বন্যা ও নদী ভাঙনের কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা৷ পরিসংখ্যান বলছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় আসছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ৷ এদের বেশিরভাগই উপকূলের বাসিন্দা৷
বন্যা ও নদী ভাঙনের কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা৷ ছবি: Samir Kumar Dey/DW
কেবল রামদাসপুর গ্রাম নয়, ভোলার বেশিরভাগ গ্রামের মানুষের অবস্থাই জুয়েলদের মত৷ জুয়েল সংবাদ সংস্থা এপিকে জানান, ‘‘আমরা এই নদীতীরেই বড় হয়েছি৷ মাছ ধরেছি এই নদীতে৷ অথচ এই নদী আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে৷ এই গ্রামে আমার জন্ম৷ গ্রামের জন্য মন কাঁদে৷ কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না৷''
বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ১৩০টি নদী৷ এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বন্যাপ্রবণ৷বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের আবহাওয়া অপ্রত্যাশিত আচরণ করছে৷ এর ফলে প্রায়ই নদী ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাচ্ছে৷ জুন থেকে অক্টোবর বাংলাদেশে বর্ষাকাল৷ এ সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা৷ এর ফলে নদী তীরে থাকা বাজার, স্কুল, মসজিদ, ঘর-বাড়ি পানিতে ভেসে যায়৷ ফলে লাখো মানুষের গৃহহীন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়৷ অনেকেই পরিণত হন ‘জলবায়ু শরণার্থীতে'৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কেবল বন্যা নয়, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন এবং অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি মাটিতে প্রবেশ করার কারণেও বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা৷
বিশ্ব ব্যাংকের গত বছরের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে যে হারে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে চলে আসবে দেশটি৷ অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সংখ্যার দিক দিয়ে এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে চলে যাবে৷
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে নদীভাঙন, বন্যাছবি: Zobaer Amed/DW
ঠিক একবছর পর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছিলেন জুয়েল৷ তখন দেখলেন কেবল তাদের বাড়ি নয়, আরও অনেক বাড়ি মেঘনাগর্ভে বিলীন হয়েছে৷ এই গ্রামে একসময় অনেক ছোট মুদী দোকান, চায়ের দোকান, বাজার বসত৷ চারপাশটা সবুজে ঘেরা ছিল৷ এখানকার মাটি ছিল বেশ উর্বর৷ কিন্তু বছরের পর বছর বন্যা আর নদী ভাঙনের কারণে এখানকার জনবসতি হ্রাস পেয়েছে৷ আগে যেখানে দুই হাজার মানুষের বাস ছিলো, এখন মাত্র ৫০০ মানুষ এখানে থাকে৷
আরজু বেগম বলেন, ‘‘আমি যখন ঘরের কাজ করতাম, আমার বাচ্চাকে ঘরের খুঁটির সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতাম, যাতে পানিতে পড়ে না যায়৷ আমাদের বাড়ি আশপাশে যারা ছিলো তারা এখন রাস্তায় বা ভাড়া বাড়িতে থাকে৷ কেউবা বাঁধের পাশে তাবু বানিয়ে অস্থায়ীভাবে থাকছে৷ আমরা ঢাকায় থাকি এখন৷ নিজেদের বাড়ি বলতে আর কিছুই নেই৷ আমরা এখন উদ্বাস্তু৷''
ঢাকার উত্তরেজলবায়ু শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়েছে সরকার৷ চেষ্টা করছে সেখানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের৷ কিন্তু জুয়েলের ভাগ্যে সেই সুবিধা জোটেনি৷ মিরপুরের একটি বস্তিতে ছোট একটি ঘরে জুয়েল তার পরিবার নিয়ে থাকেন৷ এই শহরে মানিয়ে নিতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘আমাদের নিজের বাড়ি ছিলো, ভাড়া গুণতে হয়নি কখনো৷ মাসে যা আয় হয় তা খুব সীমিত, যা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন৷''
জুয়েল এখন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করেন, মাসে ১২ হাজার টাকা পান৷ আর তার স্ত্রী দুই বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে চার হাজার টাকা পান৷ চার হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে বাকিটা অন্যান্য খরচে ব্যয় হয়৷
জুয়েল চান তার সন্তানরা ভালোভাবে মানুষ হোক৷ ভালো স্কুলে পড়ালেখা করুক৷ কিন্তু সবকিছু তার কাছে অসম্ভব মনে হয়, তার কাছে এখন টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা৷
এপিবি/আরকেসি (এপি)
কোম্পানীগঞ্জে বন্যাদুর্গতদের বেঁচে থাকার লড়াই
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় পৌনে দুই লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি। গত দুই দিনে বৃষ্টি কমলেও তাতে বন্যা পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি৷
ছবি: Rashed Mortaza/DW
প্লাবিত গ্রামের পর গ্রাম
এবারের বন্যায় কোম্পানীগঞ্জের শতাধিক গ্রাম এবং কয়েকশ হেক্টর আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের ঘের। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের সব গ্রামই পানির নীচে তলিয়ে গেছে বলে জানান জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় বাসিন্দারা।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
মসজিদ ডুবেছে, নামাজ হচ্ছে সড়কে
সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের বর্নি এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, সেখানে সড়কে ওয়াক্তের নামাজ এবং মৃতের জানাজার নামাজ পড়া হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাশেম জানান, সড়কের পাশেই তাদের মসজিদ থাকলেও বন্যার পানিতে মসজিদটি ডুবে যাওয়ায় গত তিন দিন যাবত রাস্তাতেই নামাজ পড়তে হচ্ছে।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
এখনো আছে বন্যার পানির চিহ্ন
কোম্পানীগঞ্জের দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের আন্দুরাকান্দি গ্রামে পানির উচ্চতা কমলেও এখনো সেখানে হাঁটু পানি। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সাব্বির মোল্লা তাদের ঘরের দেয়ালে পানির দাগ দেখিয়ে জানায়, পানি নেমেছে দুই দিনে প্রায় দেড় হাত, ঘরে পানি না থাকলেও উঠানে এখনো পানি আছে।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
আরেক আতঙ্ক সাপ
উত্তর ও দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের মধ্যবর্তী একটি খাল পার হওয়ার সময় দেখা যায় একটি সাপ সাঁতরে উঁচু জায়গায় ওঠার চেষ্টা করছে। স্থানীয় ট্রলারের মাঝি হাবিবুর রহমান জানান, বন্যায় অনেক বাসাতেই সাপের দেখা মেলে। অনেক সাপ বিষধর আবার অনেকগুলো নির্বিষ।হাওরে দেখা মেলা সাপটি বিষধর দাবি করে স্থানীয়রা বলেন এটিকে তারা ‘আলোদ সাপ’ নামে চেনেন।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
বাড়িতে ফেরা শুরু
সিলেট অঞ্চলে মে মাসে বন্যা হলেও গত ১৬ জুন আকস্মিক বন্যাতে এ অঞ্চলের মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিকভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে কোনোমতে প্রাণে বাঁচেন তারা। তবে গত দুইদিনে পানি কমতে শুরু করায় অনেকেই এখন বাড়িতে ফিরছেন।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
চাল, ডাল পচছে
দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের আন্দুরাকান্দি গ্রামে ট্রলার থেকে নেমে দেখা গেল, এক বাড়ির উঠানে চৌকিতে আলু, পেঁয়াজ এবং নানা ধরনের শুকনো খাবার রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। পাশে বসে থাকা রমজান আলী জানান, বন্যার সময় অনেক কিছুই পানিতে থাকায় পচে যাওয়ার দশা হয়েছে, তাই বাড়িতে ফিরেই সেগুলো শুকাতে দিয়েছেন।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
নিজ দায়িত্বেই আশ্রয়কেন্দ্রে
কোম্পানীগঞ্জের দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বার আবদুর রহমান বলেন, ‘‘বন্যার শুরুতে আমাদের তেমন কিছু করার ছিল না। মানুষ নিজ দায়িত্বেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গিয়েছে। সরকারি ত্রাণ আসছে, আমরা জনপ্রতিনিধিরা এতদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম, তবে সোমবার থেকে আমরা সমন্বয় করে সাধারণ মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করছি।’’
ছবি: Rashed Mortaza/DW
ভারতে আশ্রয় নেয়া গরু...
কোম্পানীগঞ্জ উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের বিজয়পাড়ুয়া হাওড়া গ্রামের নাজির আহমেদ জানান, সপ্তাহখানেক আগে আকস্মিক বন্যা শুরু হলে তিনি তার পোষা তিনটি গরু ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ের নীচে বেঁধে রাখেন। পানি কিছুটা কমায় গরুগুলোকে তিনি বাড়িতে নিয়ে আসছেন৷
ছবি: Rashed Mortaza/DW
ত্রাণ বিতরণ
এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ের চেয়ে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা, বেসরকারি সংগঠন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণই বেশি দেখা গেছে।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
এখনো অনেক বাড়িঘর পানির নীচে
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং ট্রলারের মাঝি হাবিবুর রহমান জানান, অনেক বাড়িঘর থেকে পানি নেমে গেলেও যেগুলো একটি নিচু জমিতে ছিল, সেগুলো এখনো ছাদ সমান পানিতে। এখন বাড়ির ছাদ কিছুটা দেখা গেলেও বন্যার শুরুতে এগুলো চোখে দেখাই যায়নি।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
গবাদিপশু নিয়ে বিপত্তি
সিলেটে আগে কখনো এমন বন্যা দেখেননি জানিয়ে বেতমুরা গ্রামের রণদা বিশ্বাস বলেন, ‘‘হুট করে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় আমরা ভয় পেয়ে যাই। বন্যার অভিজ্ঞতা না থাকায় সবার বাড়িতে নৌকাও নেই। আমরা কোনোমতে ছোট ডিঙ্গি নৌকায় উঠতে পারলেও গরু-ছাগলকে তো তোলা যায় না। খুব বিপদে ছিলাম আমরা সবাই।’’
ছবি: Rashed Mortaza/DW
আশ্রয়কেন্দ্রে হুড়োহুড়ি
উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের রায়পুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। ত্রাণ দেওয়ার ট্রলার কাছে ভিড়তেই ত্রাণ নিতে হুড়োহুড়ি লেগে যায়। এ অবস্থা সব আশ্রয়কেন্দ্রেই দেখা যায় বলে জানান ত্রাণ বিতরণে অংশ নেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বেচ্ছাসেবী।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
ঘর উঁচু করেও লাভ হয়নি
উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের বিজয়পাড়ুয়া হাওড়া গ্রামের বাসিন্দা আসমা বেগম বলেন, ‘‘আমাদের বসতবাড়ি অন্য অনেকের চেয়ে উঁচু করেই বানিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের বাড়িতেও ছাদ সমান পানি ছিল। এদিকে এভাবে বন্যা হবে আমাদের কারো ধারণাতেই ছিল না।’’
ছবি: Rashed Mortaza/DW
পানি নামছে
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক এলাকার নিচু অংশ থেকে পানি পশ্চিম দিকে নেমে যাচ্ছে। তবে বৃষ্টি না হলে বন্যার পানি পুরোপুরি নামতে আরো হয়ত ১৫-২০ দিন লাগতে পারে বলে বলছেন স্থানীয়রা। তারা জানান, নদী এবং জলাশয়গুলো ভরে যাওয়ায় বন্যার পানি আটকে আছে, নামতে পারছে না দ্রুত।
ছবি: Rashed Mortaza/DW
সেনাবাহিনীর তৎপরতা
বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে সিলেট এবং সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় সেনাবাহিনীর ৭০০ জন সদস্য গত ১৭ জুন থেকে ব্যস্ত রয়েছেন। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সেনাবাহিনীর একটি স্পিডবোটকে ত্রাণ কার্যক্রম শেষে ক্যাম্পে ফিরে যেতে দেখা যায়।