জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বুকে বনজঙ্গলের চরিত্র বদলে যাচ্ছে৷ পৃথিবী ও মহাকাশ থেকে তা পর্যবেক্ষণ করছেন বিজ্ঞানীরা৷ এই পরিবর্তনের খুঁটিনাটি বুঝতে উদ্যোগ নিচ্ছেন জার্মান বিজ্ঞানীরা৷
বিজ্ঞাপন
বিচ গাছের বনে বিপদের ছায়া৷ হাইনরিশ জাতীয় পার্ক গোটা ইউরোপের সবচেয়ে বড় ‘ডেসিডুয়াস' জঙ্গল৷ মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের বায়ো-জিয়োকেমিস্টরা জানতে চান, সেখানকার মাটিতে কতটা কার্বন রয়েছে৷ ইয়েনা শহরে মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের মার্কুস রাইশস্টাইন বলেন, ‘‘এখন যা দেখা যাচ্ছে, তাতে গাছপালার তুলনায় মাটিতেই কার্বনের মাত্রা বেশি৷ আমাদের অনুমান, গত ১০ বছরে মাটিতে কার্বনের পরিমাণ দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ বেড়ে গেছে৷''
এর পরিমাণ প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টন৷ কিন্তু কার্বন চিরকাল মাটিতে থাকে না৷ মাশরুম ও ব্যাকটেরিয়া গাছের পাতা ও শিকড় প্রক্রিয়াকরণ করে৷ ফলে কিছুটা করে কার্বন আবার রিলিজ করে৷ এমনিতে এটা কোনো সমস্যা নয়৷ কিন্তু মানুষ বায়ুমণ্ডলে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড সৃষ্টি করে, তার ফলে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে৷ মাইক্রো-অরগ্যানিজম আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আরও কার্বন রিলিজ হয়৷
ল্যাবে মাটির স্যাম্পেল পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ পোড়ানোর সময় বোঝা যায় মাটিতে কতটা কার্বন ডাই-অক্সাইড রয়েছে৷ তরলের মধ্যে অরগ্যানিক কার্বনের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়৷
সুন্দরী বন সুন্দরবন
বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন৷ বাংলাদেশ ও ভারতজুড়ে বিস্তৃত এ বনের মোট আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার৷
ছবি: DW/M, Mamun
বিশ্ব ঐতিহ্য
বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬০১৭ কিলোমিটার৷ আয়তনের প্রায় ৭০ ভাগ স্থল আর ৩০ ভাগ জল৷ পুরো সুন্দরবনের ভেতরে জালের মতো অসংখ্য নদী আর খাল রয়েছে৷ জীববৈচিত্রে ভরপুর সুন্দরবনকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ প্রায় ৪০০ প্রজাতির পাখির বসবাস এই বনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
বাঘের পায়ের ছাপ
সুন্দরবনের কটকা বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য৷ সেখানেই দেখা মেলে বেঙ্গল টাইগারের পায়ের ছাপ৷ এ বনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ডোরাকাটা বাঘ৷ জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যের অভাব আর চোরা শিকারসহ নানা কারণে দিন দিন এখানে কমে আসছে বাঘের সংখ্যা৷ বন বিভাগের মতে, সুন্দরবনে বর্তমানের বাঘের আনুমানিক সংখ্যা ৫০০৷ ২০০৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাঘশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা ছিল ৪৪০৷
ছবি: DW/M, Mamun
অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রা হরিণ
সুন্দরবনের কটকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে চিত্রা হরিণ৷ সুন্দরবনের সর্বত্রই এ প্রাণীটির দেখা মেলে৷ চিত্রা আর মায়া – এ দুই ধরণের হরিণ আছে সুন্দরবনে৷ তবে সবচেয়ে বেশি আছে চিত্রা হরিণ৷ ৩০ হাজারেরও বেশি চিত্রা হরিণের বসবাস সুন্দরবনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
যার নামে সুন্দরবন
সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছই চির সবুজ ম্যানগ্রোভ শ্রেণির৷ এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী৷ এ গাছের নামেই বনের নামকরণ৷ এছাড়া এই বনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ আছেস যার মধ্যে ১৭টি ফার্ন জাতীয়, ৮৭টি একবীজপত্রী ও ২৩০ প্রজাতি দ্বিবীজপত্রী৷ সারা পৃথিবীজুড়ে যে ৫০ প্রজাতির প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ আছে, তার ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় বাংলাদেশের সুন্দরবনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ
প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক আসেন সুন্দরবন ভ্রমণে৷ ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ লাখ ২০ হাজার ৪১৪ জন পর্যটক বেড়াতে এসেছেন এখানে, যাঁদের মধ্যে বিদেশি পর্যটক ৩ হাজার ৮৫৪ জন৷
ছবি: DW/M, Mamun
বিচিত্র সাপ
শরণখোলা রেঞ্জের একটি জঙ্গলে গ্রিন ক্যাট স্নেক বা সবুজ ফনিমনসা সাপ৷ কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ ছাড়াও সুন্দরবনে দেখা যায় কিং কোবরা বা রাজগোখরা, রাসেলস ভাইপার, পিট ভাইপার, পাইথন, ব্যান্ডেড ক্রেইড ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M, Mamun
কুমির দর্শন
জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ – সুন্দরন নিয়ে এরকম প্রবাদ বহুকালের৷ সুন্দরবনের হারবাড়িয়া এলাকার একটি খালে লোনা জলের এই কুমিরটিকে দেখা গিয়েছিল৷ সুন্দরবনের মহা বিপন্ন এ প্রাণীটি আকারে সাত মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়৷ লোনা পানির কুমিরের গড় আয়ু ১০০ বছরের মতো৷
ছবি: DW/M, Mamun
হরিণের বন্ধু
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে তোলা বানরের ছবি৷ সুন্দরবনে চিত্রা হরিণের পর সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ প্রাণীটি৷ সুন্দরবনে বানরকে হরিণের সুহৃদ বলা হয়৷ গাছের ডাল ভেঙ্গে হরিণকে পাতা খেতে বানর সহায়তা করে থাকে৷ এছাড়া বাঘের আগমনের খবরটিও সবার আগে হরিণকে দেয় বানর৷
ছবি: DW/M, Mamun
জঙ্গল উপভোগ
সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্যের ছোট খালে ঘুরে জঙ্গল উপভোগ করছেন পর্যটকরা৷ সকাল এবং বিকেলে এসব খালে বেড়ানোর সময় অনেক বন্য প্রাণীর দেখা মেলে৷
ছবি: DW/M, Mamun
ভ্রমণতরী
সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে একটি বেসরকারি সংস্থার ভ্রমণতরী৷ সুন্দরবন দেখতে আসা বিদেশি পর্যটকদের বেশির ভাগই আসেন বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থাগুলোর সহায়তায়৷ এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগেরও অভাব অনেক৷
ছবি: DW/M, Mamun
পণ্যবাহী জাহাজের কারণে ডলফিনের মৃত্যু
সুন্দরবনের ভেতরে জঙ্গল ঘেঁষে চলাচল করছে বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ৷ এ সব জাহাজের উচ্চ শব্দ যেমন বন্যপ্রাণীদের বিরক্তির কারণ হয়, তেমনি এসব জাহাজের সৃষ্ট ঢেউ ভাঙন ধরায় সুন্দরবনে৷ এ সব জাহাজের প্রোপেলারের আঘাতে প্রায়ই ডলফিনেরও মৃত্যু ঘটে৷
ছবি: DW/M, Mamun
অপরূপ সূর্যাস্ত
সুন্দরবনের কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে সূর্যাস্তের ছবি তুলছেন এক পর্যটক৷
ছবি: DW/M, Mamun
রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষেই এগিয়ে চলছে রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ৷ এতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হয় বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও মানব বসতির ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয় না৷ অথচ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের সংরক্ষিত ও স্পর্শকাতর স্থানের দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার৷
ছবি: DW/M, Mamun
13 ছবি1 | 13
বিজ্ঞানীরা আরও অনেক কিছু পরিমাপ করেন৷ যেমন দিনের কোন সময় গাছের পাতা সক্রিয়ভাবে সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতি চালায় এবং এই কাজে তারা বায়ুমণ্ডল থেকে কতটা কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে৷ রাইশস্টাইন বলেন, ‘‘বনজঙ্গল ও বায়ুমণ্ডলের মধ্যে অ্যাসিমিলেশনের দিকে আমরা নজর দিচ্ছি৷ এটা অনেকটা মানুষের ফুসফুসের ক্রিয়া মাপার মতো বিষয়৷ আমরা গ্যাসগুলির কম্পোজিশন খতিয়ে দেখছি, মানুষের ক্ষেত্রে যাকে ব্লাড কাউন্ট বলা হয়৷ এভাবে আমরা পৃথিবীর বুকে সব সম্ভাব্য ক্রিয়াগুলির দিকে নজর দিচ্ছি – বিশেষ করে ইকো সিস্টেম ও বায়ুমণ্ডলের মধ্যে৷''
তারপর বিচ গাছের বন থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে অনেক অঙ্ক করতে হয়৷ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মনিটারিং স্টেশন এবং পর্যবেক্ষক স্যাটেলাইট থেকে তথ্যও কাজে লাগানো হয়৷ এর ফলে কিছু মডেল সৃষ্টি হয়৷ রাইশস্টাইন বলেন, ‘‘রং যত সবুজ, তত বেশি সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া চলছে৷ আমাদের এখানে সেটা সাধারণত গ্রীষ্মেই ঘটে – জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে৷ এশিয়ার মতো অঞ্চলে সেটা বর্ষার উপর অনেকটা নির্ভর করে৷ আবহাওয়া যখন শুষ্ক হয়ে ওঠে, তখন সালোকসংশ্লেষও কমে যায়৷ তারপর বর্ষা ও তার পরের মাসগুলিতে আর্দ্রতা বাড়লে সালোকসংশ্লেষও আবার বেড়ে যায়৷''
বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে গবেষকরা অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন৷ কিন্তু পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে চলেছে৷ বনজঙ্গলের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের কী প্রভাব পড়ছে এবং ঘনঘন আবহাওয়ার ফারাক আরও তীব্র হতে থাকলে কী ঘটে, তার আরও নিখুঁত পূর্বাভাষ দেবার চেষ্টা চলছে৷ তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেও বনজঙ্গল তা মোটামুটি সামলে নিতে পারে৷ তবে ঘনঘন খরা দেখা দিলে সেটা বড় বিপদের কারণ হতে পারে৷ রাইশস্টাইন বলেন, ‘‘ধরে নেওয়া যেতে পারে, যে নির্দিষ্ট কিছু প্রজাতি এর ফলে অন্যদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ তখন কিছু প্রজাতির গাছ জঙ্গল থেকে উধাও হয়ে যাবে, আবার কিছু নতুন প্রজাতি যোগ হবে৷ অতএব ভবিষ্যতে গাছপালার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে৷''
এই জঙ্গল হয়ত কোনো এক সময় এখনকার তুলনায় অনেক বদলে যাবে৷ বিজ্ঞানীরাও হয়ত আগেভাগেই তার পূর্বাভাষ দিতে পারবেন৷