয়ার কুর্দ যোদ্ধারা তুরস্কের সীমান্তে অবস্থিত তাল আবিয়াদ শহরটি থেকে আইএস-কে বিতাড়িত করে, তখন তুরস্ক উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল যে, সিরিয়ার কুর্দরা সেখানে তাদের আধিপত্য বিস্তার করবে, যা কিনা তুরস্কের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে৷ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়া যাবৎ তুরস্কের নীতির ভিত্তি হলো এই শঙ্কা যে, কুর্দরা সিরিয়ায় একটি স্বশাসিত এলাকা প্রতিষ্ঠা করতে পারে৷ আংকারার কাছে ইসলামিক স্টেট সে-তুলনায় ততটা বিপজ্জনক নয়৷
সিরিয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদি নীতি কী?
তুরস্কের ভিতরে ও বাইরে কুর্দদের স্বশাসন রোধ করা৷ কিন্তু এই নীতি বজায় রাখা যাবে না৷ আমরা দেখেছি যে, তুর্কি সরকার ৩০ বছর ধরে স্বদেশে পিকেকে-র সঙ্গে যুদ্ধ চালানোর পর এবার আলাপ-আলোচনায় বসতে বাধ্য হচ্ছেন৷ কেননা কুর্দ স্বাধীনতা আন্দোলনের নিজস্ব গতিশীলতার বিরুদ্ধে তুর্কি সরকারের কিছুই করার নেই৷
যদি প্রমাণ হয় যে, সুরুচ-এর আক্রমণের পিছনে সত্যিই আইএস-এর হাত রয়েছে, তবে কি তুরস্ক তার নীতি বদলাতে পারে?
আমরা দেখছি, এই সব আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্ক তার নীতি বদলাতে শুরু করেছে, তবে খানিকটা মার্কিন চাপেও বটে৷ আমরা জানি, বিগত কয়েক সপ্তাহে তুরস্কে আইএস সংক্রান্ত প্রথম কিছু গ্রেপ্তারির ঘটনা ঘটেছে – আইএস সমর্থকদের গ্রেপ্তারির ঘটনা৷ পুলিশ যে সত্যিই আইএস-এর বিরুদ্ধে সক্রিয় হচ্ছে এবং সামরিক বাহিনী যে প্রতি সপ্তাহে জানাচ্ছে, কতজন অনুপ্রবেশকারীকে সিরীয় সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করা হলো – এ সবই খুব নতুন৷
মার্কিনি এবং ইউরোপীয়রা গত দেড় বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন যে, ইউরোপ তথা বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকে আগত হবু আইএস যোদ্ধাদের সীমান্ত পার হয়ে সিরিয়ায় ঢোকা থেকে বিরত করতে হবে৷ এতদিনে তুরস্ক সে কাজ শুরু করেছে৷ আইএস-এর সর্বাধুনিক আক্রমণ তুরস্কের এই নতুন নীতির প্রতিশোধ বলে অনেকের ধারণা৷
তুরস্ক জানিয়েছে, তিন হাজারের মতো শরণার্থী সপ্তাহান্তে সেদেশে প্রবেশ করেছে৷ ‘ইসলামিক স্টেট’ এবং কুর্দি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের মাত্রা বাড়ায় সিরীয়রা তাদের সবকিছু ফেলে রেখে দেশত্যাগ করছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
বাধ্য হয়ে পলায়ন
গত সপ্তাহে ১৩ হাজারের মতো সিরীয় সেদেশের তেল আবিয়াত শহর ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে৷ আধুনিক ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার নামে সহিংস প্রচারণার জন্য বিদেশে সেনা নিয়োগে শহরটি ব্যবহার করে জঙ্গিগোষ্ঠী৷ তুরস্ক অবশ্য শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়নি৷ ফলে অবৈধভাবে দেশত্যাগ করেছে তারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
জঙ্গি এবং বন্ধ সীমান্তের মাঝে
কুর্দি সেনারা ধীরে ধীরে তেল আবিয়াত শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ ইতোমধ্যে শহরটির কাছের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম দখল করেছে তারা৷ কুর্দিদের ঠেকাতে দুটি সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে ‘ইসলামিক স্টেট৷’ তবে, কিছু সিরীয় গোলাগুলির মাঝে আটকে পড়ে শহরটিতে রয়ে গেছে৷ আর যারা সেখান থেকে বের হতে পেরেছে, তারা বাধা পেয়েছে সীমান্তে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
‘ইসলামিক স্টেট’-এর থাবা থেকে রক্ষা
গত সপ্তাহান্তে তিন হাজারের মতো শরণার্থী সিরীয়-তুর্কি সীমান্ত অতিক্রম করেছে৷ ছবিতে কিছু সিরীয়কে দেখা যাচ্ছে, যারা অবৈধভাবে কাটাতারের বেড়া অতিক্রম করে তুরস্কে প্রবেশের চেষ্টা করছে৷ তেল আবিয়াত ‘ইসলামিক স্টেট’-এর নিয়োগ কেন্দ্র হলেও কুর্দি সেনারা সেখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছিল সিরীয়রা৷
ছবি: Reuters/K. Celikcan
‘সীমান্তের মধ্যে থাকুন’
সিরীয়রা সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করলে গরম পানি এবং ‘পিপার স্প্রে’ করে তুর্কি বাহিনী৷ এক পর্যায়ে অবশ্য একটি সীমান্ত অনিচ্ছুকভাবে খুলে দেয়া হয়৷ তুরস্কের উপ-প্রধানমন্ত্রী নুমান কুর্টুলমুস জানিয়েছেন, সিরীয়রা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলা এড়ানোর চেষ্টা করছেন৷ আমরা তাদের সীমান্তের মধ্যে রাখার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, বলেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Str
ইউএনএইচসিআর-এর কাছে নথিভুক্ত ৪০ লাখ সিরীয়
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর মে মাসের শেষের দিকে জানিয়েছে, চল্লিশ লাখের মতো শরণার্থী তাদের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য নথিভুক্ত হয়েছে৷ সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে এখন অবধি সতের লাখের মতো শরণার্থী গ্রহণ করেছে তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Gurgah
সবচেয়ে ‘বেশি ভুগছে’ শিশুরা
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশনার আন্থনিও গুটারেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, সিরিয়ায় সংঘাতের কারণে সিরীয় ছেলে-মেয়েরা ব্যাপকহারে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ তুরস্কে নিবন্ধিত সিরীয় শরণার্থীদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
যথেষ্ট নয়
চলতি বছরের শুরুতে তুরস্ক সিরীয় শরণার্থীদের জন্য তাদের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পটি খুলে দিয়েছে৷ সুরুচ ক্যাম্পে ৩৫ হাজারের মতো শরণার্থী বসবাস করে৷ আরো ৯০ হাজার শরণার্থীর অবস্থান দেশটির ২৫টি ক্যাম্পে৷ তবে ইউএনএইচসিআর-এর প্রশংসা সত্ত্বেও তুরস্ক রেকর্ড সংখ্যক সিরীয় শরণার্থীর চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
পেছনে ফেলে আসা
তেল আবিয়াত শহর থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে কোবানিতে এখনও কিছু সিরীয় রয়ে গেছেন৷ ইসলামিক স্টেট-এর গণহারে মানুষ হত্যা এবং কুর্দি পেশমার্গা বাহিনীর হামলায় শহরটি কার্যত ধ্বংসস্তুতে পরিণত হয়েছে৷ সেখানে খাবার এবং বিদ্যুতের অভাব রয়েছে৷ তা সত্ত্বেও অল্প কিছু মানুষ শহরটিতে টিকে থাকার লড়াই করছে৷