1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বন্যাকে মানুষই পারে রুখতে

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৪ আগস্ট ২০১৭

পশ্চিমবঙ্গের কিছু স্থান বরাবরই বন্যাপ্রবণ৷ প্রতিবছর বর্ষা এলেই বন্যার ভ্রূকুটি৷ এবারও যথারীতি প্লাবিত হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, হুগলির আরামবাগ, খানাকুল ও হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, তবু আতঙ্ক যায়নি৷

Indien, Flut in Westbengalen
ছবি: DW/Payel Samanta

কেন বন্যা হয় প্রতি বছর? কীভাবে তার দীর্ঘমেয়াদি মোকাবিলা সম্ভব? জল ছাড়া নিয়ে চাপানউতোরে কতটা সারবত্তা রয়েছে? মুখ্যমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী বন্যা কি ম্যানমেড হয়? এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে পরিবেশ ভবনে রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান ও নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের মুখোমুখি ডয়চে ভেলে৷

ডয়চে ভেলে: পশ্চিমবঙ্গের বন্যার কারণ কি শুধুই অতিবৃষ্টি? না এর অন্য কোনো কারণ আছে?

কল্যাণ রুদ্র: বন্যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার৷ বন্যা না হলে পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ গড়ে উঠত না৷ বন্যার হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি সম্ভব নয়, কাঙ্খিতও নয়৷ প্রকৃতিতে প্লাবনের একটা ইতিবাচক দিকও আছে৷ আজকে মানুষ দুর্দশার মধ্যে রয়েছে এ কথা ঠিকই, কিন্তু এই বন্যার জল যে পলি বয়ে এনেছে, তাতে জমি উর্বর হবে, বন্ধ্যা কৃষিজমি প্রাণ ফিরে পাবে৷ একইসঙ্গে ভূগর্ভে জলস্তর বৃদ্ধি পাবে৷ কিন্তু বন্যার জন্য মানুষের যে দুর্গতি তার থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে৷ এর একটা উপায় হচ্ছে বন্যার বাড়তি জল বের করা৷ নদীর জল জনবসতি এলাকায় ঢুকে পড়ার পর বেরোনোর পথ পায় না৷ মূলত তিনটি কারণে এই ঘটনা ঘটে৷ প্রথম কারণ অবশ্যই অতিবৃষ্টি৷ জুলাই মাসের ২১, ২২ তারিখ থেকে ৪-৫ দিন যা বৃষ্টি হয়েছে, তা গোটা মাস ধরে হওয়ার কথা৷ রাঢ় বাংলা ও ঝাড়খণ্ড জুড়ে বৃষ্টি হওয়ায় এই তাণ্ডব চলছে৷ দ্বিতীয় কারণ দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন বা ডিভিসি৷ এরা যদি জলাধার থেকে জল ছাড়ে, তাহলে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়৷ তৃতীয় কারণ অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির জল ছাড়ার সঙ্গে যদি হুগলি নদীতে ভরা কোটাল থাকে, তাহলে প্লাবন ভয়াবহ আকার নেয়৷ এই তিনটে কারণ এবার একসঙ্গে ঘটায় বন্যার ব্যাপকতা এত বেশি৷ ১৯৭৮, ২০০০ সালের পর এবার আবার সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷

‘জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বন্যার যোগ অবশ্যই আছে’

This browser does not support the audio element.

ঘাটালে প্রতি বছরের বন্যা রোখা যায় কি? কীভাবে?

ঘাটালে বন্যার কারণ চারটি নদী৷ দামোদর নদের জল মুণ্ডেশ্বরী দিয়ে আসে, এর সঙ্গে যুক্ত হয় দ্বারকেশ্বর, শিলাইয়ের জল৷ কংসাবতীর একটি শাখার জলও ঘাটালে পৌঁছায়৷ বন্যা রুখতে নদীর বাড়তি জলটা বের করার ব্যবস্থা করতে হবে৷ দামোদরের পূর্ব পাড়, অর্থাৎ বাঁদিক বরাবর কতগুলি শাখা নদী ছিল৷ বাঁকা, কানা দামোদর, মজা দামোদর, বেহুলা, গাঙ্গুড়৷ ব্রিটিশরা ১৯ শতকের মধ্যভাগে যখন দামোদরের এই পাড় বরাবর বাঁধ দেয়, তখন শাখা নদীগুলি দামোদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ আমার প্রস্তাব, এই নদীগুলিকে আবার দামোদরের সঙ্গে যুক্ত করা হোক৷ শাখার সঙ্গে মূল নদীর সঙ্গম স্থলে একটা হেড রেগুলেটর লাগানো থাকবে, যার মাধ্যমে বাড়তি জলের একাংশ আমরা শাখা নদীতে পাঠিয়ে দিতে পারব৷ এতে সবটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, কিন্তু প্লাবনের মাত্রা কমিয়ে ফেলা যাবে৷ এছাড়া রাস্তা বা রেললাইনের নীচে কালভার্ট তৈরির মতো পদক্ষেপ কাজে আসবে৷  

বিশ্ব উষ্ণায়ন, নদী দূষণ ও নাব্যতা হ্রাস — পশ্চিমবঙ্গের বন্যার জন্য কি এগুলোকে দায়ী করা যায়?

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বন্যার যোগ অবশ্যই আছে৷ আমি ১৯০১ থেকে ২০১০ অবধি এ রাজ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নিয়ে গবেষণা করছিলাম৷ তাতে দেখলাম, কম সময়ে অতিবৃষ্টির পরিমাণ বাড়ছে৷ শুখা মরসুম শেষে জুনে প্রথম বৃষ্টি এলে রুক্ষ মাটি স্পঞ্জের মতো সেই জল শুষে নেয়৷ ফলে ভূগর্ভে জলস্তর বাড়ে৷ কিন্তু অল্প সময়ে ভারী বৃষ্টি হলে মাটির শোষণ ক্ষমতা আর থাকে না৷ সেই জল মাটির উপর দিয়েই গড়িয়ে যায় এবং বন্যার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে৷

ছবি: DW/Payel Samanta

নদীর দূষণের সঙ্গে সরাসরি বন্যার কোনো যোগ নেই৷ এতে জলের গুণগত মানের পরিবর্তন হতে পারে, তবে নাব্যতা হ্রাস বন্যার অন্যতম কারণ তো বটেই৷ ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে নদীর দু'পাড়ে বাঁধ দিয়ে দেওয়ার ফলে হয়ত ছোট ছোট বন্যা রোখা গেছে৷ কিন্তু এর ফলে নদী বন্যার সময় যে পলি প্লাবনভূমিতে ফেলে আসত, সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে৷ ফলে সেই পলি নদীখাতেই জমছে, নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে৷ একইভাবে শাখানদীও মজে যাওয়ার ফলে জলধারণের ক্ষমতা কমছে৷

নদীর উপর তৈরি বাঁধ প্লাবনের জন্য কতটা দায়ী?

মাইথন, পাঞ্চেৎ-সহ অন্যান্য জলাধারে তিন স্তরে জল সঞ্চিত থাকে৷ একেবারে নীচের স্তরে যেখানে পলি জমে থাকে৷ এটা খুব একটা কাজে আসে না৷ তার ওপরের স্তরটিকে বলে ‘লাইভ স্টোরেজ’৷ এখান থেকে সেচের জল দেওয়া হয়৷ তার উপরের স্তরটিকে বলে ‘ফ্লাড কুশন’৷ এই অংশটি খালি রাখার কথা৷ কিন্তু এবার আগে থেকেই বৃষ্টির জেরে এই স্তরটি পূর্ণ হয়েছিল৷ তাই অতিবৃষ্টির পর জল না ছেড়ে ডিভিসির আর কোনো উপায় থাকে না৷ এর ফলে শুধু যে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়, উজানের দিকে ঝাড়খণ্ডের গ্রামগুলি ভেসে যাবে৷ তাই ডিভিসির সীমাবদ্ধতা আমাদের বোঝা উচিত৷

ছবি: DW/Payel Samanta

এবারও রাজ্য সরকার ডিভিসির দিকে আঙুল তুলেছে৷ সত্যিই কি তাদের দায় আছে?

দায় কিছুটা তো আছেই৷ ডিভিসি একটা কাজ করতে পারত, যখন আবহাওয়া দপ্তর ঘোষণা করছে — বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ ঘনীভূত হচ্ছে, অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে৷ তখন ডিভিসি কর্তৃপক্ষ আগেই কিছুটা জল ছেড়ে দিতে পারত, তাহলে বিপর্যয়ের মাত্রা কিছুটা কমানো যেত৷ এক্ষেত্রে ডিভিসিকে একটা ঝুঁকি নিতেই হয়৷ তারা ভাবে, কৃষির জন্য জল ধরে রাখা দরকার৷ বৃষ্টি কম হলে জলাধার পূর্ণ থাকলেও সমস্যা হয় না৷ তখন ডিভিসি কর্তৃপক্ষ বাজি জিতে যান৷ কিন্তু বৃষ্টি বেশি হলেই বিপর্যয়৷ তাই ডিভিসিকে আংশিকভাবে দায়ী বলাই চলে৷

সেক্ষেত্রে এই জল ছাড়ার বিষয়টা কীভাবে নির্ধারিত হবে?

ডিভিসি কর্তৃপক্ষকে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে, যাতে জল ছাড়ার সময়টা নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ ওঁরা বলেন, ২০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে৷ এতে কিছু বোঝা যায় না৷ এক কিউসেক মানে প্রতি সেকেন্ডে এক কিউবিক ফুট৷ তাই কত সময় ধরে জল ছাড়া হচ্ছে, সেটা না বললে পরিমাণ বোঝা সম্ভব নয়৷ এছাড়া জল ছাড়ার সময়টাও সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে ডিভিসিকে৷ দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে খানাকুলে জল আসতে সময় লাগে ২৪ ঘণ্টা৷ মাইথন, পাঞ্চেৎ থেকে ৩৬ ঘণ্টা৷ অনেক সময় দেখা যায় গভীর রাতেও মানুষের ঘরে জল ঢুকে যাচ্ছে৷ ডিভিসিকে দেখতে হবে জল যেন দিনেরবেলায় পৌঁছায়৷

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার ‘ম্যানমেড’ বন্যার অভিযোগ তোলেন৷ এই কথার বাস্তব ভিত্তি কতটা?

ঐতিহাসিকভাবে বন্যা কিছুটা হলেও ম্যানমেড৷ ব্রিটিশরা তাঁদের রেল ও সড়কপথ রক্ষা করতে বাঁধ দিয়েছিল৷ সেই বাঁধের ফলশ্রুতিতেই নদী ও শাখানদী মজে গেছে৷ তাই সেই অর্থে এই বন্যার কারণ তো মানুষই৷

বাংলার মানুষ বন্যার লাল জলে ভেসে আসা পলির গুরুত্ব বুঝতো৷ তাই দু'দিনের বন্যায় তাদের আপত্তি ছিল না৷ দামোদরের ওই বন্যাই বর্ধমানকে ভারতের সবচেয়ে উর্বর কৃষিক্ষেত্রে পরিণত করেছিল৷ অধিকাংশ ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার বাংলার কৃষির সঙ্গে নদীর এই আন্তঃসম্পর্কের কথা বুঝতে পারেননি৷ স্বাধীনতার পরে আমরা সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি৷

সরকারি স্তরে ভবিষ্যতে কী উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে?

বন্যার বিপর্যয় সামলে ওঠার পর সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমি বৈঠকে বসবো৷ আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে আগে থেকে কীভাবে বন্যা রোধ করা যায়৷ অর্থাৎ প্রাক-প্রস্তুতি নিতে হবে৷ বন্যার পর্ব পার হয়ে গেলে সেটা ভুলে গেলে চলবে না৷ পরের বছরের জন্য এখনই তৈরি থাকতে হবে৷

বন্ধু, সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ