একরাম হত্যা নিয়ে বিতর্ক
২৯ মে ২০১৮কক্সবাজারের টেকনাফের ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন৷ এই মৃত্যুর পর থেকেই তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ ওই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁকে নিরাপরাধ বলছেন৷ নাম বিভ্রাটের কারণে ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা একরামকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁদের দাবি৷ তবে র্যাবের দাবি, অন্তত ৪/৫টি তালিকায় একরামের নাম রয়েছে এবং তিনি একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী৷
মাদকবিরোধী অভিযানে একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা, শতাধিক মানুষের মৃত্যু– কী ভাবছে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন? প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মাদকবিরোধী অভিযান ভালো৷ সেই অভিযানে যেন কোনো মানুষের মৃত্যু না হয় সেদিকে আমরা নজর রাখতে বলেছি৷ গতকালই আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পত্র লিখেছি, এই অভিযান যেন খুবই সতর্কতার সঙ্গে করা হয়৷ ইতিমধ্যে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ সামনে যেন এদিকে বিশেষ নজর রাখা হয়৷’’ মানবাধিকার কমিশন কি কোন ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা নিয়ে তদন্ত করছে? আসলে সেখানে কী ঘটেছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে জনাব ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের পক্ষে এটার তদন্ত করার সুযোগ নেই৷ আইনগতও নেই, জনবলও নেই৷ আমরা তদন্ত করছি না, এই কারণেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে বলেছি ডিও দিয়ে যে, এই অভিযানগুলোতে যেন বিশেষ নজর রাখা হয়৷’’
টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে কক্সবাজার আওয়ামী লীগ৷ কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান চৌধুরী মাবু ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি খোলা চিঠি লিখে একরামুল নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্ত দাবি করেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘গতকালই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা এই ঘটনা তদন্ত করে দেখবে৷ পাশাপাশি কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাঁর পরিবারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘১৯৮৫ সাল থেকে আমি আর একরামুল হক একসঙ্গে রাজনীতি করছি৷ এক দশকের বেশি সময় উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তাঁর এমন মৃত্যুর ঘটনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তো বটেই, টেকনাফের সাধারণ মানুষও সহজভাবে নিচ্ছে না৷ এটার কোথাও ভুল রয়েছে৷ তদন্ত করে সেটা বের করতে হবে৷ আমি তো মনে করি, একটা ভালো অভিযান বিতর্কিত করার জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে৷ কারণ, এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে এক সময় এই অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে৷'' তিনি বলেন, ‘‘আপনারা তদন্ত করে দেখুন যারা ইয়াবা ব্যবসা করে তারা ফুলে-ফেঁপে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে৷ আর একরামের সম্পদ দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন সে ইয়াবা ব্যবসা করত কি-না৷ ভুল করে তাঁকে মারা হয়েছে৷’’
গত শনিবার রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নোয়াখালিয়া পাড়ায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ৪৬ বছর বয়সি একরামুল হক৷ তিনি টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়ার মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে এবং স্থানীয় ওয়ার্ডের পর পর তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর৷ দীর্ঘ দিন তিনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন৷ একরামুল নিহত হওয়ার পর র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাঁর বাবার নাম আবদুস সাত্তারের জায়গায় লেখা হয় মোজাহার মিয়া ওরফে আবদুস সাত্তার৷ ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ‘তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’ এবং ‘ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার’ আখ্যায়িত করে বলা হয়, ‘‘একরামের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মাদক আইনে একাধিক মামলা আছে৷’’
তবে টেকনাফ থানা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, একরামুলের বিরুদ্ধে এক সময় টেকনাফ থানায় দু'টি মামলা ছিল৷ এর মধ্যে একটি মারামারির ঘটনায় এবং অন্যটি মাদক আইনে৷ মারামারির ঘটনার মামলাটি ইতোমধ্যে আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে৷ আর মাদকের মামলাটিতে তাঁর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে৷ মৃত্যুর আগে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না৷
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বন্দুকযুদ্ধের পর আমরা গুলিবিদ্ধ একটা লাশ উদ্ধার করি৷ তখন স্থানীয় লোকজন শনাক্ত করেন তিনি টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হক৷ একরাম র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি করেছে৷ র্যাবও পালটা গুলি করেছে৷ তার বাবার নাম স্থানীয় লোকজন যা বলেছে সেটাই লেখা হয়েছে৷ বাবার নাম ভুল মানে তিনি যে একরাম নন তা তো নয়৷ পরে খোঁজ নিয়ে আমরা জেনেছি, ৪/৫ তালিকায় শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে তার নাম রয়েছে৷'' স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘‘ইয়াবা ব্যবসার সুফল অনেকে পায়৷ ফলে অনেকেই এখন বড় বড় কথা বলছেন৷’’ একরামের আর্থিক বষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘আগে আলো নামে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেল৷ পরে তার অ্যাকাউন্ট খুঁজে দেখা গেল ১২০ কোটি টাকা রয়েছে৷ তাই একরামের টাকা কোথায় আছে, কী করেছে সেটা তো অন্যরা বলতে পারবেন না৷’’
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল বশর বলেছেন, ‘‘অর্থনৈতিকভাবে তেমন স্বচ্ছল ছিলেন না বলে একরামুল নিজের বাড়ি নির্মাণের কাজ দুই দশকেও শেষ করতে পারেননি৷ প্রতিমাসে নিজের সন্তানের স্কুলের বেতন দিতেও হিমশিম খেতে হতো তাঁকে৷ তাই একরামুলকে ইয়াবা ব্যবসায়ী বলাটাও হাস্যকর৷ এই মৃত্যুর ফলে মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে৷’’
নানা বিতর্কের মধ্যেই অব্যহত রয়েছে মাদকবিরোধী অভিযান৷ সর্বশেষ সোমবার রাতে আরও ১২ জন নিহত হয়েছেন৷ এর মধ্যে কুমিল্লায় দু'জন, কুষ্টিয়ায় দু'জন, যশোরে দু'জন, ঢাকায় একজন, ময়মনসিংহে একজন, সাতক্ষীরায় একজন, বরগুনায় একজন, ঠাকুরগাঁওয়ে একজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন মারা গেছেন৷ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অভিযান শুরুর পর এ নিয়ে গত ১০ দিনে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৩ জন৷ নিহতরা সবাই মাদক কেনা-বেচায় জড়িত বলে দাবি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর৷ তবে তাদের বক্তব্য ও ঘটনার বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো৷