রিও-র মতো মহানগরীর উপকণ্ঠে বন্যা রোখার একমাত্র পন্থা কী? ঠিক আমাদের সুন্দরবনে যা, সেই ম্যানগ্রোভ অরণ্য৷ রিও-র ডুকে ডি কাসিয়াস এলাকায় গেলেই সেটা বোঝা যায়৷ ডেলি প্যাসেঞ্জাররা ট্রেনে করে রিও যাচ্ছেন আর জেলেরা ধরছেন কাঁকড়া৷
বিজ্ঞাপন
প্রায় কোনো বাড়ি আর খাড়া নেই! বন্যার পরদিন ধ্বংসের চেহারাটা ফুটে উঠেছিল৷ তিন বছর আগে রিও-র উপকণ্ঠে ডুকে ডি কাসিয়াস এলাকার ২৭০টি বাড়ি বন্যার জলে ভেসে যায়৷ মারা গিয়েছিলেন দু'জন; আহত হয়েছিলেন ৬০ জন – এক রাতের দুর্যোগে৷
রেজিনিয়া গনসালভেস-এর চোখের সামনে আজও সে ছবি ভেসে ওঠে৷ তিনি ও তাঁর পরিবারের মানুষজন কোনোমতে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিলেন – কিন্তু বাকি সবই হারাতে হয়েছিল৷ রেজিনিয়ার কথায়, ‘‘আমাদের সেই পুরনো বাড়ি৷ পানি ঢুকেছিল এই জানলা দিয়ে৷ দুম করে ধাক্কা লাগার মতো একটা আওয়াজ শুনে আমরা বাইরে বেরিয়ে দেখি, বন্যার জল সব কিছু ধুয়েমুছে নিয়ে গেছে৷ দৌড় দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার সময় থাকেনি৷''
রিও-কে বন্যা থেকে বাঁচাবে ম্যানগ্রোভ অরণ্য
03:33
বাড়িগুলো নদীর বড় কাছে তৈরি করা হয়েছিল – যদিও এখানে প্রায়ই বড়গোছের জলঝড় হয়৷ স্থপতি মার্সিও ভিয়েইরা-র কাছে এটা ভুল প্ল্যানিং-এর ফলশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়৷
নগর বিকাশ কর্তৃপক্ষের প্রধান মার্সিও আমাদের ডুকে ডি কাসিয়াস শহরের কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন৷ ডুকে ডি কাসিয়াস আসলে রিও ডি জানেরোর একটা শহরতলি – আজ এখানে বহু মানুষের বাস, প্রায় দশ লাখ, তাদের অধিকাংশই কর্মসূত্রে রিও অভিমুখে ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জারি' করেন৷ বিগত কয়েক দশকে ডুকে ডি ক্যাসিয়াসের আকার বেড়েছে যেন চক্রবৃদ্ধি হারে৷
বস্তির মধ্যে হোস্টেল
অলিম্পিকের আগে সেজে উঠছে ব্রাজিলের রিও শহর৷ শহরের ‘ফাভেলা’ বা বস্তির মধ্যে এমন কিছু হোস্টেল রয়েছে, যেখানে বেশ সস্তায় দামি হোটেলের অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
বস্তির মধ্যে হোস্টেল
অলিম্পিকের আগে সেজে উঠছে ব্রাজিলের রিও শহর৷ শহরের ‘ফাভেলা’ বা বস্তির মধ্যে এমন কিছু হোস্টেল রয়েছে, যেখানে বেশ সস্তায় দামি হোটেলের অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
ভিন্ন স্বাদের ভ্রমণ
রিও শহরের বস্তির কথা শুনলে অনেকের মনেই ভয় জাগে৷ মাদক পাচারকারীরা সেখানকার পথেঘাটে খণ্ডযুদ্ধ চালাতেই ব্যস্ত৷ তবে এই চিত্র সম্পূর্ণ বাস্তব নয়৷ রিও শহরের প্রায় ১,০০০ ফাভেলার মধ্যে কয়েকটি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে চাইছে৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
‘পুসাডা ফাভেলিনায় স্বাগতম’
পেরেইরা দা সিলভা নামের ফাভেলায় ‘পুসাডা ফাভেলিনা’ হোস্টেল চালাচ্ছেন সোলাঁজ ডোশ শান্টোশ৷ সমুদ্রের কাছেই টিলার উপর অবস্থিত এই হোস্টেল থেকে ব্রাজিলের বিখ্যাত রেনফরেস্টও বেশি দূর নয়৷ অথচ ঘরের ভাড়া মাত্র ৩০ ডলার৷ পাশেই পাঁচতারা হোটেলে ২৫০ ডলার গুনতে হয়৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
‘প্রত্যাশার তুলনায় ভালো’
ডোশ শান্টোশ হোটেলের ঘরগুলিরও দেখাশোনা করেন৷ তিনি বলেন, ফাভেলায় যে সব কাণ্ডকারখানা হয়, তার ফলে হোস্টেল চালানো বেশ কঠিন৷ পরিস্থিতি শান্ত রাখার কর্মসূচি সত্ত্বেও প্রায় রোজই গোলাগুলি চলে৷ এক ফরাসি অতিথি অবশ্য তাতে বিচলিত নন৷ প্রত্যাশার তুলনায় ভালো অভিজ্ঞতা তাঁর৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
মনোরম দৃশ্য
‘পুসাডা ফাভেলিনা’-র ছাদ থেকে বিনামূল্যে এমন দৃশ্য দেখা যায়৷ টিলার সামনেই শহর ও সমুদ্রের পাশাপাশি ব্রাজিলের সবচেয়ে বিখ্যাত পাহাড় শুগার লোফ মাউন্টেন৷ যানবাহন ও কান ঝালাপালা করা শব্দের বদলে শোনা যায় জঙ্গলের পাখির ডাক৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
‘আসল’ রিও চেনার সুযোগ
একের পর এক ফাভেলায় পর্যটকদের থাকার সুযোগ বাড়ছে৷ যেমন ভিডিগাল নামের বস্তিতে ‘মিরান্টে ডো আভরাও’ নামের হোস্টেলের এই সুইট বুক করলে ব্রাজিলের মানুষের প্রকৃত জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানার সুযোগ পেতে পারেন তাঁরা৷ উল্লেখ্য, রিও শহরের প্রায় এক পঞ্চমাংশ মানুষ এমন বস্তিতেই থাকেন৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
হিংসার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ
ফাভেলাগুলি হিংসা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে যেতে চাইছে৷ বাইরের মানুষ এখানে এসে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করছে৷ হোস্টেল মালিক সোলাঁজ ডোশ শান্টোশ মনে করেন, বাইরের মানুষ এখানে এসে অবাক হচ্ছেন৷ বলছেন, ‘যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, ততটা নয়’৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
শহরের কোলাহলের বদলে শান্তি
সাম্বা নাচ ও সমুদ্রসৈকতের রমরমা পেছনে ফেলে শহর দেখতে চাইলে ফাভেলা হোস্টেল উপযুক্ত জায়গা হতে পারে৷ সোলাঁজ ডোশ শান্টোশ বলেন, এখানে বড় শান্তি৷ বিশেষ করে অলিম্পিকের হই-হট্টগোলের সময় এই অভিজ্ঞতা বেশ আরামদায়ক হতে পারে৷
ছবি: Reuters/P. Olivares
8 ছবি1 | 8
মার্সিও ভিয়েইরা-র কথায়, ‘‘পরিকল্পনা না থাকার ফলে আগে শহরটা বড় ঘিঞ্জি করে তৈরি হয়েছিল৷ কোনো খালি জায়গা রাখার ব্যবস্থা করা হয়নি৷ বাড়ির পর বাড়ি তৈরি করে সব কিছু ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷''
তিন বছর আগের সেই বন্যা বিপর্যয় মানুষকে অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে৷ মার্সিও ভিয়েইরা শহরের উপকণ্ঠে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ঘেরা অংশটির কথা বললেন৷ শহর আর তার বাসিন্দাদের জন্য প্রকৃতির ব্যবহারিক গুরুত্ব এই প্রথম প্রমাণিত হয়েছে, বললেন ভিয়েইরা৷ যে জরিপের উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্ত, তার অর্থ জুগিয়েছে জার্মান আন্তর্জাতিক জলবায়ু সুরক্ষা উদ্যোগ৷
মার্সিও ভিয়েইরা জানান, ‘‘এই জরিপের পর বোঝানো সহজ হয়েছে, কেন কোনো বড় আকারের নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করা সম্ভব নয়৷ প্রকৃতি ও পরিবেশ অগ্রাধিকার পেয়েছে৷ প্রশাসনের সব স্তরই এতে সংশ্লিষ্ট৷ এর ফলে আমরা হাতে এমন একটা অস্ত্র পেয়েছি, যা নগর বিকাশের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে৷''
কাজেই নতুন নগর পরিকল্পনায় ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে সুরক্ষিত বলে নির্দেশ করা হয়েছে৷ এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে – নগরের পক্ষে একটি সুরক্ষা প্রাকারের মতো৷ ভিয়েইরা-র কথায়, ‘‘প্রকৃতি সত্যিই এখানে মুগ্ধ করার তো৷ বিশেষ করে এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যে৷ এই অরণ্য যেন শক্তিতে ভরপুর৷''
এটা কি জলবায়ু পরিবর্তন?
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা – এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য কি জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী? নাকি এটা কাকতালীয়? ‘ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ একটি নতুন প্রতিবেদনে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে৷
ছবি: Fotolia/Daniel Loretto
আবহাওয়া এবং জলবায়ু
কখন আপনি এটাকে জলবায়ু পরিবর্তন বলবেন? যখন কয়েকদিন ধরে মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি হবে? নাকি বন্যার পানিতে তলিয়ে যাবে জমির ফসল? নাকি একটা পর একটা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে কোনো কারণ ছাড়াই? এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে আসলেই জলবায়ু পরিবর্তনের কোন যোগসূত্র আছে কিনা – তা বের করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন গবেষকরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকি বাড়ছে
এখনো বিজ্ঞানীদের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার ব্যাপক রকমফের হচ্ছে৷ একটি গবেষণায় তাঁরা ২০১২ সালের ১২টি দুর্যোগ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, এর মধ্যে অর্ধেক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ঘটেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দাবদাহ এবং খরার জন্য দায়ী
যুক্তরাষ্ট্রে দাবদাহ এবং খরার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করা হয়েছে৷ ২০১২ সালের জুলাই মাসে সেখানে ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে৷ এছাড়া কম বৃষ্টিপাতের কারণে সেখানে গম এবং শস্যের ফলনও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
সুমেরুর বরফ গলছে
আর একটি কারণ সুমেরুর বরফ৷ ২০১২ সালে আগের বছরগুলোর তুলনায় অধিক মাত্রায় বরফ গলেছে সেখানে৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা হঠাৎ করে হয়নি বরং গ্রীষ্মকালীন প্রচণ্ড গরম তাপমাত্রা এর জন্য দায়ী৷ তাঁদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী৷
ছবি: DW/I.Quaile
ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি
ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় ছিল৷ এর ব্যাপ্তি ছিল ৩ হাজার কিলোমিটার৷ স্যান্ডি এত শক্তিশালী হওয়ার কারণ ২০১২ সালে আটলান্টিক বা অতলান্ত মহাসাগর স্বাভাবিকের চেয়ে উত্তপ্ত ছিল৷ বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই এর জন্য দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
বৃষ্টি এবং বন্যা
তবে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে গবেষকরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি৷ ইউরোপ, চীন, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রবল বৃষ্টিপাতকে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সোমালিয়া এবং কেনিয়ার খরা
এমনকি সোমালিয়া ও কেনিয়ার ভয়াবহ খরার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন নয় বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ বলছেন, এটা আবহাওয়ার বৈচিত্রের কারণে হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নয়৷ তবে এ বিষয়ে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত নন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঘটনা এবং সংস্কার
জলবায়ু আসলেই বেশ জটিল ব্যাপার৷ বাস্তবে বিশ্বের প্রকৃতিতে কি কারণে কি ঘটছে, তা অনেক উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত৷ তবে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে৷ আর একটি বিষয় হলো মানুষের আচরণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী৷ এ কারণেই সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে, সেই সাথে দ্বীপগুলোর জন্য বাড়ছে ঝুঁকিও৷
ছবি: picture alliance/chromorange
সামুদ্রিক প্রাণীরা ঝুঁকির মুখে
কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সাগরে অম্লতার পরিমাণ বেড়ে গেছে৷ ফলে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক – এগুলো ঝুঁকির মুখে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
অতিরঞ্জন বাস্তব বর্জিত
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই৷ এর কারণ হয়ত ইস্যুটি নিয়ে অত্যধিক মাত্রায় আলোচনা৷ কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, এর ফলে বিজ্ঞানের সত্যতা হুমকির মুখে পড়বে, হুমকির মুখে পড়বে মানবজাতিও৷
ছবি: Reuters
10 ছবি1 | 10
ভাঁটা এলে সেটা চোখে পড়ে৷ তখন পাঁকে যারা থাকে, তাদের নড়াচড়া শুরু হয়৷ আসলে এই কাঁকড়াদের কল্যাণে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বহু জেলে পরিবার খেয়ে-পরে বাঁচে – যদিও কাঁকড়া নাকি কমে আসছে৷ হ্যাঁ, এমনটাই শোনা যাচ্ছে জেলেদের কাছে৷