বরফ গলে চলায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক জীবাশ্ম বেরিয়ে পড়ছে৷ বিজ্ঞানীদের কাছে এ সব গুপ্তধনের মতো৷ ১৯৯১ সালে হিমবাহের মধ্যে ‘ও্যৎসি'-র আবিষ্কার ছিল বিশাল এক চমক৷ প্রায় ৫,৩০০ বছর আগে এই শিকারি জীবিত ছিল৷ তার শুকনা জমাট শরীর এতকাল বরফের নীচে চাপা ছিল৷ ‘ও্যৎসি'-র সঙ্গে পাওয়া যন্ত্রপাতি দেখে প্রাগৈতিহাসিক যুগের এই আবিষ্কারের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে৷
বরফের নীচে এমন ঐশ্বর্যের অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি৷ বরফ গললে ও তার নীচের জমির জমাট ভাব কেটে গেলে এই কাজে সাফল্যের হার বেড়ে যায়৷ তখন গবেষকরা একেবারে অক্ষত জীবজন্তুও পেয়ে যান৷ যেমন ‘লিউবা' নামের প্রায় ৪২,০০০ বছর বয়স্ক ম্যামথ৷ সাইবেরিয়ার উত্তরে বিলুপ্ত এই প্রজাতির একটি শিশুর মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল৷ তার শরীরের জিন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতির উত্থান ও পতন সম্পর্কে তথ্য পেতে চান৷
বরফে ছাওয়া অ্যান্টার্কটিকা থেকে প্রতি বছর ১৬ হাজার কোটি টন বরফ গলে যাচ্ছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে বরফ গলার হার চার বছর আগের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, যাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর বাড়তে পারে আধা মিলিমিটার করে৷
ছবি: APবিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে মহাসাগরগুলোর উষ্ণ স্রোত এসে পৌঁছাচ্ছে অ্যান্টার্কটিকায়৷ এর সংস্পর্শে এসে গলে যাচ্ছে পশ্চিম, পূর্ব এবং অ্যান্টার্কটিকা উপদ্বীপের গ্লেসিয়ার বা হিমবাহগুলো৷ বরফ গলার এই হার ক্রমশ দ্রুততর হচ্ছে৷
ছবি: ESA/dpaঅ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে ঢেকে রাখা বরফের স্তর কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে – তার ওপর বিজ্ঞানীরা নজর রাখছেন ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের মহাকাশযান ক্রাইয়োস্যাটের মাধ্যমে৷ ক্রাইয়োস্যাটের পাঠানো ছবি পরীক্ষা করে তাঁরা বলছেন, সেখানে বরফ স্তরের উচ্চতা প্রতিবছর গড়ে দুই সেন্টিমিটার করে কমছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/NASA‘জিওগ্রাফিক্যাল রিসার্চ লেটার’ জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যান্টার্কটিকার ছয়টি হিমবাহ যেভাবে গলে যাচ্ছে তা আর থামানো সম্ভব নয়৷ বরফের এই নদীগুলো হয়ত কয়েকশ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাবে৷
ছবি: picture-alliance/dpaএর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানিয়েছিলেন, ১৯৫০ থেকে এখন পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় যে পরিমাণ বরফ রয়েছে তার সব যদি গলে যায়, তাহলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১১ ফুট বেড়ে যাবে৷
ছবি: NASA's Goddard Space Flight Centerউত্তর মেরুর সাগরে বরফের পরিমাণ ২০১২ সালের অক্টোবরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়লেও ১৯৮০ সালের তুলনায় বরফের পরিমাণ এখন প্রায় অর্ধেক৷ যুক্তরাজ্যের গবেষকরা বলছেন, ১৯৮০ সালের অক্টোবরে উত্তর মেরুর সাগরে বরফের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ঘন কিলোমিটার৷ সেখানে গতবছর বরফ পাওয়া গেছে মাত্র নয় হাজার ঘন কিলোমিটার এলাকায়৷
ছবি: picture alliance/ZBঅস্ট্রিয়ার আল্পসে পাস্টেয়ার্সে হিমবাহ গলে যাওয়ার হার সাম্প্রতিক সময়ে নাটকীয় হারে বাড়ছে৷ ফলে হিমবাহে বরফের উচ্চতা বছরে প্রায় ৫০ ফুট করে কমছে৷ ১৯৬৮ সালে হিমবাহটি কোন উচ্চতায় বইতো – তা দেখানো হয়েছে ২০০৬ সালে তোলা এই ছবিতে৷
ছবি: picture-alliance/OKAPIAমানুষ্যসৃষ্ট দূষণেই বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু৷ এর প্রভাব কতটা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে – তা এক প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেখিয়েছেন ব্রাজিলের শিল্পী নেলে আজেভেদো৷ ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের সহযোগিতায় ২০০৯ সালে জার্মানির বার্লিনে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়৷
ছবি: AP
রুশ গবেষকরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে আবার এই ‘উলি ম্যামথ' সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করছেন৷ ক্লোন করা ম্যামথ? নৈতিকতার মানদণ্ডে বিষয়টি বিতর্কিত, এ ক্ষেত্রে সাফল্যও অনিশ্চিত৷ বরফে জমাট মাটির তলায় বিলুপ্ত প্রাণীদের ক্ষুদ্র সংস্করণের অভাব নেই৷ বরফ গলার পর সেগুলির পুনরুজ্জীবনও অসম্ভব নয়৷
যেমন একটি ভাইরাস৷ মার্সেই শহরের গবেষকরা এর নাম রেখেছেন ‘পাইথোভাইরাস'৷ প্রায় ৩০,০০০ বছর ধরে সেটা বরফে জমাট মাটির নীচে বন্দি ছিল৷ এখন একটি অ্যামিবার মধ্যে সেটিকে আবার জীবন্ত করে তোলা হয়েছে৷
বরফের মধ্যে জমাট এই সব নিদর্শন মানবজাতির আদি ইতিহাস সম্পর্কেও অনেক তথ্য সরবরাহ করে৷ শত্রুর মোকাকিলা করতে মানুষ তখন কী ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতো, সে বিষয়ে আরও জানা যায়৷
মানুষ সহ বিভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টির রহস্য, জীবনের রহস্য এখনো বরফের স্তরের নীচে লুকিয়ে রয়েছে৷ এই চমকপ্রদ বিশ্বে যে আরও কত বিস্ময় লুকিয়ে রয়েছে, কে জানে!