সয়াবিনের চাষ আর পশুর খামার করে বিশ্বের বাজারে মুনাফার আশায় ব্রাজিলের বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় অরণ্যকে কেটে শেষ করছে এক মাফিয়া৷ তার মূল্য চোকাচ্ছেন সেই সব মানুষেরা, এই জঙ্গলে যাদের বাস ও জীবিকা৷
বিজ্ঞাপন
নানা জায়গায় আগুন ধরেছে বা ধরানো হয়েছে; পরিবেশ আন্দোলনকারী এলিজেউ বের্সাকলার সঙ্গে রন্দোনিয়ায় গেলে তা দেখা ও বোঝা যায়৷ রন্দোনিয়া হল আমাজোনিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে – এলাকাটিকে তিয়েরা দেল ফুয়েগো বা আগুনের দেশ বলা হয়ে থাকে; তাকেই ব্যঙ্গ করে যেন এই ট্র্যাজেডি৷ এলিজেউ সেই ট্র্যাজেডির ছবি তুলে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান৷
বনের জীবজন্তু পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছে, বাতাসে পোড়া গন্ধ৷ এলিজেউ বের্সাকলা জানালেন, ‘‘শুধু গরু চরানোর মাঠের জন্য আমাজোনিয়ার গাছ কেটে, জঙ্গল পুড়িয়ে সাফ করা হচ্ছে৷ আগুনে জঙ্গলের একাংশ সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে যায়; যে কটা গাছ দাঁড়িয়ে থাকে, পরে সেগুলোও পড়ে যায়৷ বহু জীবজন্তু মারা পড়ে৷''
আদিম অরণ্য বিনষ্ট করার আরেকটা কারণ হলো সয়াবিনের চাষ৷ মূল্যবান রেনফরেস্ট আর সয়া চাষের খামারের মধ্যে পাকা রাস্তা ধরে সারাদিন ফসল-বোঝাই ট্রাক চলে৷ গরু চরানোর মাঠও বাড়তে থাকে৷
বন কেটে মুনাফা এবং সর্বনাশ
04:24
অল্প লইয়া থাকি তাই...
বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় জঙ্গলের একপাশে এডারসন ও তাঁর স্ত্রীর মতো কিছু ছোটচাষি বাস করেন৷ এলিজেউ তাদের বোঝালেন, কীভাবে তাদের ছোট্ট খামারটির চারপাশে সয়াচাষ আর গোচারণ মাফিয়া তাদের গতিবিধি বাড়িয়ে চলেছে – যা এডারসন দম্পতির খুব ভালো করেই জানা, কেননা তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, তারা শীগগির এই এলাকা ছেড়ে চলে না গেলে, তাদের খুন হওয়ার সম্ভাবনা আছে৷
এডারসন ছেলেবেলা থেকে এই জঙ্গলেই মানুষ হয়েছেন; সেই জঙ্গল আজ তাঁর কর্মক্ষেত্র, কেননা তিনি রাবার চাষি; গাছ চিরে যে কাউচুক বা গাম ইলাস্টিক পাওয়া যায়, তাই বিক্রি করে তিনি জীবিকা অর্জন করেন৷ কাজেই এই জঙ্গল তাঁর কাছে পবিত্র৷ কিন্তু জঙ্গলের ভিতর খানিকটা ঢুকতেই দেখা গেল যে, সম্প্রতি এখানে অন্য মানুষজনও চলাফেরা করেছে: সেই সব অপরাধীদের আসা-যাওয়ার চিহ্ন, যারা প্রথমে বনের মধ্যে ছোট পথ করে, পরে সেই পথ দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গাছ কেটে জমি তৈরি করে৷ জরিপের মানচিত্র বরাবর এই জমিগুলো তৈরি করা হয় ও বেচা হয়৷
অ্যামাজনের জঙ্গলে বেআইনি গাছ কাটার বিরুদ্ধে সংগ্রাম
দক্ষিণ অ্যামেরিকার অ্যামাজন নদীর অববাহিকার বৃষ্টিপ্রধান গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্য প্রায় দুশ’ কোটি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নেয়৷ ব্রাজিলের পরিবেশ দপ্তরের কর্মীরা পৃথিবীর এই সবুজ ফুসফুসকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
সবুজ ফুসফুস
অ্যামাজন নদীর অববাহিকায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্যের আয়তন ভারতের প্রায় দ্বিগুণ৷ সেই অরণ্যের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ব্রাজিলে৷ কিন্তু পৃথিবীর এই সবুজ ফুসফুস বেআইনি গাছ কাটা আর খনিজ সম্পদের জন্য খোঁড়াখুড়ির ফলে বিপন্ন৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
হাতে-নাতে ধরা
মিলিটারি পুলিশ সাথে নিয়ে ‘ইবামা’-র এজেন্টরা বেআইনি গাছ-কাটিয়েদের পিছনে ধাওয়া করছেন৷ ‘ইবামা’ বলতে বোঝায় ব্রাজিলের পরিবেশ ও নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ প্রতিষ্ঠান৷ ইবামার এজেন্টরা চোরা কাঠুরিয়াদের হাতে-নাতে ধরার চেষ্টা করেন৷ ছবিতে ইবামার এক এজেন্ট কাঠ বওয়ার ট্রাকের দিকে তাক করছেন৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
দেরি করা নেই...
ইবামা বেআইনি কাঠ-কাটিয়েদের প্রতি খুব সদয় নয়৷ ইবামার এজেন্টদের হাতে ধরা পড়লে আর নিস্তার নেই৷ পারা রাজ্যের নোভো প্রোগ্রেসো শহরের কাছে কাঠ সুদ্ধু ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি ইবামার কর্মকর্তারা৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
বিপজ্জনক
ইবামার কাজে ঝুঁকিও কম নয়৷ কিছু কিছু চোরা কাঠুরের কাছে গুলিবন্দুক থাকে৷ গত জুন মাসে এক পুলিশকর্মী অভিযান চালানোর সময় অপরাধীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
সাফল্যের চেয়ে অসাফল্যই বেশি
এক্ষেত্রে ইবামার কর্মকর্তারা সফল হয়েছেন বটে, কিন্তু এ ধরনের সাফল্য কমে আসছে৷ পরিবেশ বিভাগের উপরেও অর্থনৈতিক সংকটের ছাপ পড়েছে৷ বিগত কয়েক বছরে তাদের বাজেট কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
ঢাল নেই, তলোযার নেই
‘‘কাঠ চোরাদের কাছে আমাদের চেয়ে ভালো সাজসরঞ্জাম থাকে’’, বললেন পারা রাজ্যে ইবামার প্রতিনিধি উইরাতান বারোসো৷ ‘‘যতদিন আমরা মার্কা-না-মারা গাড়ি আর ভালো রেডিও সেট না পাচ্ছি, ততদিন আমরা ভালোভাবে কাজ করতে পারব না৷’’
ছবি: Reuters/U. Marcelino
পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে
ইবামার উদ্যোগের ফলে ২০০৪ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে অ্যামাজনের অববাহিকা অঞ্চলে গাছ কাটা কমেছে প্রায় আশি ভাগ৷ কিন্তু তার পরের চার বছরে গাছ কাটা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ৷ ২০১৫ সালে অ্যামাজন জঙ্গলের যে অংশটা কেটে ফেলা হয়, তার আয়তন হবে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের চারগুণ৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
জার্মানি আর নরওয়ের সাহায্য
ব্রাজিল সরকার স্বীকার করেন যে, ইবামা যাতে ঠিকমতো তার দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেজন্য পর্যাপ্ত অর্থসংস্থান করা হয়নি৷ এখন ফুন্ডো আমাজোনিয়া বা অ্যামাজন নিধি থেকে আরো ১৫ লাখ ইউরো পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে৷ অ্যামাজন নিধির পুঁজি আসে প্রধানত জার্মানি ও নরওয়ে থেকে৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
8 ছবি1 | 8
জঙ্গলের মাফিয়া
এলিজেউ বের্সাকলা বললেন, ‘‘ওরা এখান দিয়ে গিয়েছে, গাছ ভেঙে পথ নির্দেশ করেছে৷ ওরা এমন সব মানুষ, যারা এলাকাটাকে চেনে, যেমন বনরক্ষী কিংবা জরিপের লোক৷ ওরা গাছ ভেঙে কিংবা দাগ কেটে জমির পরিধি নির্দিষ্ট করে, পরে প্লট অনুযায়ী সেই জমি বেআইনিভাবে কাজের জমি হিসেবে বিক্রি করা হয়৷ এর পিছনে একটি অপরাধীচক্র কাজ করছে৷''
আকাশ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, আদিম বনভূমির মাঝখানে থেকে থেকে গাছপালা কীভাবে উধাও হয়েছে৷ এই জমিগুলোই পরে বিক্রি করা হবে, তাই আগুন ধরিয়ে সেখানকার ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা হচ্ছে৷ জমি যারা কেনে, তাদের মনোবৃত্তি হল: ‘‘জঙ্গল তো গেছেই৷ এখন সেখানে চাষ করলে দোষটা কী?''
২০১৬ সালে বৃষ্টিপ্রধান অরণ্য বিনাশের পরিমাণ ২০১৫ সালের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে বলে নিরপেক্ষ পরিবেশ প্রতিষ্ঠান ইবামা-র অনুমান৷
ধ্বংস হচ্ছে আমাজন
আমাজনের রেইনফরেস্ট ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷ গাছ কাটা এবং জঙ্গল পোড়ানোর কারণে কেবল এই বছরেই ধ্বংস হয়েছে ৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন৷
ছবি: Reuters
দগ্ধ পৃথিবী
২০১৩ সালে ব্রাজিলের রেইনফরেস্ট উজারের চিত্রটা আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ ওয়ারশ শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ব্রাজিলের পরিবেশমন্ত্রী ইসাবেলা টেইশেইরা উল্লেখ করেন, এ বছরের নভেম্বরের মধ্যে আমাজনের ৫,৮৪৩ বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছে৷ ২০১২ সালে যেখানে ৪,৫৭১ বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছিল৷ ২০০৪ সালে আমাজনের ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বন উজাড় হয়েছিল, যা একটি রেকর্ড৷
ছবি: picture alliance/Wildlife
গমের জন্য কাঠের বাণিজ্য
সয়া এবং গম চাষ আমাজনের রেইনফরেস্ট উজাড়ের জন্য অনেকটা দায়ী৷ ব্রাজিলের পারা রাজ্যের বন এ কারণে সবচেয়ে বেশি উজাড় হয়েছে৷ ২০১২ সালের আগস্ট থেকে ২০১৩-র জুন পর্যন্ত সেখানে ১৩৬ ভাগ বন ধ্বংস হয়েছে৷ পারার কাছের নভো প্রোগ্রেসো শহর গড়ে তুলতে ৪০০ হেক্টর জমি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল৷
ছবি: Reuters
শহরগুলোর বাঁধ
আমাজনে ব্রাজিলের ২০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র পাঁচ ভাগ আদিবাসী থাকলেও, সেখানে বাঁধ নির্মাণ ক্রমেই বেড়ে চলছে৷ আমাজন অঞ্চলে টেলেস পিরেস পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৫ সালে চালু হওয়ার কথা৷ এর মধ্যে মাত্র একভাগ আমাজনের অধিবাসীদের জন্য ব্যবহৃত হবে৷ ব্রাজিলের জাতীয় শক্তি কেন্দ্র ২-৩০ সালের মধ্যে এ ধরনের কার্যক্রম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে৷
ছবি: Reuters
ভালো ব্যবসা?
বন উজাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সেখানকার কাঠ৷ অবৈধভাবে উজাড় হওয়া আমাজন এখন চারণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ ব্রাজিলের আইন অনুযায়ী, কেউ যদি ঐ জমিতে উৎপাদনশীল কাজ করে তাহলে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য জমি ‘লিজ’ নিতে পারবে৷ প্রসঙ্গত, উজাড় হওয়া জমির প্রতি হেক্টরের দাম ৩ হাজার ইউরো করে৷
ছবি: Reuters
গাছ যেখানে প্রধান পণ্য
গত বছর ব্রাজিল সরকার ঘোষণা করে যে, ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার বন রেইনফরেস্ট ধ্বংস রোধের৷ কিন্তু স্বর্ণ সন্ধানকারী এবং কৃষি কোম্পানিগুলোর কারণে গাছের সংখ্যা বাড়ছে না৷
ছবি: Reuters
ধ্বংসের পথ
৩,০০০ কিলোমিটার ‘ট্রানস-আমাজনিকা’ মহাসড়কটি ব্রাজিলের সাথে প্রতিবেশী দেশ পেরু ও বলিভিয়ার সংযোগ স্থাপন করছে৷ ৪০ বছর ধরে সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে৷ চলছে এটির সংস্কার কাজ, যা এখনো শেষ হয়নি৷ তবে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এই সড়ক সংস্কারের বিপক্ষে৷
ছবি: Evaristo Sa/AFP/GettyImages
স্বর্ণের সন্ধানে
স্বর্ণের খোঁজে যারা আমাজন চষে বেড়ায়, তারা অনেক সময় নিজেদের এলাকা থেকে নানা ধরনের রোগ বহন করে নিয়ে আসে৷ সেই সব রোগের সংক্রমণে স্থানীয় ‘ইয়ানোমামি’ গোষ্ঠী আক্রান্ত হয়৷ শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত কয়েকশ’ ইয়ানোমামি মারাও গেছে৷ এ বছরের জুনে তাই ব্রাজিলের সেনাবাহিনী ভেনেজুয়েলা সীমান্তের ৯৫ লাখ হেক্টর জমি থেকে অবৈধ স্বর্ণ সন্ধানকারীদের আস্তানা তুলে দেয়৷
ছবি: Fiona Watson/Survival
চারকোলের উৎস
কৃষ্ণ স্বর্ণ: ‘আল্টো রিও গুয়ামা’ সংরক্ষিত এলাকার মধ্যাঞ্চলের দৃশ্য এটি৷ অবৈধভাবে কেটে ফেলা গাছগুলোকে চারকোলে পরিণত করা হয়৷ এ বছরের সেপ্টেম্বরে একটি পুলিশ হেলিকপ্টার থেকে এই ছবিটি তোলা হয়েছে৷ ব্রাজিলের পারা রাজ্যে অবস্থিত সংরক্ষিত এই এলাকাটিতে ‘নোভা এসপেরাঙ্কা’ সম্প্রদায়ের বসবাস৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
‘ইবামা'-র কর্মী রোব্যারতো কাব্রাল বোরজেস অভিযোগ করলেন, ‘‘সমস্যা এই যে, আমরা কাউকে বেআইনিভাবে গাছ কাটার সময় ধরলে, পরের বার আবার তাকে সেই একই কাজ করতে দেখা যায়৷ কোনো কিছু বদলানোর রাজনৈতিক ইচ্ছা অবর্তমান, নয়তো যারা বারংবার পরিবেশ ধ্বংস করার কাজে ধরা পড়ছে, তাদের আরো কড়া সাজার ব্যবস্থা করা হতো৷ আমাজোনিয়ায় জঙ্গল কাটার বিরুদ্ধে সেটাই একমাত্র কার্যকরী হতে পারে৷''
কিন্তু ব্রাজিল সরকার বরং সুরক্ষিত এলাকাগুলিকেও কমিয়ে আনতে চান৷ কংগ্রেসে ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট তেমের-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্ত রোখা হয়, ফলে তাঁকে সাসপেন্ড করা সম্ভব হয়নি৷ বিভিন্ন দলের মোট ৩০ শতাংশ সাংসদ খামারচাষিদের লবির হাতে, এমনকি ভোটের আগে সেই লবির লোকজন প্রেসিডেন্ট তেমের-এর জন্য ভোট কিনেছে বলে কানাঘুষোয় শোনা গেছে৷