বন জঙ্গল ঢালের মত মানবজাতিকে সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা করে৷ বনাঞ্চল উজাড়ে সেই ঢাল যখন আর থাকে না তখন বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক পরিণতি নেমে আসে৷
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞানীরা গত অন্তত দুই দশক ধরে এ বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন৷ তাঁরা বলেছেন, মানুষ যত সীমা লঙ্ঘন করে বনে প্রবেশ করবে৷ বুনো প্রাণীদের হওয়া নানা রোগ তত বেশি মানবজাতিকে সংক্রমিত করবে৷
এ কারণেই চীনরে উহানে নতুন একটি করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর একটুও অবাক হননি ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব মাতো গ্রাসো-র ইকোলোজিস্ট আনা লুসিয়ে তোউরিনহো৷ তিনি পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হলে কিভাবে বন এবং সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়ে তা নিয়ে গবেষণা করেছেন৷
তিনি বলেন, ‘‘যখন কোনো নতুন ভাইরাস সেটির প্রাকৃতিক আবাস ত্যাগ করে মানুষের দেহে প্রবেশ করে তখন ভীষণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ নতুন করোনা ভাইরাস সেটাই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে৷’’
গত ডিসেম্বরের শেষে দিকে উহানে প্রাদুর্ভাবের পর করোনা ভাইরাস গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে৷ মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটাই সম্ভবত প্রথম বৈশ্বিক মহামারী যেটাতে পুরো বিশ্ব আক্রান্ত৷ সার্স-কোভি-২ নামের এই ভাইরাসটি কোনো বন্য প্রাণী (সম্ভবত বাদুড়) থেকে মানব দেহে প্রবেশ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়৷
এ ধরনের ভাইরাস যখন নিজের উৎসতে আবদ্ধ থাকে (বিশেষ করে গভীর জঙ্গলে যেখানে মানুষ প্রবেশ করে না) তখন সেটি মানবজাতির জন্য একেবারেই ঝুঁকিপূর্ণ নয়৷কিন্তু এই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ যখন ভেঙে ফেলা হয়৷ অর্থাৎ, যখন বন উজাড় হতে থাকে সমস্যার শুরু হয় তখন৷
বাদুড় থেকে প্যাংগোলিন থেকে মানুষ
বাদুড় সম্ভবত নভেল করোনা ভাইরাসের উৎস হলেও প্যাংগোলিন যে সেই ভাইরাস বহন করে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ এই ভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য জানতে পারছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H.H. Young
করোনার যোগসূত্র প্যাংগোলিন
‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণার ফল অনুযায়ী, প্যাংগোলিনই সম্ভবত করোনা ভাইরাস, বাদুড় ও মানুষের মধ্যে যোগসূত্র৷ এই প্রাণী ও মানুষের শরীরে কোভিড-১৯-এর জিনগত গঠনের মধ্যে প্রায় ৮৫ থেকে ৯২ শতাংশ মিল পাওয়া গেছে৷ উল্লেখ্য, লুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসেবে প্যাংগোলিনই সবচেয়ে বেশি চোরাকারবার হয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/Mary Evans Picture Library
বাদুড়ের কেন্দ্রীয় ভূমিকা
এর আগেও বাদুড়বাহিত ভাইরাস বিশ্বে মহামারি ঘটিয়েছে৷ এবোলা এবং সার্স ও মার্সের মতো করোনা ভাইরাসের উৎসও যে বাদুড়, তা ধরে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ বিশ্বের সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই বাদুড় হওয়ায় তাই বিস্ময়ের কিছু নেই৷ গোটা বিশ্বে প্রায় ১,৩০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে এবং কয়েকটি প্রজাতির আয়ু ৪০ বছর পর্যন্ত ছুঁতে পারে৷ তাছাড়া বাদুড়ই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, যেটি পাখির মতো উড়তে পারে৷
ছবি: Narayan Prasad Koju
বাদুড় থেকে সরাসরি মানুষের শরীরে নয়
গোটা বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে ব্যস্ত, তখন অভিযোগের তির বাদুড়ের দিকেই যাচ্ছে৷ তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর জন্য সরসরি বাদুড়কে দায়ী করা যায় না৷ টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর ইয়ান শিয়াং ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাধ্যমেই এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে৷ অতীতে সিভেট বা গন্ধ গোকুল এবং উট এমন ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে কাজ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/Mary Evans Picture Library/J. Daniel
প্যাংগোলিনের ভূমিকা আবিষ্কার
ফেব্রুয়ারির শুরুতে দক্ষিণ চীন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রথম প্যাংগোলিনের সম্ভাব্য ভূমিকার কথা উঠে আসে৷ প্রায় এক হাজার বন্যপ্রাণীর নমুনা পরীক্ষা করে গবেষকদের সন্দেহ আরো জোরালো হয়ে৷ ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে মালয়েশিয়া থেকে চীনে অসুস্থ প্যাংগোলিনের চোরাচালানের সময় করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে৷ তবে প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে আরো গবেষণা প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H.H. Young
এমন মহামারি বিরল
লন্ডনের কিংস কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান স্টুয়ার্ট নিল ডিডাব্লিউ-কে বলেছেন, এমন মহামারি সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাষ দেওয়া সত্যি কঠিন৷ তবে তাঁর মতে, এত বড় বিপর্যয় ঘনঘন হবার আশঙ্কা কম৷ প্রাণীর তুলনায় অন্য সূত্র থেকেই মানুষ অনেক বেশি নতুন ভাইরাস গ্রহণ করে৷ কোনো প্রাণীর শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা কাঠামোর উপর কোনো ভাইরাসের প্রভাব নির্ভর করে৷ সব প্রাণী সব ভাইরাসে মোটেই কাবু হয় না, বলেন নিল৷
ছবি: Reuters/Str
মানুষ প্রাণীর ভিটেমাটি কেড়ে নিচ্ছে
মানুষ যত বেশি বণ্যপ্রাণীর নিজস্ব চারণভূমি দখল করে নিচ্ছে, এমন মহামারির আশঙ্কা ততই বাড়ছে৷ এতকাল বেশিরভাগ প্রাণী এবং সেগুলির শরীরে জমা ভাইরাস বনেজঙ্গলেই সীমিত থাকতো৷ মানুষ এই সব প্রাণীর সংস্পর্শে তেমন আসতো না৷ কিন্তু বেড়ে চলা জনসংখ্যা ও জঙ্গল সাফ করে মানুষের বসতি, কলকারখানা ও কৃষিকাজের ফলে সেই পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে৷ ফলে মারাত্মক ভাইরাস মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Damanik
6 ছবি1 | 6
করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আগেই বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বন উজাড়ের কারণে বাদুড়ের আবাস বিনষ্ট হওয়া এবং সেগুলোর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে নানা নতুন করোনা ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল৷
এমনকি, পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারশর গবেষক আনিতা আফেল্ট তাঁর গবেষণায় পরবর্তী মারাত্মক সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব এশিয়া মহাদেশ থেকে হবে বলে স্পষ্ট করে দেখিয়েছিলেন৷ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গত ৪০ বছরে এশিয়া মহাদেশে মারাত্মকভাবে বন উজাড় করা হয়েছে৷
২০১৮ সালে নিজের গবেষণাপত্রে আফেল্ট লিখেছিলেন, ‘‘দক্ষিণপূর্ব এশিয়া (এসইএ) বিশ্বের ওইসব অঞ্চলের অন্যতম যেখানে উচ্চহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক এবং যেখানে নির্বিচারে বন উজড় হচ্ছে৷ কোনো অঞ্চলে নতুন সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হওয়া বা পুরনো সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার সব রকম পূর্বশর্তই এসইএ অঞ্চলে স্পষ্ট৷’’
তোউরিনহো বলেন, ‘‘গভীর জঙ্গল আসলে এক ধরনের ঢালের মত৷ যেটা বাইরের মানুষদের বন্য প্রাণীর সংস্পর্শে আসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ বন্যপ্রাণী অনেক জীবাণু বহন করে যেগুলো নানা রোগব্যাধির কারণ৷ যখন আমরা বন টুকরো টুকরো করে ফেলি তখন সেটির গভীরে প্রবেশের রাস্তা তৈরি হয়৷ এটা টাইম বোমার মত৷ সময় শেষ হলেই বিস্ফোরণ ঘটে৷’’