বন্দে মাতরমকে জাতীয় সংগীত না করায় নেহরুকে তোপ মোদীর
৯ ডিসেম্বর ২০২৫
বন্দে মাতরমের দেড়শ বছরে লোকসভায় বিশেষ আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বঙ্কিমচন্দ্রকে চারবার বঙ্কিমদা সম্বোধন করেলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ''মহত্মা গান্ধী ১৯০৫ সালে লিখেছিলেন, বন্দে মাতরম লোকের মুখে মুখে ফিরছে তা জাতীয় সংগীত হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও মুসলিম লিগের দাবির কাছে নতিস্বীকার করেন জওহরলাল নেহরু। নেতাজিকে চিঠি লিখে নেহরু বলেন, তিনি জিন্নার ভাবনার সঙ্গে সহমত, আনন্দমঠের পৃষ্ঠভূমি মনে রাখলে বন্দে মাতরম মুসলিমদের ইরিটেট করতে পারে।''
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ''কলকাতায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বন্দে মাতরমকে টুকরো করা হলো। বন্দে মাতরম এত মহান হওয়া সত্ত্বেও কেন তার প্রতি অন্যায় করা হলো, কেন বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো, কোন শক্তি যার ইচ্ছা পূজ্য বাপুর ভাবনাকেও বাতিল করে দিলো। কংগ্রেস বন্দে মাতরমকে বাতিল করে দিলো। তুষ্টীকরণের রাজনীতি করলো। তাই কংগ্রেসকে ভারতের বিভাজনও মেনে নিতে হয়েছে। কংগ্রেসের নীতি সেরকমই আছে, আজও কংগ্রেস বন্দে মাতরমের বিরোধ করে যাচ্ছে।''
বঙ্কিমদা বলে সম্বোধন
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ভাষণে বার চারেক বঙ্কিমচন্দ্রকে 'বঙ্কিমদা' বলে সম্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ''বঙ্কিমদা যখন বন্দে মাতরম লিখলেন, তখন তা দেশেব স্বর হয়ে উঠলো।'' একাধিকবার বঙ্কিমদা বলার পর তৃণমূল কংগ্রেসের সৌগত রায় বলেন, ''অন্ততপক্ষে বঙ্কিমবাবু বলুন।'' প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ''আমি আপনার ভাবনাকে সমর্থন করি। বঙ্কিমবাবু বলছি।'' তারপর তিনি বলেন, ''আমি আপনাকে তো দাদা বলি। সেটা বলব তো। নাকি তাতেও আপনি আপত্তি করবেন?''
বঙ্কিমচন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অভ্র ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এরকম ধৃষ্টতা কী করে হয়? বঙ্কিমচন্দ্রকে কেউ কখনো বঙ্কিমদা বলেছেন বলে শুনিনি। শ্রীঅরবিন্দ ১৯০৫ সালে প্রথমে বলেন ঋষি বঙ্কিম। তারপর থেকে অনেকেই তাকে ঋষি বঙ্কিম বলেন, বঙ্কিমদা কেউ বলেননি।''
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''হয়তো প্রধানমন্ত্রী একটু বেশি বাঙালি হতে চেয়েছেন।''
কী বলেছেন মোদী?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ''বন্দে মাতরমের ১৫০ বছরের যাত্রা অনেক পর্বের মধ্যে দিয়ে গেছে। এই গান যখন লেখা হয়, তখন দেশ পরাধীন ছিল। এই গান লেখার একশ বছর যখন পূর্ণ হলো, তখন দেশ জরুরি অবস্থার শিকলে বন্দি ছিল। তখন সংবিধানের গলা চেপে ধরা হয়েছিল। দেশভক্তির জন্য যারা বাঁচতেন, মারা যেতেন, তাদের জেলে বন্দি করি হলো। দুর্ভাগ্য, বন্দে মাতরমের একশ বছরে এই কালখণ্ডও ইতিহাসে ঢুকে গেল।''
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ''বন্দে মাতরম কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার মন্ত্র ছিল না, তার থেকে আরো বেশি কিছু ছিল। দেশবাসীর গর্ব হওয়া উচিত।''
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ''জওহরলাল নেহরুর উচিত ছিল, জিন্নার আধারহীন বক্তব্যের কঠোর জবাব দেওয়া, নিন্দা করা। কিন্তু তিনি জিন্নার ভাবনার সঙ্গে সহমত হলেন। কংগ্রেস মুসলিম লিগের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো।''
মোদীর দাবি, ''বন্দে মাতরম রাস্তা তৈরি করেছে, তাই আমরা এখানে এসেছি। বন্দে মাতরম আমাদের প্রেরণা।''
প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর বক্তব্য
প্রিয়াংকা প্রশ্ন করেন, ''আজ এই বিতর্কের প্রয়োজন কী? বন্দে মাতরম তো দেশের সর্বত্র মানুষের মনে আছে। আমাদের জাতীয় গান নিয়ে কীসের বিতর্ক? তাও এনিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে তার প্রথম কারণ, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন আসছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী তার নিজের ভূমিকা পালন করতে চান। দ্বিতীয় কারণ, একটা পুরনো উদ্দেশ্য, যারা স্বাধীনতার লড়াই লড়েছে, তাদের বদনাম করা। দেশের জ্বলন্ত সমস্যার থেকে মানুষের নজর ঘোরানো।''
প্রিয়াংকা গান্ধী বলেন, প্রধানমন্ত্রী মহাপুরুষদের অপমান করেছেন। সংবিধান সভাকে অপমান করেছেন। তিনি যতদিন প্রধানমন্ত্রী আছেন, ততদিন নেহরু জেলে ছিলেন। এরপর ১৭ বছর ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নেহরু দেশের জন্য বেঁচেছেন, দেশের সেবা করতে করতে মৃত্যু হয়েছে। এর থেকে ভালো হবে, স্পিকার সময় ঠিক করে দিন। যতক্ষণ তিনি শান্ত না হচ্ছেন, আমরা কথা বলব। নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব, পরিবারবাদ নিয়ে তার যা বলার একবারে বলে দিন। তারপর বিষয়টি ক্লোজ করুন। তারপর বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলুন। নারীদের অবস্থা নিয়ে কথা বলুন।
মহুয়া মৈত্র যা বললেন
তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র বলেন, ''যখন বেকারি ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, দিল্লিতে বায়ুদূষণের পরিমাণ ৮০০ ছাড়িয়েছে, বিরোধী রাজ্যগুলিতে একশ দিনের কাজ, গরিবদের জন্য বাড়ি ও জলের প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না, যখন লাখ লাখ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, বিরোধীরা সংসদে জাতীয় বিষয়গুলো তুলতে পারছে না, তখন সরকার কেন বন্দে মাতরম নিয়ে আলোচনা এতটা জরুরি ও এতটা গুরুচত্বপূর্ণ মনে করলো। দুই সপ্তাহ আগে রাজ্যসভার বুলেটিন বলেছে, বন্দে মাতরম, জয় হিন্দ ও অন্য স্লোগান দেয়া যাবে না। সরকার মনে করছে বন্দে মাতরম স্লোগানও নন সিরিয়াস।''
মহুয়া বলেন, ''বিজেপি আইটি সেলের কেউ হয়ত পরামর্শ দিয়েছে, বন্দে মাতরম কার্ড ঠিকভাবে খেললে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি-র সুবিধা হবে। আমরা খুশি, আমরা দেখাতে পারব, তোমরা বাংলার আত্মা, মানসিকতা থেকে বহুদূরে আছ।, আমাদের মা কখনো তোমাদের হাতে বন্দি হবে না।''
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
অভ্র ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''গান্ধীজি একসময় বন্দে মাতরম জাতীয় সংগীত হওয়া উচিত বলেছিলেন। ১৯৩৭ সালে তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের পর প্রাদেশিক সরকার তৈরির জন্য নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। সে সময় বিভিন্ন প্রাদেশিক বিধানসভা তৈরি হলো, সেখানে বন্দে মাতরম গান গাওয়া হতো। কংগ্রেসের অধিবেশনেও হতো। কিন্তু মুসলিমপ্রধান রাজ্যগুলি এই গান গাইতে অস্বীকার করে। তারা বলে, এর মধ্যে পৌত্তলিকতা আছে। গোলমালের সূচনা হলো। আনন্দমঠে যেহেতু এই গান ব্যবহার হয়েছে, তাই এনিয়ে মুসলিমদের অসন্তোষ ছিল ও আছে।''
অভ্র ঘোষ বলেছেন, ''১৯৩৭ সালে কলকাতায় আনন্দমঠ পোড়ানো হয়। সেসময় নেহরু কংগ্রেসের মনোভাব কী হবে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি দিলেন। সুভাষচন্দ্রও পরামর্শ করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। কবি বললেন, বন্দে মাতরমের ইতিহাস আছে, আন্দোলনে ব্যবহার হচ্ছে। আবার মুসলিমদের বিদ্বেষের সংগত কারণ আছে। কারণ, এর মধ্যে পৌত্তলিকতা আছে। গোঁড়া ব্রাক্ষ্মরাও মানতে পারবেন না। রবীন্দ্রনাথ নেহরুকে লেখা চিঠি প্রকাশের জন্য কাগজে দেন। সুভাষচন্দ্রকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দেন। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ, বন্দে মাতরমের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, তার প্রথম স্তবক ব্যবহারযোগ্য, এখানে পৌত্তলিকতা নেই। এখানে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বক্তব্য অর্ধসত্য। অনেকে যেমন এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছিলেন, অনেকে করেননি। গান্ধীজি এখানে রবীন্দ্রনাথের মত মেনে নিয়েছিলেন।''
তিনি মনে করেন, ''আবার হয়তো বন্দে মাতরমকে জাতীয় সংগীত করার চেষ্টা হতে পারে।''
শুভাশিস মৈত্র মনে করেন, ''বিজেপি একটা রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে, একটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাইছে। কগ্রেস এর বিরুদ্ধে লড়তে পারছে না। তবে এত করেও বিজেপি-র ভোট ৩৭ শতাংশ পার হচ্ছে না। ১৯৮৪ পর্যন্ত কংগ্রেস ৪৫ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছে। ১৯৭৭ সালেও তারা ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।''
শুভাশিস মনে করেন, ''আরএসএসের একশ বছর উপলক্ষে মোদী হয়তো তাড়াহুড়ো করছেন।''
জিএইচ/এসজি (সংসদ টিভি)