পাকিস্তানের বিধ্বংসী বন্যাকে ভারত-বিদ্বেষের হাতিয়ার করে তুলেছে দেশটির জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি৷ প্রচার করছে যে, এই বন্যার জন্য দায়ী ভারত৷ কারণ বন্যার জলস্রোতকে পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দিয়েছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যাকে ভারত বিদ্বেষের হাতিয়ার করে তুলেছেন দক্ষিণ এশিয়ার বিপজ্জনক সন্ত্রাসী বলে যাঁকে চিহ্নিত করা হয়, হিজবুল মজাহিদুন জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধান সেই সৈঈদ হাফিজ৷ তাঁকে ২০০৮ সালে মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার মূলচক্রী বলেও ধরা হয়৷ ঐ হামলায় মারা যায় ১৬৬ জন৷ সম্প্রতি পাকিস্তানের মুলতান শহরের বাইরে বন্যা-দুর্গতদের ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে তুলতে তিনি বলেন, এই বন্যার জন্য দায়ী ভারত৷
পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে কৃষি থেকে পানীয় জলের জন্য নির্ভর করতে হয় হিমালয় থেকে উৎসারিত নদীগুলির উপর৷ তাই জল পাকিস্তানের মানুষের কাছে এক আবেগ জড়িত ইস্যু৷ অনেক পাকিস্তানি মনে করেন, ভারত উজানে নির্মিত বাঁধগুলির জল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷ স্থির করে কতটা জল পাকিস্তানের গম ও তুলো চাষের জন্য ছাড়া হবে৷ পাকিস্তানের কেউ কেউ এটাকে ‘ওয়াটার বোমা' অ্যাখ্যা দিয়ে বলে থাকে বৈরি প্রতিবেশী পাকিস্তানকে দুর্বল করে দিতেই নাকি ভারত এটা করছে৷ হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গি সংগঠনের প্রধান সৈয়দ সালাউদ্দিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, পাকিস্তানকে মরুভূমি বানাতে চায় ভারত৷ বন্যার সময় অতিরিক্ত জল পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত করে আর শুখা মরশুমে জল আটকে রাখে৷ এটা চলতে থাকলে এক নতুন জেহাদ শুরু হবে৷
এই অভিযোগের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই৷ এই ধরণের অভিযোগকে আদৌ আমল দিতে রাজি নয় নতুন দিল্লি৷ ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির ‘জল সন্ত্রাসের' অভিযোগ নস্যাৎ করে দেয় এই যুক্তিতে যে, এই অভিযোগ পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি৷ ‘জল সন্ত্রাস'-এর মতো শব্দবন্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির চয়ন করা পাকিস্তান সরকারের নয়৷ এ মাসের বন্যা বিপর্য়য় উভয় কাশ্মীরকেই করে দিয়েছে লণ্ডভণ্ড৷ এর আসল কারণ মুষলধারে অবিরাম অতি বর্ষণ৷ তবে সব পাকিস্তানি ভারতকে দায়ী না করে পাকিস্তান সরকারকেই দায়ী করেছেন৷ বলেছেন পাকিস্তান সরকার সময়মত বাঁধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করে বন্যা ও খরা মরশুমে বর্ষার জল নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে৷
এটা কি জলবায়ু পরিবর্তন?
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা – এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য কি জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী? নাকি এটা কাকতালীয়? ‘ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ একটি নতুন প্রতিবেদনে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে৷
ছবি: Fotolia/Daniel Loretto
আবহাওয়া এবং জলবায়ু
কখন আপনি এটাকে জলবায়ু পরিবর্তন বলবেন? যখন কয়েকদিন ধরে মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি হবে? নাকি বন্যার পানিতে তলিয়ে যাবে জমির ফসল? নাকি একটা পর একটা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে কোনো কারণ ছাড়াই? এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে আসলেই জলবায়ু পরিবর্তনের কোন যোগসূত্র আছে কিনা – তা বের করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন গবেষকরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকি বাড়ছে
এখনো বিজ্ঞানীদের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার ব্যাপক রকমফের হচ্ছে৷ একটি গবেষণায় তাঁরা ২০১২ সালের ১২টি দুর্যোগ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, এর মধ্যে অর্ধেক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ঘটেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দাবদাহ এবং খরার জন্য দায়ী
যুক্তরাষ্ট্রে দাবদাহ এবং খরার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করা হয়েছে৷ ২০১২ সালের জুলাই মাসে সেখানে ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে৷ এছাড়া কম বৃষ্টিপাতের কারণে সেখানে গম এবং শস্যের ফলনও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
সুমেরুর বরফ গলছে
আর একটি কারণ সুমেরুর বরফ৷ ২০১২ সালে আগের বছরগুলোর তুলনায় অধিক মাত্রায় বরফ গলেছে সেখানে৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা হঠাৎ করে হয়নি বরং গ্রীষ্মকালীন প্রচণ্ড গরম তাপমাত্রা এর জন্য দায়ী৷ তাঁদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী৷
ছবি: DW/I.Quaile
ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি
ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় ছিল৷ এর ব্যাপ্তি ছিল ৩ হাজার কিলোমিটার৷ স্যান্ডি এত শক্তিশালী হওয়ার কারণ ২০১২ সালে আটলান্টিক বা অতলান্ত মহাসাগর স্বাভাবিকের চেয়ে উত্তপ্ত ছিল৷ বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই এর জন্য দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
বৃষ্টি এবং বন্যা
তবে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে গবেষকরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি৷ ইউরোপ, চীন, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রবল বৃষ্টিপাতকে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সোমালিয়া এবং কেনিয়ার খরা
এমনকি সোমালিয়া ও কেনিয়ার ভয়াবহ খরার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন নয় বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ বলছেন, এটা আবহাওয়ার বৈচিত্রের কারণে হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নয়৷ তবে এ বিষয়ে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত নন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঘটনা এবং সংস্কার
জলবায়ু আসলেই বেশ জটিল ব্যাপার৷ বাস্তবে বিশ্বের প্রকৃতিতে কি কারণে কি ঘটছে, তা অনেক উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত৷ তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে৷ আর একটি বিষয় হলো মানুষের আচরণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী৷ এ কারণেই সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে, সেই সাথে দ্বীপগুলোর জন্য বাড়ছে ঝুঁকিও৷
ছবি: picture alliance/chromorange
সামুদ্রিক প্রাণীরা ঝুঁকির মুখে
কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সাগরে অম্লতার পরিমাণ বেড়ে গেছে৷ ফলে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক – এগুলো ঝুঁকির মুখে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
অতিরঞ্জন বাস্তব বর্জিত
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই৷ এর কারণ হয়ত ইস্যুটি নিয়ে অত্যধিক মাত্রায় আলোচনা৷ কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, এর ফলে বিজ্ঞানের সত্যতা হুমকির মুখে পড়বে, হুমকির মুখে পড়বে মানবজাতিও৷
ছবি: Reuters
10 ছবি1 | 10
জল বণ্টন সমস্যা এখন এক বিশ্বজনীন ইস্যু৷ একদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এই সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে৷ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বন্যা, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ সম্প্রতি পাকিস্তানের হিমবাহ গলতে শুরু করেছে৷ নির্বিচারে চলেছে পাকিস্তানে অরণ্যনিধন, বৃষ্টিপাত অনিয়মিত৷ ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে, বলেছেন উড্রু উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের কর্তাব্যক্তি মিশায়েল কুগেলমান৷
জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বর্তমানে হাডসন ইনস্টিটিউটের ডায়রেক্টর হুসেন হাক্কানি মনে করেন, অতিরিক্ত জল ছেড়ে ভারত পাকিস্তানে বন্যা ঘটিয়েছে জঙ্গিদের এই অভিযোগ অদ্ভুত৷ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতা ও উত্তেজনা জিইয়ে রাখার একটা ফন্দিমাত্র৷
এই অঞ্চলে প্রধান নদী তিনটি৷ সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রম্মপুত্র৷ সিন্ধুনদের জল বণ্টন নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ এখনো মেটেনি৷ যদিও ১৯৬০ সালে দু'দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সিন্ধুনদের জল বণ্টন চুক্তি৷