এই পর্যায়ের বন্যার প্রথম দিন যে মূলধারার মিডিয়া খবরটাকে খুব গুরুত্ব দেয়নি তার কারণ বাৎসরিক অভ্যাস৷ আমরা জানি যে, প্রতি বছর একবার বন্যা হবে, কোনো বছর কম, কোনো বছর বেশি, এই তো নিয়ম৷
বিজ্ঞাপন
তা এবার এক মাস আগে যখন বন্যা হয়ে গেছে, তখন যতই বৃষ্টি বাদলা হোক, আবহাওয়া অফিস যতই ভয় ধরানো পূর্বাভাস শোনাক, আমরা ধরেছিলাম বন্যা তো বছরে একবার হওয়ার নিয়ম৷ এ বছরের হিসাব চুকিয়েছে৷ আবার এ নিয়ে কথা কেন?
এবার আসলে অন্যথা হলো৷ এমনই যে দেশের একটা বিভাগীয় শহর ডুবে আছে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে, একদিন তো প্রায় বিশ্ব ভূগোলের বাইরেই চলে গিযেছিল৷ ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক নেই, বিদ্যুৎ নেই, পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগহীন হয়ে এই যুগে থাকা আর না থাকা তো এক কথাই৷ এই যোগাযোগের যুগে এ-ও সম্ভব৷ বন্যার শক্তি আছে জানতাম৷ তবে এতটা যে বহুকাল দেখা হয়নি৷ যদিও অবিশ্বাস্য রকম ক্ষতিতে পড়ে সিলেট হাঁসফাঁস করছে, কিন্তু সব মন্দেরই এক-আধটা সুবিধার দিক থাকে৷ সিলেটের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি জানিয়েও বলছি, সিলেট শহর এভাবে আক্রান্ত হয়েছে বলেই বন্যা নিয়ে এত কথা হচ্ছে৷ এত আলোচনা৷ শুদ্ধিকরণের শত চিন্তা৷ নইলে প্রত্যন্ত এলাকা, সিলেটের নীচু এলাকা প্রতি বছর বর্ষার সময় তো এভাবেই ডুবে যায়৷ আমরা খবরটা শুনি হয়ত, তারপর এক-আধটু উহ-আহ৷ আমাদের নির্ধারিত সভ্যতার নীচের লাইনের লোকদের জন্য আমাদের অতটুকুই বরাদ্দ সাধারণত৷ সেই লাইনটা টপকে বন্যার পানি উপরে চলে এলো৷ ডোবাডুবির বেলায় বাছবিচার হলো না৷ নীচুদের সঙ্গে উঁচুদের ডোবার এই সাম্যবাদিতায় এখন সবাই নড়ে চড়ে বসেছি৷ বন্যা যে কিছু মানুষের বাৎসরিক দুঃখের রুটিন নয়, বরং সামগ্রিক দুশ্চিন্তার বিষয়- সেই বোধটা জাতীয়ভাবেই তৈরি হয়েছে৷
আবার কারণও কি দুঃখ সীমানার উপরে থাকা মানুষের যথেচ্ছাচার নয়! উন্নয়ন শব্দটা এমন বুলেটশক্তির হয়েছে যে, এটা দিয়ে অনেক অযুক্তির পিঠেও যুক্তির লেবাস পরিয়ে দেয়া যায়৷ উন্নয়নের জোয়ার বইছে৷ গাছ-বন উজাড় হচ্ছে৷ অসহায় প্রকৃতির অদেখা কান্নাকে অগ্রাহ্য করে গড়ে উঠছে নাগরিকতা৷ বিদ্ধ হয়ে সে অপেক্ষা করে৷ সময়মতো এভাবেই প্রতিশোধ নেয়৷ প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কহীনতার ছবিও এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়৷
সমস্যা হলো, এগুলোকে আবার সরলীকরণ করে ফেলা হয়৷ রাজনীতির অঙ্কও চলতে থাকে৷ নিজেদের দ্বিচারিতাও দায়ী৷ এক বন্ধুকে কয়েক মাস আগে দেখলাম, ইটনার রাস্তায় গিয়ে ফেসবুক ভাসিয়ে দিয়ে লিখেছে, ‘‘দেখে মনে হয়, বাংলাদেশ নয়, ভেনিসে আছি৷’’ তারপর যে বা যারা এটা করেছে, তাদের প্রশংসা করতে করতে শব্দ প্রায় শেষ করে থেমেছে৷ বন্যার সময় আবার তার জ্বালাময়ী ফেসবুক স্ট্যাটাস৷ সেই রাস্তার ছবি দিয়ে লিখেছে, যে বা যারা প্রকৃতির বুক চিড়েছে এই বন্যা হচ্ছে তাদের প্রতি প্রকৃতির নিষ্ঠুর উপহার৷ এবং সত্যি বললে, এই দ্বিমুখিতায় সে একা নয়৷ যে মানুষ, উন্নতি-উন্নয়নের জন্য পাহাড়-জঙ্গল কাটাকে হাততালি দেয়, সে-ই একটুখানি বিপর্যয় দেখলে বলে, বলেছিলাম না...৷ প্রকৃতি বদলা নেবেই৷ উন্নয়নপ্রেমীই নিমিষে প্রকৃতিপ্রেমী৷ সত্যি বললে, দুটোরই দরকার৷ দরকার দুটোর সমন্বয়৷ সুসম্পর্ক৷
বাংলাদেশের বন্যায় প্রকৃতি ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোর দায়
বন্যা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়৷ প্রতিবছর দেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিমি বা ১৮ শতাংশ ভূখন্ড প্লাবিত হয়৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে নতুন কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
সাত বছরে একবার
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে, যেগুলো ব্যাপকতায় ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার প্রায় সমান৷ ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার এবং ভয়াবহ বন্যা গড়ে ছয়-সাত বছরে একবার সংঘটিত হয়েছে৷ ১৯২৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি সাত বছরে একবার ব্যাপক বন্যা আর ৩৩-৫০ বছরে একবার মহাপ্রলয়ংকরী বন্যা হয়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Asad
ভয়াবহ যত বন্যা
১৯৬৮ সালে সিলেট অঞ্চলের বন্যায় সাত লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ ১৯৮৭ সালে সারা দেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়৷ ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হলেও ১৯৮৮ সালের বন্যা গত শতকের অন্যতম ভয়াবহ, যাতে ৬০ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাপক প্রাণহানি হয়৷ এছাড়া ১৯৯৮ সালে দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দুই মাসের বেশি বন্যা কবলিত থাকে, যা ১৯৮৮ সালের বন্যার সঙ্গে তুলনীয়৷ ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালেও ভয়াবহ বন্যায় পড়ে বাংলাদেশ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রাকৃতিক, নাকি মানবসৃষ্ট?
বন্যার যেসব কারণের কথা বলা হয় তার মধ্যে রয়েছে: ভারি বৃষ্টিপাত, হিমালয়ের তুষার গলা, পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট/দখল বা ভূমিধ্বস, প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি, প্রকৃতির উপর মানবীয় হস্তক্ষেপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
'উন্নয়ন': নতুন সংকট
সাম্প্রতিক সময়ে বন্যার জন্য অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণকেও দায়ী করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র চলতি মাসের সংবাদ সম্মেলন অনুযায়ী, মেঘনা অববাহিকায় ১৬টি আন্তঃদেশীয় নদী আছে৷ ভারত ইচ্ছেমতো সেখানে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিচ্ছে৷ উন্নয়নের নামে সিলেটের হাওর অঞ্চল ভরাট, রাস্তা, বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহে বাধা দেয়াকেও চলতি বন্যার কারণ হিসেবে অভিহিত করেছে তারা৷
ছবি: picture-allaince/NurPhoto/R. Asad
ব্যবস্থাপনায় গলদ
বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্প মূলত বাঁধ, পোল্ডারের মতো অবকাঠামো নির্ভর৷ কাঠামোগত পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা, সেই সঙ্গে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথের মতো অন্যান্য স্থাপনাসমূহ পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে৷ এর প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে দেশে বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্পসমূহে প্রচুর বিনিয়োগ সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে ফলাফল সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
প্রতিরোধ পরিকল্পনা
১৯৮৯ সালে বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার৷ কাঠামোগত প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং বন্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১১টি নির্দেশনামূলক নীতি প্রণয়ন করা হয়৷ এর অংশ হিসেবে বর্তমানে প্রতিবছর এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কৌশল অনুসরণ করছে সরকার৷ মুনাফা ও নিরাপত্তার দিক থেকে উপকারিতা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে এর পরিবেশগত প্রভাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP/picture alliance
যা প্রয়োজন...
কাঠামোগত পদক্ষেপের বাইরে বিকল্প কৌশল হিসেবে অ-কাঠামোগত পদক্ষেপগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ এর মধ্যে আছে নদ-নদীর উপচে পড়া পানি হ্রাসের জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন এবং বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগসহ শস্যের বহুমুখীকরণ৷ আর সবশেষ প্লাবনভূমিগুলোকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Asad
7 ছবি1 | 7
প্রথমে মূল যে বিভ্রান্তি সেটা নিয়ে দুটো কথা বলি৷ হাওরের যে অনিন্দ্যসুন্দর রাস্তাটা সত্যিই নীচু ভূমির মানুষকে সংযুক্ত করেছে মূল ধারার সঙ্গে, সেটাকে আসামির খাতায় সরাসরি দাঁড় করানো অন্যায়৷ মেঠো সমালোচনা ছাপিয়ে একটু গভীরে গেলে দেখা যাচ্ছে, এই রাস্তাটা সরাসরি বাধা নয়৷ পানি আটকে রাখার কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই৷ বরং নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সরাসরি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখাচ্ছেন এই রাস্তায় পানির প্রবাহ আটকাচ্ছে না মোটেও৷ অন্য কোনো গবেষণা না পাওয়া পর্যন্ত এতে বিশ্বাস রাখি৷ কিন্তু এই নির্দিষ্ট রাস্তা বা রাজনৈতিক অঙ্ক থেকে সরকারি সব প্রচেষ্টাকে দোষারোপ না করে বাস্তবতা বিজ্ঞান দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি একটু৷ দেখবো প্রকৃতির খেয়াল আর মানুষের বেখেয়াল মিলে তৈরি হওয়া ফাঁদটা এখন অনেক বিস্তৃত৷
প্রথমত, সিলেট অঞ্চল মানচিত্রগতভাবে আলাদা হয়ে বাংলাদেশে যুক্ত হলেও, এটা একসময় আসামের অংশ ছিল৷ ভূপ্রকৃতিগতভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে একীভতূ প্রায়৷ ভারতের সেই অঞ্চল মারাত্মক রকম বৃষ্টিপ্রবণ৷ সিলেটও কাছাকাছি৷ এখন বর্ষা মৌসুমে ভারতে বৃষ্টিপাত হলে সে-ই পাহাড়ি ঢল নেমে আসে সিলেটের দিকে৷ সঙ্গে যোগ হয় সিলেটের নিজস্ব বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিও৷ এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার ভারতের সেই অংশে অবিশ্বাস্যরকম বৃষ্টি হয়েছে৷ আবার ভারতের এই অঞ্চলে গত কয়েক দশক ধরে নানারকম বাঁধ-সংস্কার ইত্যাদি কারণে বনাঞ্চল কাটা হচ্ছে নির্বিচারে৷ ফলে, সেখান থেকে পানি গড়িয়ে আসে খুব দ্রুত৷ বনাঞ্চল বেশি হলে পানি নামে আস্তে, বন উজাড় হয়ে পানি নামছে দ্রুত৷ আবার বন কমে যাওয়াতে সেখানে পাহাড়ধ্বসও হয় প্রচুর, তাতে পলি জমে গিয়ে নদ-নদীর নাব্য কমে যায়৷ ফলে পানি নেমে আসে দ্রুত, আবার যাওয়ার পথে পলি আর নাব্য কমে যাওয়ার বাধা৷ আবার এই অঞ্চলে, মানে সিলেট অঞ্চলে এলে সেখানেও বন উজাড় করা, জলাশয়-খাল বিল ভরাট করার আয়োজন চলছে বাংলাদেশের নিয়মে৷ ফলে, এখানেও বাধা৷ তাই যে পথ দিয়ে এই পানি এসে মেঘনা অববাহিকা হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার কথা, সেই পথ আটকে আছে বলে সেটা উপচে গিয়ে বইয়ে দেয় এমন বিনাশী বন্যা৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনকি মেঘনায় তৈরি হওয়া কয়েকটি সেতুও দায়ী৷ রেল বা সড়ক সেতুর জন্য নদী শাসন হয়, আবার পিলারের কারণে পলি জমে, চর তৈরি হয়, পানি পথে তৈরি হয় বাধা৷ আর তাই, পুরো বিষয়টা ঠিক একজন-দুজনের দায় নয়৷ এবং একদিন-দুই দিনে সমাধানের বিষয়ও নয়৷ ভয়ঙ্কর কথা হলো, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টি বাড়বে৷ আমাদের প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে আক্রান্ত করে তৈরি হতে চলা নির্মাণ কাজও থামবে না৷ ফলে, আগামী কয়েক বছরের জন্য এটাই বোধহয় হতে চলেছে স্বাভাবিকতা৷ পরিত্রানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা আর পরিকল্পনা দরকার৷ এবং শুধু বাংলাদেশ চাইলেই হবে না৷ ভারতের বৃষ্টির পানি বাংলাদেশে আসাকে তো ভিসা-ইমিগ্রেশন দিয়ে আটকানো যাবে না, যেমন অভিন্ন নদীগুলোর বেশিরভাগেরই উৎপত্তিস্থল ভারত বলে তাদের সঙ্গে সমন্বয়ও জরুরি৷ পানি আর পলি কূটনীতির কথা এই বন্যায় সামনে আসা নতুন সমীকরণ৷ সেটা মেলাতে হবে৷
অন্য দেশ চলবে তাদের নিয়মে৷ সেখানে নিজেদের মতো কিছু করা যে কঠিন তা তো আমরা খুব ভালো জানি৷ সেই চাপ চালু রেখে নিজেদের দিকটায় মন দিতে হবে৷ আগামী বছরও মেঘালয়-আসামে বৃষ্টি হবে, বাংলাদেশে গড়াবে, কিন্তু এরপর যেন দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা করা যায় তার জন্য প্রকৃতি আর উন্নতির একটা ভারসাম্য আনতে হবে৷ সেতু করতে হবে৷ না হলে জীবন এগোবে না৷ রাস্তা বানাতে হবে৷ নইলে পিছিয়ে পড়ারা পিছিয়েই থাকবে৷ কিন্তু দুটোর কোনোটাতেই পাগুলে হওয়া যাবে না৷ উন্নয়নের স্লোগানে মাতোয়ারা হয়ে মূলটা ভুললে চলবে না, আবার ‘প্রকতি বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে সব রুদ্ধ করে ঘরে দরজা আটকে বসেও থাকা যাবে না৷ প্রকৃতির কাছ থেকে নিতে হবে৷ কিন্তু তাকে ভালোও বাসতে হবে৷
অনেক বছর আগে এক রাতে বৃষ্টি হচ্ছে৷ এক সহকর্মী দেখে প্রায় আত্মহারা হয়ে বললেন, ‘‘উফ আজ যে ঘুমটা হবে না!’’ পাশে দাঁড়ানো ছিলেন অফিসেরই নীচু পর্যায়ের একজন কর্মী৷ তিনি কথাটা শুনে বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘‘আমিও বৃষ্টির কথাই ভাবছি৷ ঘরের টিন ছিদ্র হয়ে গেছে, পানি পড়ে খুব৷ কীভাবে যে ঘুমাবো!’’
প্রথমজন স্তব্ধ হয়ে গেলেন৷ স্তব্ধ সবাই৷
মন খারাপ হয়ে গেল৷ গল্পটা বললাম, মন খারাপ করাতে নয়৷ বোঝাতে৷ প্রত্যেক গল্পেরই দুটো দিক আছে৷ আমরা শুধু একদিক দেখি৷ নিজেদের জায়গা থেকে৷ দেখতে হবে দুই দিক বা সবদিক থেকে৷ তাহলেই শুধু সমাধান৷
প্রকৃতিকে জয় করে এগোলে আবার পেছাতে হয়৷ প্রকৃতিকে সঙ্গে করে চললে সেটাই আসলে প্রকৃত জয়৷
এবারের বন্যা শিশুপাঠ্যের মতো সহজ করে এই শিক্ষা দিলো৷ নিলে রক্ষা৷ নইলে পরের ধাক্কার অপেক্ষা৷
বন্যায় বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। অতিবৃষ্টি এবং ভারতের চেরাপুঞ্জির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হওয়ার কারণে সুনামগঞ্জসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোর বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ত্রাণের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষা
সুনামগঞ্জ সদরের সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের নৌবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পের সামনে সারাদিনই ভিড় করতে দেখা যায় বন্যাদুর্গত মানুষদের। নবীনগর থেকে ৪ দিন আগে আসা শেফালী হালদার জানান, বন্যার কারণে তাঁরা ঘর-বাড়ি ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে লোকমুখে এমন কথা শুনে আসলেও এখানকার কর্মকর্তারা বলছেন এখানে কোনো ত্রাণ দেওয়া হয় না।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘অবলা প্রাণী কিছু কইতে পারছে না’
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের তাহের আলী বলেন, ‘‘আমরার সবার বাড়িত অই গবাদিপশু আছে। বন্যাত আমরা তেমন খাইতে পারছি না, পানি খায়া থাকোন লাগসে। কিন্তু গবাদি পশু তো অবলা প্রাণী, কিছু কইতে পারছে না, অগো খাইতেও দিতে পারছি না, তাইনেরে নিয়া বিরাট বিপদও আছলাম।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
শুধু বাসার ছাদ দেখা গেছে
সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার বালিঝুড়ি গ্রামের রেণোদা বিশ্বাস জানান, বন্যা শুরু হলে রাতেই ঘরে পানি ঢুকে যায়। ভয়ে পরিবার নিয়ে কোনোমতে বাড়ি ছেড়ে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে যান তাঁরা। একদিন পর নৌকায় করে বাড়ি দেখতে এসে দেখতে পান, শুধু বাড়ির ছাদ দেখা যাচ্ছে, বাকি অংশ পানির নীচে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের সেলিম মিয়া জানান, বন্যার শুরুর পরপরই বিদ্যুৎ ও মোবাইলের নেটওয়ার্ক চলে যাওয়ায় যেসকল আত্মীয়স্বজন শহরে কিংবা পাশের গ্রামেই থাকেন, তাদের কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এই দুর্যোগে কে কেমন আছে এ নিয়ে সবাই খুবই চিন্তিত ছিল।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
বসতবাড়ি ভেঙে গেছে
সুনামগঞ্জের শনির হাওরের সাব্বির আহমেদ ও মো. আকাশ জানান, বন্যার স্রোতে তাদের টিনের বাসা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। সেটি নতুনভাবে বানানো ছাড়া উপায় নেই আর। তাদের গ্রামের অনেকের বাসাবাড়ির চিহ্নটুকুও নেই।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ফসলের জমিতে ১০ ফুট পানি
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের সগির আলী জানান, তাঁর বসতবাড়ির সামনে যতদূর দেখা যায়, ফসলি জমি ছিল। অন্যান্য বছর জাদুকাটা নদী ও পার্শ্ববর্তী হাওরের পানি বাড়লেও এবছরের বন্যায় ফসলি জমি তলিয়ে গেছে কমপক্ষে ১০ ফুট পানির নীচে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আবার ফেরত যাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রে
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বারোংকা গ্রামের হযরত আলী জানান, একটি ট্রলার ভাড়া করে আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে বাড়িতে ফেরত গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন সেখানে এখনো কোমর সমান পানি। অনেকের বাড়ির পানি নামলেও তার বাসারটা এখনো না নামায় আবার আশ্রয়কেন্দ্রে ফেরত যাচ্ছেন তারা।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সড়কে আশ্রয়
সিলেট-সুনামগঞ্জ সংযোগ সড়কের মদনপুর নামক স্থানে দেখা যায়, সেখানে কিছুদূর পরপর রাস্তায় পলিথিন দিয়ে অস্থায়ী তাঁবু বানিয়ে অবস্থান করছেন শতশত পরিবার। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এরা সবাই বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে এসেছেন এবং এখানে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ত্রাণ পর্যাপ্ত না
ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়া একটি বেসরকারি দাতব্য সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘‘আমরা সুনামগঞ্জে বন্যার শুরু থেকেই ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার ত্রাণ দিচ্ছি, কিন্তু তবু দিয়ে শেষ করতে পারছি না। আসলে এত মানুষের চাহিদা মেটানো খুবই কঠিন, কোনো উদ্যোগই যথেষ্ট না।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘সাত-আট দিনে শুধু আজকে ত্রাণ পেলাম’
বন্যায় সুনামগঞ্জ জেলার অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা তাহিরপুরের নয়ানগর গ্রামের পরীবানু জানান, সকালে একটা দল এসে কিছু শুকনো খাবার দিয়ে গেছে, আর এখন রান্না করা খাবার পেলেন তারা। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় তাদের এদিকে এর আগে ত্রাণ দিতে কেউ আসেননি।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
দূরদুরান্ত থেকে নৌকায় ত্রাণ নিতে আসছেন
সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ত্রাণবাহী ট্রলার অথবা স্পিডবোট নদীর মাঝামাঝি থাকাতেই লোকমুখে শুনে অনেকেই দূর থেকে নৌকা নিয়ে ত্রাণবাহী নৌকার কাছে চলে আসছেন। তবে বৈষম্য হতে পারে এই ভেবে কাউকেই এভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়নি।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, শিবগঞ্জ, শনির হাওর এলাকাগুলোর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঘুরে দেখা যায় সেখানকার বন্যা উপদ্রুত মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ছোট একটি ঘরে ১০-১৫ জন বসবাস করছে। খাবারের সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ না থাকায় খাবার পানিরও সংকট তৈরি হয় সেখানে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘চকির উপ্রে চকি দিয়া থাকসি’
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার নয়ানগর গ্রামের রুবিয়া আক্তার বলেন, ‘‘আমরার পরিবারে ৬ জন মানুষ। আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে যাইতাম পারছি না। ঘরই চকির উপরে চকি দিয়া কোনরকম বাইচা আছিলাম। বন্যার স্রোতে বাড়ির সামনে পিছে ভাইঙ্গা লইয়া গেসে।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গার সংকট
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের জ্যোৎস্না বেগম জানান, বন্যার পানি বিপদজনকভাবে বাড়তে থাকায় স্বামী-সন্তানসহ কাছের এক আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আগে থেকে আশ্রয়কেন্দ্রটি মানুষের জায়গা হচ্ছিল না। তাই তারা আবার নিজ বসতবাড়িতে ফেরত এসেছেন।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ভ্রাম্যমাণ রান্নাঘর
বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা দূরবর্তী হওয়ায় নদীপথে একদিনে ফেরত আসা যায় না। তাই যেসব বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তারা ট্রলারেই রান্নার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। তারা টাটকা রান্না করা খাবার বন্যা উপদ্রুত এলাকার পরিবারগুলোর মাঝে বন্টন করে দিচ্ছেন।